ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

যুগে যুগে যুক্তরাষ্ট্র পুলিশের বর্ণবাদী আচরণ

মো. জিল্লুর রহমান
যুগে যুগে যুক্তরাষ্ট্র পুলিশের বর্ণবাদী আচরণ

যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের বর্ণবাদী আচরণ নতুন নয়। ২০২০ সালে পুলিশি নির্যাতনে জর্জ ফ্লয়েড নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ মারা গিয়েছিল। সে সময় জর্জ ফ্লয়েড বলেছিল, ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না।’ তার সেই আকুতি বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় তুলেছিল। এবার ৫৩ বছরের ফ্র্যাঙ্ক টাইসন একই ধরনের আকুতি জানিয়েও বাঁচতে পারেননি। মার্কিন সংবাদমাধ্যমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের ক্যান্টনের একটি ক্লাবে এই বর্ণবাদী ঘটনা ঘটে। পুলিশের কাছে থাকা বডি ক্যামেরার ভিডিও থেকে দেখা গেছে, পুলিশ টাইসনকে মাটিতে ঠেসে ধরে তাঁর হাত পিছমোড়া করে বাঁধে। পরে সেখানে পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে গুরুতর আহত হন টাইসন। সেখান থেকে টাইসনকে হাসপাতালে নেওয়া হলেও তিনি মারা যান। এই ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যকে বেতনসহ বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত পুলিশের বডি-ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, ক্যান্টন পুলিশের এক কর্মকর্তা একটি সড়ক দুর্ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে অ্যামভেস্ট নামের একটি বারে ফ্র্যাঙ্ক টাইসনকে খুঁজে পান। গত ১৮ এপ্রিল রাত ৮টার দিকে এই দুর্ঘটনা ঘটে। এতে একটি বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে যায়। সেই ঘটনার তদন্তে যাওয়া পুলিশ কর্মকর্তাকে বারের বাইরে অবস্থিত এক মোটরসাইকেল আরোহী ইঙ্গিত দেন যে, দুর্ঘটনা ঘটানো ব্যক্তি বারের ভেতরে আছে। এক পুলিশ কর্মকর্তার বডি-ক্যামেরা ফুটেজে দেখা যায়, একজন মহিলা দরজা খুলে বলেন, ‘দয়া করে তাকে (ফ্র্যাঙ্ক টাইসন) এখনই এখান থেকে সরিয়ে নিন।’ এরপর পুলিশ বারের ভেতরে গিয়ে টাইসনকে পাকড়াও করার চেষ্টা করে। সে সময় টাইসন বারবার পুলিশকে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে একপর্যায়ে পুলিশ তাকে বারের মেঝেতে ঠেসে ধরে। এ সময় টাইসন বলতে থাকেন, ‘ওরা (পুলিশ) আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে, কেউ শেরিফকে ডাকো।’ পুলিশ সদস্যরা টাইসনকে তার পিঠের ওপর হাঁটু রেখে এবং দুই হাত চেপে ধরে মাটিতে ঠেসে রেখেছিল। এরপরই টাইসন পুলিশকে বলতে থাকেন, তিনি শ্বাস নিতে পারছেন না। সম্প্রতি সংবাদ সংস্থা এপির এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সে সময় টাইসন বলেছিলেন, ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না।’ একপর্যায়ে টাইসন অচেতন হয়ে পড়েন। সে সময় এক পুলিশ কর্মকর্তাকে বলতে শোনা যায়, টাইসন শান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু অপর পুলিশ কর্মকর্তা জবাব দেন, ‘সে সম্ভবত মারা গেছে।’ পরে পুলিশ কর্মকর্তারা দেখতে পান, টাইসন আর নড়াচড়া করছেন না। তখন তারা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের শুরু ষোড়শ শতকে। সেই সময় কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের দাস হিসেবে ব্যবহারের জন্য অ্যামেরিকায় নিয়ে যাওয়া শুরু হয়েছিল। এরপর প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানকে দাস হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়? অবশ্য সূচনালগ্ন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ ডিপার্টমেন্টগুলো ছিল চরম বর্ণবাদী। ১৯১১ সালে স্যামুয়েল ব্রেটন নামক একজন কৃষ্ণাঙ্গ নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টে নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও পরবর্তী সময়কালে সেই সংখ্যা ছিল অত্যন্ত নগণ্য। পরবর্তীতে নাগরিক অধিকার আইন, ১৯৬৪ পাশের মাধ্যমে চাকরি লাভের ক্ষেত্রে বর্ণবৈষম্য অনেকাংশে দূর করা গেলেও, কৃষ্ণাঙ্গরা সর্বক্ষেত্রে ছিল অবহেলিত। ১৯৭০ সালের পরবর্তীতে যেসব কৃষ্ণাঙ্গরা আমেরিকান পুলিশে সুযোগ পেয়েছিলেন, অবশ্য তারা নিজেরাই কৃষ্ণাঙ্গ কমিউনিটিতে ব্যাপক আগ্রাসন ও বর্বরতা চালিয়েছিল, কারণ তাদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল ডিপার্টমেন্টে তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করা। বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১২ শতাংশ আফ্রিকান আমেরিকান হলেও তারা জন্মগতভাবে কখনোই আমেরিকান ছিলেন না। ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপীয়রা দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যের অনাবাদী জমিচাষ করানোর জন্য আটল্যান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আফ্রিকানদের আমেরিকান ভূমিতে নিয়ে আসে। বর্তমান আমেরিকান শেতাঙ্গ জনগোষ্ঠির প্রায় সকল সদস্যই ইউরোপীয়, যারা কি না সত্যিকার বহিরাগত। শুধু রেড ইন্ডিয়ানরাই আমেরিকার প্রকৃত আদিবাসী। আফ্রিকান আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ ও শেতাঙ্গ পুলিশের মধ্যকার দ্বন্দ্ব বেগবান হয় গ্রেট মাইগ্রেশনের সময়কালে, যখন আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়গুলোতে দক্ষিণের গ্রামাঞ্চলগুলো হতে উত্তরের শহরাঞ্চলে পাড়ি জমায়। বিপুলসংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গদের উত্তরের অঙ্গরাজ্যগুলোতে আগমন শেতাঙ্গ কমিউনিটি ও শেতাঙ্গ পুলিশ ডিপার্টমেন্ট কখনোই ভালো চোখে নেয়নি। তাদের মধ্যে সর্বদা একটা ভ্রান্ত ধারণা কাজ করত যে, কৃষ্ণাঙ্গরা স্বভাবতই অপরাধপ্রবণ, অধিক আগ্রাসী ও ভীতিসঞ্চারক! যার ফলশ্রুতিতে কৃষ্ণাঙ্গদের উপর পুলিশি নজরদারী অধিক করার পাশাপাশি তাদের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত