ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রাজধানীতে কিশোর গ্যাংপ্রবণ এলাকা

কিশোরদের মধ্যে জাগ্রত করতে হবে মানবতাবোধ
রাজধানীতে কিশোর গ্যাংপ্রবণ এলাকা

রাজধানীর ২০ ভাগ এলাকা কিশোর গ্যাংপ্রবণ এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতারা। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান নিজেই এমন তথ্য দিয়ে বলেছেন, রাজধানীর ৫০টি থানার মধ্যে ১০টি থানা এলাকায় কিশোর গ্যাং সদস্যের অপরাধ লক্ষ্য করা যায়। এসবের মধ্যে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী ও উত্তরা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বেশি। গত শনিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, আজকের কিশোর আগামী দিনের যুবক। তারাই আগামী দিনের নেতৃত্ব দেবে। ৯ থেকে ১৮ বছর বয়সি কেউ অপরাধ করলে আমরা তাকে কিশোর অপরাধী বলছি। এই বয়সি কিশোররা দলবদ্ধভাবে অপরাধ করলে তাকে আমরা বলছি ‘কিশোর গ্যাং’। তবে তাদের নিয়ে ‘কিশোর গ্যাং’ শব্দ বলতে চাই না। কিশোর গ্যাংয়ের মদদদাতাদের তালিকা করা হয়েছে। এলাকায় রাজনীতি টিকিয়ে রাখতে কেউ কেউ কিশোরদের ব্যবহার করছেন। কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে সবার আগে পরিবারকে সচেতন হতে হবে। অভিভাবকরা যেন তাদের কোমলমতি সন্তানদের সময় দেন ও ঠিকমতো দেখাশোনা করেন। যাতে তারা কিশোর গ্যাংয়ের মতো অপরাধে জড়িয়ে না পরে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে পরিবার ও সমাজকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রে প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক দুটি কাজ করতে গিয়ে পুলিশ বিভিন্ন স্কুলে, পাড়ায়, অনুষ্ঠানে এমনকি মসজিদে গিয়েও মানুষকে সচেতন করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানামুখী তৎপরতার পরও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কিশোর অপরাধীদের। তাদের ভয়ে সাধারণ মানুষ তটস্থ। কেন না, কিশোর গ্যাং সদস্যদের এসব অপকর্মের মূলে থাকে তাদের কথিত ‘বড় ভাই’। শুধু দেশের শহরগুলোতেই নয়, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এখন বিভিন্ন উপজেলায়ও তৎপর। সারাদেশেই ‘কিশোর গ্যাং’ সক্রিয়। ঢাকা শহরে কিশোর গ্যাং আছে ৭০টির বেশি।

২০২৩ সালে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে শুধু ঢাকাতেই ২৫ জন খুন হয়েছেন। ২০২২-২৩ দুই বছরে তাদের হাতে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ১৬টি থানার তথ্যমতে, চট্টগ্রাম নগরে এখন সক্রিয় রয়েছে দুই শতাধিক কিশোর গ্যাং। একেক দলে রয়েছে ৫ থেকে ১৫ জন। নগরজুড়ে এদের সদস্যসংখ্যা প্রায় দুই হাজার। কিশোর গ্যাংকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন ৬৪ ‘বড় ভাই’। নগরের গুরুত্বপূর্ণ ৪৫টি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে তারা। বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি, সরকারি দপ্তরগুলোতে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, গার্মেন্ট ব্যবসা, জমি দখল, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল কিংবা কোণঠাসা করাসহ বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে গ্রুপিং, সংঘর্ষ ও খুনের ঘটনায় জড়িত কিশোর গ্যাং লিডাররা। আর গ্রুপ ভারী করতে কথিত বড়ভাইরা কিশোর-তরুণদের বিপথগামী করে তুলছে। এদের বেশিরভাগই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের। নামে কিশোর গ্যাং হলেও দলে ২০ থেকে ৩২ বছর বয়সিরাও রয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত, মাদক ও যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন করছে নগরের মানুষ। কিশোর অপরাধের মামলাও বেড়েছে চট্টগ্রাম আদালতে। বর্তমানে ২ হাজার ২৩২টি মামলা বিচারাধীন। দ্রুত নগরায়ণ কিশোরদের অবসর সময় কাটানোর পরিবেশ ও প্রতিবেশকে ধ্বংস করে দিয়েছে। পরিবার ও সমাজ-কাঠামোর পরিবর্তন এবং খেলাধুলা ও অন্যান্য বিনোদনের মাধ্যমে অনুপস্থিতি ও সংকুচিত হওয়ার কারণে অবসর বিনোদনের ঘাটতি পূরণ হচ্ছে কৃত্রিম পরিবেশ ও আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে। অভিভাবকদেরও অনেকটা ব্যস্ততার কারণে ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে সময় কাটানো ও সঙ্গ দেওয়ার সময় নেই কিংবা কেউ কেউ প্রয়োজনও বোধ করছে না। এখন প্রযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি হচ্ছে। গ্রুপের ভালো-মন্দ বোঝার মতো ক্ষমতা কিশোরদের মধ্যে নাও থাকতে পারে। উঠতি বয়সের কিশোরদের মধ্যে এক ধরনের উন্মাদনা কাজ করে। তারা অন্য কারো দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। কোনো প্রকার ভৌত অবকাঠামো ছাড়াই তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে এক জায়গায় একত্র হয়ে অপরাধমূলক কাজের পরিকল্পনা, খুন ও হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ তারা করছে।

