ধর্ষণ : অমার্জনীয় অপরাধ

আফতাব চৌধুরী

প্রকাশ : ০১ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

দেশের এক মারাত্মক ব্যাধির নাম ‘ধর্ষণ’। পুরো জাতি ধর্ষণ যন্ত্রণায় শিহরিত। পত্রিকার পাতা আর টিভির পর্দায় চোখ দিলেই দেখা যায় একের পর এক অমানবিক ধর্ষণ। সারা দেশে ধর্ষণের ছোবলে ক্ষতবিক্ষত পুরো অভিভাবকমহল। দেশের সর্বত্র ধর্ষণের ভয়াল থাবায় জর্জরিত। ধর্ষণের বলি হয়ে প্রতিবছর অসংখ্য মেয়েকে অকালে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। হাজারো মায়ের অশ্রুতে ভারি হয়ে উঠছে সারা দেশ। ধর্ষণ-গণধর্ষণ করেই ধর্ষকরা ক্ষান্ত হয়নি। ধর্ষিতাকে তারা আরও বেশি ভয় করেছিল। এতটাই যে, এতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তারা অকল্পনীয় নির্মম পন্থায় মেরে ফেলল। আমরা, আমাদের দেশ, মা-বাবা, বোন-ভাই, আত্মীয়-স্বজন, তার সহকারীরা কেউই আর তাকে জীবন্ত দেখার সুযোগ পাব না। তাসলিমা তার সাহসী মূর্তি নিয়ে আজ পরপারে। নীরবে, নিভৃতে এবং হয়তো বা সমাজের প্রতি ঘৃণার বোধ নিয়ে সেই অজানা-অচেনা বিশ্বে বাস করতেও শুরু করেছে। হ্যাঁ, আমরা ঘৃণার পাত্র। আমরা আমাদের কাজে প্রতিনিয়ত তার পরিচয় দিচ্ছি। একজন তাসলিমা নাকি? কত শত তাসলিমা সারা দেশে ধর্ষিত হচ্ছে প্রতিদিন- নিত্যদিন। আর ধর্ষিতার সংখ্যা যেন বেড়েই চলেছে।

পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে বিভিন্নভাবে নানা সময়ে ধর্ষণের জন্য ঘুরেফিরে কেবলমাত্র মেয়েদেরই দায়ী করা হয়। এক্ষেত্রে মূল যে কারণটি সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক বলে প্রতীয়মান, তা হচ্ছে মেয়েদের শালীন পোশাক পরার অন্তরায়। অনেকে এ কারণটি দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন। যারা এ কারণটি মানেন, তারা মনে করেন, মেয়েরা হচ্ছে আগুনের মতো এবং ছেলেদের যৌনসংযম অনেকটা মোমের মতো। মোম যেমন আগুনের সংস্পর্শে এলেই গলে যায় তেমনই অশালীন পোশাক পরা একজন নারীর সামনে একজন পুরুষ এলে তারও ভদ্রবেশী মুখোশ গলে গিয়ে কামনাময় চেহারা বের হয়ে আসে। ফলে এই কামনাবৃত্তি মেটাতে গিয়েই ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে। তারা কিন্তু আবার নীতিগতভাবে ধর্ষণ সমর্থন করেন না। আবার আর এক পক্ষ আছেন, যারা মনে করে থাকেন, নারী ধর্ষণের জন্য কেবলমাত্র পুরুষদের অতি কামনাময় চরিত্র এবং অতি সংবেদনশীল একটি শারীরিক অঙ্গই দায়ী। একজন নারীর অধিকার আছে তার ইচ্ছে মাফিক পোশাক পরার। ধর্ষণের জন্য দায়ী বিভিন্ন বিশ্লেষণ বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন ব্লগে-ফেসবুকে এবং ব্যক্তি পর্যায়ে আলোচিত হতে দেখেছি। আর প্রতিবারই আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছি, কিছু গুণী মানুষের কিছু বিশেষ ব্লগীয় বিশ্লেষণে। সত্যি বলতে, সমাজের এক অংশে এধরনের ধারণা প্রচলিত থাকে সেখানে নতুন করে ধর্ষণের কারণ খোঁজাটা সত্যি খুবই দুরূহ এবং কঠিন একটি ব্যাপার। কারণ, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় প্রচলিত ধারণা ভেঙে নতুন একটা ধারা সৃষ্টি করা প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ধর্ষণের মূল কারণ হচ্ছে কোনও ব্যক্তির মানসিক বিকৃতি, পারিবারিক শিক্ষার অভাব, সামাজিক সচেতনতা, নারী-পুরুষের সমঅধিকারের অপব্যবহার এবং সর্বোপরি আইনের শাসনের প্রয়োগ না হওয়া। দেখুন, একজন মানুষ হিসেবে একজন নারী বা পুরুষ অবশ্যই তার ইচ্ছেমাফিক পোশাক পরতে পারেন। এটা তার অধিকার এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার ব্যাপার। তবে তিনি কীভাবে এ অধিকার এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রয়োগ করছেন, সেটা বিবেচনার বিষয়। যেমন, আপনি প্রকাশ্যে কোনও মূল্যবান জিনিস প্রদর্শন করে নিয়ে যেতেই পারেন। এটা আপনার নাগরিক অধিকার। সেসঙ্গে আপনার সেই নিরাপত্তার মাধ্যমে গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আপনার সচেতনতা এবং দায়িত্ব। এখন কোনও কারণে নিরাপত্তাজনিত সমস্যায় আপনি যদি মূল্যবান জিনিসটি হারিয়ে ফেলেন, তা হলে রাষ্ট্র যেমন দায়ী হবে তেমনই সচেতনতার অভাবে আপনিও কম দায়ী হবেন না। তখন যদি আপনি একতরফাভাবে রাষ্ট্রকে দায়ী করেন, তা হলে সেটা খুব বেশি গ্রহণযোগ্য হবে না। আমি মনে করি, পোশাক, আচরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে শালীনতার যে বিষয়টি বারবার বলা হচ্ছে তা মূলত শুধু কোনও এক পক্ষের জন্য নির্দিষ্ট নয়। বরং শালীনতা একটি সর্বজনীন ব্যাপার।

বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ বেশি সংখ্যক ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ্যে আসার সুযোগ পায় না। লোকলজ্জার ভয়ে অথবা ছেলেপক্ষের দেনা-পাওনার ভয়ে বা পুলিশের দাবি মেটানোর শক্তির অভাবে সেগুলো গোপনে চাপা পড়ে যায়। এভাবেই আমাদের সমাজে নারীরা অহরহ নিষ্পেষিত-নির্যাতিত হচ্ছেন। আমরা দিব্যি উন্নয়নের বয়ান গাইছি। যদি আমরা বিগত পাঁচ বা দশ বছরে কত হাজার মামলা পুলিশের খাতায় রেকর্ড হয়েছে দেখতে চাই, সে তথ্য সবিস্তারে হয়তো পেতে পারি। কতগুলো মামলার তদন্ত শেষ হওয়ার পর বিচারকার্য শেষ হয়েছে, সে তথ্য কিন্তু কেউ খোঁজ করি না। এ পর্যায়ে আদালতে দুই ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। এক, বিচার শেষে আসামিদের কঠোর শাস্তি এবং দুই, আসামিদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে তারা বেকসুর খালাস। তাই এ দুটি তথ্য পেলে হয়তো আমরা আরও আঁতকে উঠব। কারণ, দেখা যেতে পারে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধীরা খালাস পেয়ে গেছে সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে, অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায়। সেক্ষেত্রে ধর্ষিতাদের অবস্থা কেমন দাঁড়ায়? নতুন করে তাদের জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এটা বলছি এ কারণে, ধর্ষণের ক্ষেত্রে, গণধর্ষণ ছাড়া, আদৌ কোনও সাক্ষী তো থাকে না, বিশেষ করে প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষী। দ্বিতীয়ত, আমাদের সাক্ষ্য আইনটাও কিন্তু ধর্ষিত নারীর অনুকূলে কতটা তারও নতুন করে ভাবাটা অত্যন্ত জরুরি। আমরা যদি বাংলাদেশে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের চিত্র দেখি, তা হলে দেখব, প্রতি ১৫৫ মিনিটে ১৬ বছরের কম বয়সি একটি শিশু ধর্ষিত হয়, প্রতি ১৩ ঘণ্টায় ধর্ষিত হয় দশ বছরের কম বয়সি একটি শিশু। ২০১৫ সালে বাংলাদেশে ধর্ষিত হয় দশ হাজারের বেশি শিশু। লাখ লাখ নারীর বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে। বাংলাদেশ সরকারের এক সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৫৩.২২ শতাংশ শিশু বলেছে, তারা কোনও না কোনও ধরনের যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রেই যৌন নির্যাতনকারীরা শিশুদের পূর্বপরিচিত কেউ, যাদের তারা বিশ্বাস করে।