কেবল আশ্রিতদের নিয়েই ভাবুন

মিল্টনের অপরাধের বিরুদ্ধে থাকতে হবে আপসহীন

প্রকাশ : ০৫ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মানবতার ফেরিওয়ালা সেজে মিল্টন সমাদ্দার নামে একজন সমাজসেবি মানুষের মধ্যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। তিনি নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়ে এখন আইনের আশ্রয়ে রয়েছেন। দীর্ঘদিন তিনি এই ধরনের মানবিক কাজের আড়ালে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িত করেছেন এটা বুঝতে অনেক সময় লেগেছে।

গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ পাওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তৎপর হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে আমাদের দেশে নাকি গোয়েন্দা জাল অনেক বিস্তৃত। তবে এমন সব অপরাধ শনাক্ত করতে গণমাধ্যমের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে কেন সেই প্রশ্নও আসতে পারে। মিল্টন সমাদ্দার দৃশ্যত যেসব কাজ করেছেন, সেটা দিব্যচোখে দেখলে অনেক মহৎ। তবে তার আড়ালে তিনি যে কাজ করেছেন তা অত্যন্ত জঘন্ন। মিল্টন সমাদ্দারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা যেসব অসহায় নারী, শিশু ও বৃদ্ধ সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের তো অপরাধ নেই। কেন না, তাদের দায়িত্ব এই সমাজ ও রাষ্ট্র নেয়নি। প্রতিটি মানুষের খাবার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র যখন ব্যর্থ হয় তখন এগিয়ে আসে সমাজের হৃদয়বান মানুষ। কিন্তু এসব হৃদয়বান মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি যদি মানবতাবিরোধী হয়, তাহলে সেই খবর তো সাধারণ মানুষের জানার কথা নয়। মিল্টন সমাদ্দার এমন অপরাধ জগতে পা রাখবেন, সেটা কেউ কোনো দিন কল্পনা করেছে কি না জানি না। মানুষ সাদা চোখে তাকে একজন মহৎপ্রাণ মানুষ হিসেবে দেখেছে। অনেকে তার ভক্ত হিসেবে নাম লিখিয়েছে। অসহায় মানুষ মিল্টন সমাদ্দারের আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাই পেয়েছে। মিল্টন সমাদ্দার প্রায় একদশক ধরে ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ নামের আশ্রয় কেন্দ্রটিতে অসহায় নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের আশ্রয়, চিকিৎসাসেবা ও মৃত্যুর পর দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করে আসছিলেন। তবে এই মানবসেবার আড়ালে প্রতারণার মাধ্যমে মৃত্যুর জাল সনদ তৈরিসহ নানান অনিয়মের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশের পর গত ১ মে রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এরপর নানামুখী সংকটে পড়েছে আশ্রয়কেন্দ্রটির বাসিন্দারা। তাদের প্রতিদিনের খাবার জোগান দিতেই হিমশিম খাচ্ছেন আশ্রয়কেন্দ্রের কর্মচারীরা। অচল নারী, শিশু ও বৃদ্ধ মানুষগুলো নিয়ে বাড়ছে দুশ্চিন্তা। মিল্টন সমাদ্দার অপরাধী এটা মেনে নিয়েই বলা যেতে পারে, আশ্রিত মানুষগুলোও তো আর অপরাধী নন। ভাগ্যের নির্মমতায় তারা সেখানে আশ্রয় পেয়েছে। তাদেরও তো বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। প্রশ্ন উঠছে তারা কিভাবে প্রাণে রক্ষা পাবেন। কোনো দানশীল ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান এখনো তাদের এসব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ায়নি। আমাদের সমাজসেবা অধিদপ্তর সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তারা ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠা কোনো প্রতিষ্ঠানের বাসিন্দাদের দায়িত্ব নিতে পারবে না। তাহলে কারা নেবে সেই প্রশ্নও উঠছে। রাজধানীর মিরপুরের দারুস সালাম এলাকার কল্যাণপুর নতুন বাজার রোডে অবস্থিত আলোচিত ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারে’ চিকিৎসার সরঞ্জাম ও খাদ্য সংকটের মুখে পড়েছেন আশ্রয় কেন্দ্রের শিশু, মহিলা ও বৃদ্ধসহ সেবা গ্রহীতারা।

