ফুল চাষে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

অলোক আচার্য

প্রকাশ : ০৬ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

জোটে যদি মোটে একটি পয়সা/খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি/ দুটি যদি জোটে অর্ধেক তার/ফুল কিনিয়ো হে অনুরাগী। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এই বিখ্যাত কবিতার স্তবক ফুলের প্রতি মানুষের ভালোবাসা প্রকাশ করে। ফুল পবিত্রতার প্রতীক। পৃথিবীতে ফুল ভালোবাসে না এমন একজন মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ফুল শুদ্ধতার প্রতীক। ফুল ভালোবাসার প্রতীক। প্রকৃতির চারপাশে নানা জাতের ফুল ফোটে। সব ফুলই মানুষের অন্তরে প্রশান্তি আনে। গোলাপ, রজনীগন্ধা, চন্দ্রমল্লিকা, বেলি, হাসনাহেনা, গাঁদা ইত্যাদি পরিচিত ফুলের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি ফুলও এখন দেশের মাটিতে ফোটে।

বিদেশি ফুলের মধ্যে চাহিদার প্রথমেই রয়েছে দৃষ্টিনন্দন টিউলিপ ফুল। তবে বিক্রির দিক থেকে গোলাপ সবার আগে। ফুলের রানি বলে কথা! এ ছাড়া ফুলের দোকানে গ্লাডিওলাস, জিপসি, চায়না গোলাপ, কসমস, চেরিসহ আরো কয়েক জাতের ফুল বিক্রি হতে দেখা যায়। সারাবছরই মোটামুটি ফুল বিক্রি হয়। দিবস ছাড়াও বিয়ে, জন্মদিন, পার্টি বা কোনো আনন্দ আয়োজনে ফুল বিক্রি হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন দিবস তো লেগেই থাকে। রাজনৈতিক প্রোগ্রাম ও অন্যান্য অনুষ্ঠান ফুল ছাড়া অচল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাই বাড়ছে ফুলের চাহিদা। একসময় ফুল শুধু সৌখিন মানুষের বাগানে বা টবে চাষ হতো। নেহায়েত শখ করেই ফুলগাছ রোপণ করত। সেই শখ এখন অর্থ উপার্জনেরও পথ তৈরি করেছে। অর্থাৎ ফুল এখন একটি অর্থকরী ফসল। এখান থেকে দেশের অর্থনীতিতে অবদান বাড়ছে।

