ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বজ্রপাত প্রাকৃতিক এক নীরব দুর্যোগ

সতর্ক থাকলে মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব
বজ্রপাত প্রাকৃতিক এক নীরব দুর্যোগ

এক মাসের দাবদাহের পর দেশের কয়েক জেলায় দেখা মিলেছে স্বস্তির বৃষ্টি। তীব্র দাবদাহের মধ্যে গত বুধবার রাত ও বৃহস্পতিবার ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের কয়েকটি স্থানে স্বস্তির বৃষ্টি নেমেছে। এতে এসব এলাকায় তাপমাত্রা কিছুটা কমে আসে। টানা ১ মাস তীব্র তাপপ্রবাহের পর বৃষ্টির দেখা পেয়ে মানুষের মধ্যে প্রশান্তি নেমে আসে। অনেকে প্রাণ খুলে ভিজে বৃষ্টিতে। তবে এ সময় কুমিল্লা, সিলেট, রাঙামাটি ও কক্সবাজারের পেকুয়ায় বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ১০ জন। দেশের উষ্ণতম এপ্রিল মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে গড়ে ৮১ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে। রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলোতে পুরো মাসে ১ দিনের জন্যও বৃষ্টি হয়নি। সারা দেশ বিবেচনায় গড় বৃষ্টিপাত ছিল মাত্র ৩ দিন। ওই মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা ১৩ দিন। স্বাভাবিক বৃষ্টি না হওয়ায় দেশজুড়েই ছিল টানা তাপপ্রবাহ। পুরো মাসে গড় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। ১-১৯ এপ্রিল মাঝারি এবং ২০-৩০ এপ্রিল তীব্র থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ কমিটির পর্যালোচনায় এসব তথ্য উঠে আসে। গত বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে রাজধানীর পুরান ঢাকার সদরঘাট, সূত্রাপুর, ইসলামপুরসহ আশপাশের একাধিক এলাকায় বৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে মুগদা ও মাণ্ডা এলাকায়ও হালকা বৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ীসহ রাজধানীর বেশকিছু এলাকায় এক পশলা বৃষ্টি হয়। রাত ১১টার পর থেকে বনানী, গুলশান, মিরপুর, কুড়িল মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় বজ্রের ঝলকানিতে আলোকিত হয়ে ওঠে আকাশ। এরপর মুষলধারায় বৃষ্টি হয়। এতে নগরে শীতল অনুভব হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ বাংলাদেশ। ভৌগোলিক অবস্থান ও জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে ঝড়, বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস এদেশের নিত্যসঙ্গী। প্রতিবছর অসংখ্য মানুষের মৃত্যু এবং বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত ক্ষতির কারণ এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কিন্তু এসবের সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যোগ হয়েছে এবং এটি হচ্ছে বজ্রপাত। প্রতি বছর অসংখ্য মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে নীরবে। যেটা নিয়ে আমরা খুব বেশি ভাবি না। সারা পৃথিবীতেই বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বজ্রপাতের প্রবণতা বেশি। তার মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। দিনে দিনে বজ্রপাত ভয়ংকর রূপ ধারণ করায় বাংলাদেশ সরকার ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চলকে বজ্রপাত প্রবণ এলাকা হিসাবে চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশে এপ্রিল, মে, জুন মাসে সাধারণত বজ্রপাত বেশি হয়ে থাকে। সারা বছরের মধ্যে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বেশি থাকে ফলে বজ্রপাতের সম্ভাবনাময় পরিস্থিতি বেশি তৈরি হয় এই সময়ে। জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষ করে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি এই প্রাকৃতিক দুর্যোগটিকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিচ্ছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত ৫০ বছরে দেশে তাপমাত্রার বৃদ্ধির হার দশমিক পাঁচ শতাংশ। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বজ্রপাত তৈরির পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। তাদের মতে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে বজ্রপাতের সম্ভাবনা প্রায় ১২ শতাংশ বেড়ে যায়। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেও বাংলাদেশে এই দুর্যোগটি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগর আর উত্তরে রয়েছে হিমালয় পর্বতমালা। ফলে উষ্ণ ও ঠান্ডা বাতাসের সংমিশ্রণ ঘটছে যা বজ্রপাতের পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক। ভূমিকম্পের মতো বজ্রপাতের পূর্বাভাসও আগে থেকে জানা যায় না। ফলে দিনে দিনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছেই। বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশে কৃষকরা। কারণ তারা খোলা মাঠে কাজ করে থাকে। খোলা মাঠে তাদের চেয়ে উঁচু কিছু থাকে না। তাল গাছসহ বড় ও উঁচু গাছগুলো বজ্র নিরোধক হিসাবে কাজ করে। আমরা এই গাছগুলো কেটে ফেলছি, যার কারণে মৃত্যু ও আহতের সংখ্যাটা বাড়ছে। আবার সারাদিন সূর্যের তাপে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় সকালে চেয়ে বিকালের ঝড়ে বজ্রপাত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তাদের আবহাওয়ার উপযোগী করে প্রয়োজন মতো বিভিন্ন বজ্রনিরোধক যন্ত্র বা ব্যবস্থা তৈরির পর তা ব্যবহার করে আসছে। সবচেয়ে শক্তিশালী বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয় উড়োজাহাজে। এরইমধ্যে বিদেশ থেকে ব্যয়বহুল বজ্রপাত সৃষ্টিকারী মেঘ শনাক্তের জন্য ‘রাডার’ ও বজ্রপাত শনাক্তের জন্য ‘লাইটনিং ডিটেক্টর’ যন্ত্র আমদানি করে দেশের কয়েকটি অঞ্চলে স্থাপন করা হয়েছে। রাডার দিয়ে বজ্রপাত সৃষ্টিকারী মেঘ শনাক্ত করে পূর্বাভাস দেওয়ার ব্যবস্থা করার চেষ্টা চলছে। অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে সেই পূর্বাভাস পাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আরেক যন্ত্র ‘লাইটনিং ডিটেক্টর’ দিয়ে বজ্রপাত হয়েছে কি না তা জানার চেষ্টা চলছে। উঁচু উঁচু ভবনসহ শিল্প-কারখানাগুলোতে বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র বসানো বাধ্যতামূলক করেছে সরকার।