কর্মীদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে নানান অনিশ্চয়তা। এমন অবস্থায় আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা এই অসহায় মানুষগুলোর কী হবে, কীভাবে চলবে তাদের সেবা, কে চালাবে এই আশ্রয় কেন্দ্র এ নিয়ে নানা সংশয় দেখা দিয়েছে সমাজকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যে। আশ্রমে খাবার সঙ্গে ফুরিয়ে গেছে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধপত্র। শিশু, নারী ও বৃদ্ধ মিলে প্রায় ২৮ জন অসহায় মানুষ রয়েছে মিল্টনের এই আশ্রমে। এছাড়াও বাবুর্চি, সেবক-সেবিকা ও নিরাপত্তা রক্ষীসহ আছেন ২৫ জন কর্মী। ঝামেলা এড়াতে এরই মধ্যে কয়েকজন কর্মী আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে চলেও গেছেন বলে জানা গেছে। সমাজ সচেতন মানুষ বলছেন মিল্টনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে সেগুলো কতটা সত্য, তা তদন্তের পর জানা যাবে। তবে এই আশ্রয়কেন্দ্র থেকে অনেক অসহায় মানুষ সেবা পেয়েছে। এসব মানুষকে পুলিশ, সমাজসেবা অধিদপ্তর বা কোনো সংস্থা সেবা দেয়নি। শরীরের বিভিন্ন অংশ পচে রাস্তায় পড়ে থাকা সেই মানুষগুলোকে এই আশ্রমে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। সেখানে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। তাহলে এই অসহায় মানুষদের কী হবে। তাদের দেখবে কে!’ মিল্টনের মামলার তদন্তকারী সংস্থা কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে এই আশ্রয়কেন্দ্রটি পরিচালনার দাবি উঠেছে। মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে মিরপুর মডেল থানায় মানবপাচার, জাল মৃত্যুসনদ ও আটকে রেখে মারধরের অভিযোগে তিনটি মামলা করা হয়েছে। ডিবি পুলিশের হেফাজতে নেয়া হয়েছে। সমাজ বিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন সামাজিক ও মানবিক কার্যক্রমের আড়ালে যারা অপরাধ কর্মকাণ্ড করে, তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধেও অনেক ভয়ংকর অভিযোগ আসছে। তদন্তে তার প্রকৃত অপরাধ চিত্র বেরিয়ে আসবে। তবে তার আশ্রয়কেন্দ্র বা আশ্রয়কেন্দ্রের অসহায় মানুষগুলোর সেবায় কারো না কারো দায়িত্ব নিতে হবে। সামাজিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার করার ক্ষেত্রে সরকারের নীতিমালা আছে। সমাজসেবা অধিদপ্তর আছে তারাও এগিয়ে আসতে পারে। তবে সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন ‘আমরা সরকারি প্রতিষ্ঠান ও এতিমখানাগুলোতে দেখভাল করে থাকি। বেসরকারি সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো তারাই দেখে থাকে। তাছাড়া যদি সমাজসেবা অধিদপ্তরের রেজিস্ট্রেশনভুক্ত সংস্থার কোনো সমস্যা হয়ে থাকে, তাহলে আমরা পরিচালনায় সহায়তা করার জন্য প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারি। তবে আইনের ভাষা যেটাই হোক, মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেয়া হোক, সেটা বড় কথা নয়। অসহায় মানুষের প্রতি মানবিক দৃষ্টি দিয়ে তাদের প্রাণ রক্ষায় সমাজ বা রাষ্ট্রের কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতে হবে।