দেশের গন্ডি পার দিয়ে ফুল যাচ্ছে বিদেশেও। ফুল বিক্রি প্রসারিত হওয়ায় সারা দেশে ফুলের দোকানের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেদিক থেকে এর মূল্য অর্থকড়ি দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু বর্তমানে এর ব্যবসায়িক মূল্য এবং গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফুলের বাজার ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম ফুল চাষ ও বিপণনে ঝঁকুছেন। বিদেশেও রয়েছে বিশাল ফুলের বাজার। যার চাহিদা মেটাতে সক্ষম হলে আরো বেশি অর্থনীতিতে অবদান রাখা সম্ভব হবে। একটি পরিপূর্ণ শিল্প হিসেবে ফুলশিল্প গড়ে তুলতে হবে। দেশি-বিদেশি নানা জাতের ফুল বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। বসন্ত এলেই ফুলের বাজার চাঙা হয়ে ওঠে। এছাড়া বিভিন্ন দিবসে ফুলের ব্যবহার বাড়ছে। আজকাল পাড়া-মহল্লাতেও গড়ে উঠেছে ফুলের দোকান। ফুল বিক্রি করেই চলছে বহু মানুষের জীবন ও জীবিকা। সে কারণেই ফুল এখন একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে। কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) থেকে পাওয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভিত্তিতে ফুল উৎপাদনের শুভসূচনা হয় ১৯৮৩ সালে যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা গ্রামে। সে সময়ে একজন ফুল অনুরাগী উদ্যোগী কৃষক শের আলী মাত্র শূন্য দশমিক ৮৩ ডেসিম্যাল জমিতে ফুল চাষ শুরু করেন। আজ বাংলাদেশের ২৪টি জেলায় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভিত্তিতে ফুলের চাষ হচ্ছে। ফুল উৎপাদনে জড়িত আছেন প্রায় ১৫ হাজার কৃষক এবং ফুল উৎপাদন ও বিপণন ব্যবসায়ে অন্তত ১ দশমিক ৫০ লাখ মানুষ সরাসরি নিয়োজিত রয়েছেন। ফুল সেক্টরের কার্যক্রমের মাধ্যমে জীবিকা উপার্জন করছেন প্রায় ৭ লাখ মানুষ। বর্তমানে দেশের ২৪টি জেলায় প্রায় ৩ হাজার ৫২০ হেক্টর জমিতে ফুলের উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে খুলনা বিভাগে সর্বোচ্চ ২৬০০ হেক্টর (৭৪ শতাংশ) জমিতে ফুলের চাষ হয়। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ঢাকা বিভাগ ৬৯০ হেক্টর (২০ শতাংশ) এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছে, চট্টগ্রাম বিভাগ ১২১ হেক্টর (৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ)। এছাড়া রংপুর বিভাগে ৪২ হেক্টর (শূন্য দশমিক ২৯ শতাংশ)। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে মূল উৎপাদনের প্রায় ১৫ হাজার হাজার কৃষক জড়িত। তাদের মধ্যে খুলনা বিভাগে ১১ হাজার ২৫০ জন (৭৫ শতাংশ), ঢাকা বিভাগে ৩ হাজার জন (২০ শতাংশ)। বাকি পাঁচ শতাংশ কৃষক রংপুর, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ বিভাগে ফুল চাষে নিয়োজিত। বিভিন্ন জাতের ফুল উৎপাদনের হিসেবে দেখা যায়, সর্বোচ্চ উৎপাদন হয় গ্লাডিওলাস ৯ হাজার ৯১৪ টন, যার টাকার মূল্য মার্কেট শেয়ার ৩১ শতাংশ। এরপর পর্যায়ক্রমে রয়েছে গোলাপ ১১ হাজার ১৩২ টন (২৪ শতাংশ), রজনীগন্ধা ১০ হাজার ৮১৪ টন (১৭ শতাংশ), ম্যারিগোল্ড ১২ হাজার ৬২৪ টন (আট শতাংশ) অন্যান্য ফুলের মার্কেট শেয়ার মোট ২০ শতাংশ। বার্ষিক হিসাবে ২০১৪-১৫ সালে ফুল উৎপাদন হয়েছে ৫৭ হাজার টন এবং বিক্রয়লব্ধ টাকা হচ্ছে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ আয় হয় গ্লাডিওলাস থেকে প্রায় ২২৩ কোটি টাকা। তারপর গোলাপ ১৭০ কোটি, রজনীগন্ধা ১৩৩ কোটি, মেরিগোল্ড ৫৭ কোটি এবং অন্যান্য ফুল থেকে প্রায় ১৫০ কোটি। একটি গবেষণা বলছে, সারা বিশ্বে ৩৬ বিলিয়ন ডলারের ফুলের বাজার রয়েছে। এর মধ্যে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বাজার ধরার মতো সুযোগ আছে আমাদের দেশের। এই সুযোগ এখনই কাজে লাগিয়ে অর্থনীতিকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় এসেছে। আমাদের এই ফুল মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, ব্রিটেন, পাকিস্তান, ভারত, ইতালি, চীন, সিঙ্গাপুর, রাশিয়া ও ফ্রান্সে রপ্তানি হচ্ছে। গত কয়েক দশকে বদলে গেছে ফুলের বাজার।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সূত্র মতে, ২০০৫ সালে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪০০ কোটি টাকার। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ফুল রপ্তানি হয়েছিল ২৭৬ কোটি ৯ লাখ টাকার, ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৩২৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকার ও ২০১০-১১ সালে ৩২৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকার ফুল রপ্তানি হয়েছিল। ২০১৩ সালে কাঁচাফুল রপ্তানি করে আয় হয়েছিল ১৬ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন ডলার। এখন সেই বাজার আরো বিস্তৃত হয়েছে। জানা গেছে, ফুল চাষ, পরিবহন ও বিক্রি সবকিছুর সঙ্গে প্রায় ২০ লাখ মানুষ জড়িত। এখান থেকেই বোঝা যায়, ফুল একসময় মানুষের শুধু মনের খোরাক যোগাত এখন তা রীতিমতো পেটের খোরাক জোগাচ্ছে। ভবিষ্যতে যে এই খাত আরো বেশি এগিয়ে যাবে, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। কারণ দিন দিন ফুলের বাজার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফুল চাষ থেকে দোকানে ফুল পৌঁছানো পর্যন্ত অসংখ্য মানুষ জড়িত। পবিত্রতার প্রতীক ফুলের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে মানুষের প্রেম থেকে ক্ষুধা মেটানো। পৃথিবীতে করোনা শুরুর পর ফুলের বাজারে তার প্রভাব পরে। তারপর ধীরে ধীরে সে পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে থাকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএসের হিসাবে, ২০২২ সালে ৩২ হাজার টনের বেশি ফুল ফুটেছে আমাদের দেশে। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার্স সোসাইটির তথ্য বলছে, আমাদের দেশে দেড় হাজার কোটি টাকার ফুলের বাজার রয়েছে। একসময় গাঁদা, গোলাপ চাষ হলেও এখন ১৫-১৬ ধরনের ফুলের চাষ হচ্ছে আমাদের দেশে। আর বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার্স সোসাইটির তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে দেড় হাজার কোটি টাকার ফুলের বাজার রয়েছে। আর ফুল প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে যুক্ত সহশিল্পের ব্যবসা ধরলে তা প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা হবে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, অন্যান্য বছরের ফেব্রুয়ারির ১৫০ কোটি টাকার ফুলের বাজার এবার ৫০০ কোটিতে পৌঁছাবে বলে আশা ফুলের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়িদের।