এছাড়া সারা দেশে ১০ লাখ তালগাছ রোপণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তালগাছ বজ্রপাতকে খুব সহজে এবং কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করতে পারে। তবে সঠিকভাবে তালবীজ রোপণও একটি চ্যালেঞ্জ। সব এলাকায় বিশেষ করে হাওর এলাকা বছরের অর্ধেক সময় পানিতে ডুবে থাকে। সেখানে তালগাছ সময় লাগবে অন্তত ২০ বছর। তাই উচিত গবেষণার মাধ্যমে দ্রুত বজ্রপাত নিরোধক বিভিন্ন যন্ত্র আবিষ্কার করা, যেগুলো খুব সহজেই কৃষক ব্যবহার করতে পারবে। তাল ছাড়াও বড় গাছপালা বিশেষ করে নারিকেল, সুপারি গাছ পর্যাপ্ত পরিমাণে রোপণ করতে হবে। বাংলাদেশে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মারা যায় কৃষকরা। কারণ তারা ফাঁকা জমিতে কাজ করেন। অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করার সামর্থ্য দেশের অধিকাংশ কৃষকের নেই। কারো সামর্থ্য থাকলেও সে সময় তিনি তা ব্যবহার করতে পারবেন কি না, সেটাও বিবেচনার বিষয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে বজ্রপাত প্রতিরোধের এখন পর্যন্ত কোনো উপায় আবিষ্কার না হলেও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার মাধ্যমে প্রাণহানির আশঙ্কা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। অনুশীলনের মাধ্যমে এই অভ্যাসগুলো রপ্ত করার মাধ্যমে বিপদ কমিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি আমাদের নিয়মিত জীবন-ধারণে সচেতন হতে হবে, যাতে আমাদের কর্মকাণ্ড জলবায়ু পরিবর্তনে বা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা না রাখে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত