গরমে সুস্থ থাকতে পাটশাক

রত্না খাতুন

প্রকাশ : ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

প্রচণ্ড গরমে সবার অবস্থা নাজেহাল। রোদ এবং গরমের তীব্রতার সাথে সাথে অ্যাসিডিটি, বমি, পানিশূন্যতা, ডায়রিয়া, মাথাব্যথা, মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকি, হিটস্ট্রোক, চর্মরোগ, চিকেনপক্স বা গুটিবসন্তসহ বিভিন্ন রোগ এবং স্বাস্থ্যসমস্যা বাড়ছে। তাই এই সময় স্বাস্থ্যের দিকে অবশ্যই নজর দিতে হবে এবং খাবার তালিকায় পরিবর্তন আনতে হবে।

শাকসবজির মধ্যে বেশ পরিচিত একটি নাম পাটশাক। সোনালি আঁশ হিসেবে পরিচিত অর্থকরী ফসল পাট; পাটপাতাকে পাটশাক বলে। পাটপাতা দুই প্রজাতির হয় একটি সামান্য তেতো আর একটি মিষ্টি। তেতো পাট কেবল শাক খাওয়ার জন্যই চাষ করা হয়, এতে সেলুলোজের মাত্রা কম থাকায় সুস্বাদু ও হজমে সুবিধা হয়। পাটপাতা শারীরিক অসুস্থতা যেমন- মাথাব্যথা, চিকেনপক্স বা গুটিবসন্ত, ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং গুঁড়াকৃমি চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। দেশীয় অন্যান্য শাকের তুলনায় পাটশাকে ক্যারোটিনের পরিমাণও থাকে অনেক বেশি। এছাড়া রয়েছে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, অ্যালকালয়েড, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, প্রোটিন, লিপিড, কার্বোহাইড্রেট, সেলেনিয়াম, ফসফরাস, ফলিক অ্যাসিড, ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই’সহ প্রচুর খাদ্যশক্তি। ১০০ গ্রাম পাটশাকে ক্যালরি থাকে ৭৩ কিলোজুল। এতে আমিষ থাকে ৩ দশমিক ৬ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ২৯৮ মিলিগ্রাম, লোহা ১১ মিলিগ্রাম ও ক্যারোটিন ৬৪০০ (আইইউ)। এতে থাকা ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম হাড় সুগঠিত করে এবং হাড়ের ক্ষয় রোধ করতে সাহায্য করে, আয়রন ও সোডিয়াম হাড় গঠন ও ক্ষয়পূরণ করে হাড়ের ভঙ্গুরতা রোধে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। দৈনিক একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের কমপক্ষে ৭৫০ মাইক্রোগ্রাম এবং শিশুদের ২৫০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন এ প্রয়োজন, যা অনায়াসেই পাটশাক থেকে পাওয়া সম্ভব। পাটশাক খাবারে রুচি বাড়ায় ও মেদ বৃদ্ধির আশঙ্কা কমায়। খেতে বসে প্রথম খাবার যদি তেতো খাওয়া হয়, তাহলে সেটা মুখে লালা ক্ষরণ করে শ্বেতসারকে তথা কার্বোহাইড্রেটকে ভাঙতে সাহায্য করে, এতে হজমের সুবিধা হয়। লিভারও ভালো থাকে। পাটপাতায় ঔষধি গুণাগুণ থাকার কারণে এটি তিক্ত টনিক হিসেবে পাকস্থলী প্রশমক, কোষ্টকাঠিন্য দূরীকারক, পাকস্থলীয় বায়ুনাশক বা রক্তনালির সংকোচক রোধক এবং অন্ত্রের অ্যান্টিসেপটিক ঔষধ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। প্রাচীন ভারতবর্ষীয়রা পাটগাছকে ছাই করে, মধুর সাথে মিশিয়ে অন্ত্র পরিষ্কার করার জন্য ব্যবহার করে। পাটপাতার গুঁড়া, ৫ থেকে ১০টি বীজদানা, গুঁড়া হলুদের সাথে সমান অংশে মিশিয়ে, আমাশয় নিরাময়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। দেখা গেছে, এক গ্রাম পাটপাতা শুকনা আধাকাপ পানিতে ভিজিয়ে কিছুক্ষণ পর পাটপাতার পানি ছেঁকে খেলে আমাশয় রোগ ভালো হয়। এছাড়া, দেড় গ্রাম পরিমাণ পাট পাতার গুঁড়া ভাতের সাথে খেলে বারবার টয়লেটে যাওয়ার প্রবণতা অনেকখানি কমে যায়। এছাড়া, এক গ্রাম পাটপাতা গুঁড়া এবং এক গ্রাম হলুদ গুঁড়া একসাথে মিশিয়ে ঠান্ডা পানির সাথে দিনে দুইবার করে খেলে রক্ত আমাশয় ভালো হয়। পাটশাক রক্তের কোলেস্টেরল কমাতে সহায়তা করে থাকে এবং নিয়মিত পাটশাক খেলে হার্টঅ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে। গ্যাস, অ্যাসিডিটির মতো পেটের সমস্যা কমাতে চাইলে খেতে হবে পাট পাতা। এই পাতায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার যা অন্ত্রে ভালো ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়ানোর কাজে সাহায্য করে। আর অন্ত্রে উপকারী ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়লে পেটের অসুখ কমানো সম্ভব হয়। তাই গ্যাস, অ্যাসিডিটিতে ভুক্তভোগীরা অবশ্যই নিয়ম করে পাট পাতার তরকারি বা পাট পাতার চা খান। তবে উপকার মিলবে। গবেষকরা লাইকোপিন নামক একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পাট শাকে পেয়েছে, যা খেলে শরীরে সৃষ্ট প্রদাহ কমে এবং অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে শরীরের কোষগুলোকে রক্ষা করে বা শারীরিক প্রদাহ কমায়। অলিটোরিয়াস জাতীয় পাটপাতা থেকে ছয়টি ফেনোলিক অ্যান্টিঅক্সিডেটিভ জৈবযৌগ পাওয়া গিয়েছে যেগুলো নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স (এনএমআর) ও ফাস্ট অ্যাটম বোমবাটমেন্ট ভর স্পেকট্রোমেট্রি (এফএবি-এমএস) দ্বারা পরীক্ষিত; যেমন- ৫-ক্যাফেওয়েলকুইনিক অ্যাসিড বা ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড, ৩, ৫-ডিকাফেওয়েলকুইনিক অ্যাসিড, কোয়ারসেটিন-৩-গ্যালাটোসাইড, কোয়ারসেটিন-৩-গ্লুকোসাইড, কোয়ারসেটিন-৩-(৬-জিকোসিডন) এবং কোয়ারসেটিন-৩-(৬-ম্যালোনিলগ্যাল্যাক্টোসাইড)। গবেষণা করে দেখা যায় যে, ৫-ক্যাফেওয়েলকুইনিক অ্যাসিড একটি অন্যতম প্রধান ফেনোলিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। ২০ গ্রাম অলিটোরিয়াস জাতীয় পাটপাতা বাতাসে শুকিয়ে পানিতে ১:২০ অনুপাতে সাধারণ তাপমাত্রায় তিন দিন ভিজিয়ে রাখার পর সংগৃহীত নির্যাসটি সুপারঅক্সাইড অ্যানায়ন র‌্যাডিকাল স্ক্যাভেঞ্জিংয়ের বিরুদ্ধে প্রায় ৯০% প্রতিরোধে গড়ে। তাই পাটশাক মানবদেহে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা বাড়ায় এবং রোগ প্রতিরোধ করে। ওজন কমানোর মিশনে থাকলে খাদ্যের তালিকায় রাখুন পাট শাক। এতে আছে পর্যাপ্ত ফাইবার আর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা ওজন কমাতে সাহায্য করে। গরমে সুস্থ থাকতে আমাদের নিয়মিত পাটশাক খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে এবং নিরাপদ বিশুদ্ধ পানি খাওয়ার বিকল্প নেই। এছাড়া, কার্বনেটেড বেভারেজ জাতীয় পানীয় পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

লেখক : বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট,

মানিক মিয়া এভিনিউ, ঢাকা-১২০৭