আমাদের দেশ থেকে ফুল মধ্যপ্রাচ্যসহ মালয়েশিয়া, নেদারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, পাকিস্তানসহ আরো কয়েকটি দেশে রপ্তানি করা হয়। ফেব্রুয়ারিতে প্রোপজ ডে, রোজ ডে, ভালোবাসা দিবস ও পহেলা ফাল্গুন এবং একুশে ফেব্রুয়ারি ঘিরে প্রচুর ফুলের দরকার হয়। এক প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা যায়, বছরজুড়ে দেশে ফুলের বাজার ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার। এর মধ্যে জানুয়ারি-এপ্রিল সময়ে ফুলের মোট চাহিদার ৭৫ শতাংশ বিক্রি হয়। দেশের ফুলের চাহিদার বেশিরভাগ আসে যশোর ও ঝিনাইদহ জেলা থেকে। যশোরের গদাখালী তো ফুলের জন্যই ব্যপক পরিচিত এলাকা। এখানে এবছর বসন্তবরণ ও ভালোবাসা দিবস উপলক্ষ্যে ২৫ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছে। সারা দেশে এখান থেকে ফুলের একটি বড় অংশ সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া চুয়াডাঙ্গা, সাভার, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, রংপুর, চট্টগ্রাম, মেহেরপুর, বগুড়া, নাটোর, মানিকগঞ্জ, রাঙামাটি, টাঙ্গাইল ইত্যাদি জেলাগুলোতেও ফুলের চাষ করা হচ্ছে। ফুল চাষের পরিধি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের দেশে ফুল চাষ শুরু অবশ্য অনেকদিনের। জানা যায়, ৮০-এর দশকে বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে ফুলচাষ শুরু হয়। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সরকার ফুলকে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের তালিকায় আনে। তবে ফুল চাষ, সংরক্ষণ ও বিপণনে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান, উন্নতমানের বীজ সরবরাহ, প্রণোদনা প্রদান, প্রয়োজনীয় ওয়্যারহাউজ নির্মাণ ইত্যাদি কাজ করতে হবে। কারণ দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ফুল দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছাতে গিয়ে অনেক ফুল নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে বা নষ্ট হয়। আর ফুল এমন এক বস্তু যে একটু মলিন হলেই তা ক্রেতা নেয় না। ক্রেতা চায় তরতাজা ফুল। এতে আর্থিক ক্ষতি বৃদ্ধি পায়। তাই সংরক্ষণ আধুনিক ও পরিবহন ব্যবস্থা দ্রুততর করতে হবে। ফুলের বাজারের সঙ্গে এখন অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত। ফলে কৃষির এই খাতকে এগিয়ে নিতে হলে বিশেষ পরিকল্পনা, প্রণোদনা এবং গুরুত্বারোপ করতে হবে।