বিপরীতে সমাজে এমন গ্রুপও রয়েছে, যারা বয়সে তাদের মতোই কিশোর, পড়াশোনা করছে কোনো না কোনো কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে, এমনকি পড়াশোনাও হয়তো করছে না; কিন্তু নিজেদের টাকা খরচ করে বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজের জন্য গ্রুপ গঠন করছে। তারা শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে, রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরিবেশ রক্ষায় কাজ করছে, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো কিংবা স্বেচ্ছায় রক্ত দিয়ে মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছে। এমন কিশোর-কিশোরীরাও আমাদের সমাজেরই মানুষ। তাদের বেড়ে ওঠা ও বড় হওয়ার ভিন্নতার জন্য, পরিবার ও সমাজের ভিন্নতার জন্য এবং খারাপ কোনো কিছুর সঙ্গে যুক্ত হওয়া কিংবা সুযোগ গ্রহণ না করার জন্য তারা প্রশংসিত। সমাজে যখন আমরা ভালো-মন্দ উভয় দিক খেয়াল করি, তখন খারাপ গ্রুপকে ভালো করার কাজটি আমাদেরই করতে হবে। এমন সব কাজ করতে হবে, যেখানে খারাপ হওয়ার সুযোগ তৈরি না হয়। কিশোরদের মাঝে বড় বিষয় হলো- অল্প বয়স ও পরিপক্বতার অভাব, যার কারণে কোনটি সঠিক আর কোনটি সঠিক নয়, তা বুঝতে না পারা। ফলে অনেক সময়ই গ্যাং কালচারকে বড় বিষয় মনে হয়। শারীরিক পরিবর্তন এবং এর সঙ্গে মানসিক অবস্থার পরিবর্তনের পাশাপাশি পরিবার ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তাদের সংঘবদ্ধ হতে এবং গ্রুপ গঠন করতে সহায়তা করে। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবারের জেলা প্রশাসক সম্মেলন উদ্বোধন উপলক্ষ্যে ভাষণ দানকালে সমাজে কিশোর গ্যাং সমস্যার প্রসঙ্গ টেনে সন্তান-সন্ততিদের প্রতি নজরদারি বাড়াতে প্রতিটি পরিবারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কারও ছেলেমেয়ে যেন কিশোর গ্যাং, জঙ্গি, সন্ত্রাস ও মাদকাসক্তিতে জড়িয়ে পড়তে না পারে। শুধু গ্রেপ্তার করে লাভ নেই, সচেতন হতে হবে। আমাদের দরকার শিশু-কিশোরদের ঘরে বন্দি না রেখে তাদের পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া এবং উদ্বুদ্ধ করা। কিশোরদের মধ্যে মানবতাবাদী, সহমর্মিতাবোধ ও সহানুভূতির বীজ রোপিত হবে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কাউট কাব, গার্লস গাইড, বিএনসিসি, রোভার স্কাউটসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি প্রদানের ক্ষেত্রে সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকাও বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। আর কারো ক্ষেত্রে অসংযত আচরণ পরিলক্ষিত হলে ব্যবস্থা নিতে হবে, শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নয়। পুলিশের একার পক্ষে এটি রোধ করা সম্ভব নয়। আমাদের সন্তান কার সঙ্গে মিশছে, পরিবারকে অবশ্যই তা খেয়াল রাখতে হবে। তাহলেই হয়তো এই সামাজিক অপরাধ থেকে মানুষ মুক্তি পাবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত