ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সুন্দরবনে ফের সর্বনাশা আগুন

সুপারিশ বাস্তবায়নের অভাবে বার বার ঘটছে অগ্নিকাণ্ড
সুন্দরবনে ফের সর্বনাশা আগুন

আবারো সুন্দরবনে আগুন। দাউ দাউ করে আগুনে পুড়ছে মানুষের অক্সিজেনের ভান্ডার। বার বার আগুনে সুন্দরবন পোড়ার পরও যদি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না যায়, তাহলে সেটা দুঃখজনক। সুন্দরবন আমাদের দেশের জন্য রক্ষাকবজ। সুন্দরবন না থাকলে বিভিন্ন সময়ে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস কিংবা সিডরের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ই সুন্দরবনের গুরুত্ব অনুধাবন করা গেছে। সুন্দরবন না থাকলে আমাদের জন্য কি ধরনের বিপর্যয় অপেক্ষা করছে, তা নিয়ে কিছুটা হলেও ভাবতে হবে। সুন্দরবনের প্রাণী-প্রকৃতিকে বাঁচাতে হবে। সুন্দরবনে আগুন লাগার বিষয়টিতে হালকাভাবে নেয়া ঠিক হবে না। সুন্দরবন বিগত ২২ বছরে অন্তত ২৫ বার আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়েছে। এটা অস্বাভাবিক। প্রতিবারই হয়তো তদন্ত কমিটি হয়েছে। কমিটির সুপারিশের বাস্তবায়ন করা হলে এতবার আগুন লাগত না। সুপারিশ যদি বাস্তবায়নই করা না হয়, তাহলে কমিটি করে কী লাভ?

মানুষকে ফাঁকি দিয়ে তো চিরদিন নিজেকে বাঁচানো যাবে না। অপরাধীকে আইনের আদালতে না হলেও একদিন না একদিন জনতার আদালতে দাঁড়াতে হবে। সর্বশেষ গত শনিবার বিকাল পৌনে ৩টায় সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের আমরবুনিয়া এলাকায় আগুন লাগে। গতকাল সকাল ৮টায় ফায়ার সার্ভিসের ৩টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। পুলিশ, উপজেলা প্রশাসন, বনরক্ষী ও স্থানীয় বাসিন্দারা অংশগ্রহণ করে বনরক্ষার কাজে। সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মুহাম্মদ নুরুল করিম জানান, সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের আমরবুনিয়া এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে তিন সদস্যের ওই কমিটিকে ৭ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। আগুন নিভোনোর পর তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করবে। সুন্দরবনের অগ্নিকাণ্ডের অধিকাংশ ঘটনাই ঘটেছে বনের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে। খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জে কখনো আগুন লাগেনি। প্রতিবার আগুন লাগার কারণ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও পরবর্তী সময়ে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে তদন্ত কমিটি গঠন করে বনবিভাগ। তদন্ত কমিটি নির্দিষ্ট সময়ে সুপারিশসহ প্রতিবেদন পেশ করে। তবে সেসব থেকে যায় ফাইলবন্দি। সেই সুপারিশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ৪০ কিলোমিটার খাল ও তিনটি পুকুর পুনঃখনন, আগুন লাগলে তা নিয়ন্ত্রণে বনবিভাগের জনবল বাড়ানো, বনরক্ষীদের টহল কার্যক্রম জোরদার, তিনটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার তৈরি, সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের ৩৫ কিলোমিটার এলাকায় নাইলনের দড়ি দিয়ে বেড়া নির্মাণ, রিভার ফায়ার স্টেশন নির্মাণ ও বনসংলগ্ন ভরাট হয়ে যাওয়া ভোলা নদী খনন করা। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আগুন লাগার কারণ হিসেবে মৌয়ালীদের ব্যবহৃত আগুনের কুণ্ডলী, জেলেদের সিগারেট, দাবদাহ, অনাবৃষ্টি, খরা, বন অপরাধে সাজাপ্রাপ্তদের প্রতিশোধমূলক আচরণ, দুষ্কৃতকারীদের দিয়ে বনের মধ্যে আগুন ধরানোকে দায়ী করা হয়। আগুনের স্থায়িত্বের কারণ হিসেবে বিভিন্ন গাছের পাতার পুরু স্তরকেও দায়ী করেছে তদন্ত কমিটি।

সুন্দরবন বনবিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০২ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে এ নিয়ে ২৫ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটল। বনবিভাগের হিসাব মতে, বিগত ২৪ বারের আগুনে ৭১ একর ৬৬ শতাংশ বনভূমির ক্ষতি হয়। এর আর্থিক মূল্য ১৮ লাখ ৫৫ হাজার ৫৩৩ টাকা। বিশেষজ্ঞদের ধারণা করা হয়, মৌয়ালদের মশালের কারণে সুন্দরবনে আগুন লেগে থাকতে পারে। অথবা কারো বিড়ি সিগারেটের আগুন ফেলে রাখা থেকে আগুন ধরতে পারে। তুলনামূলক বনের যেসব এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, সেসব এলাকা অনেক উঁচু। গ্রীষ্ম মৌসুম চলায় অনেকদিন বৃষ্টি না হওয়া ও শুকনো পাতা জমে যাওয়ার কারণে আগুন অনেকক্ষণ ধরে জ্বলতে থাকে। বনবিভাগের আগুন লাগলে তাৎক্ষণিক সাড়া দেয়ার মতো যন্ত্রপাতি ও জনবল নেই। ফলে স্থানীয় ফায়ার স্টেশন ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পৌঁছতে আগুন বহুদূর ছড়িয়ে যায়। এতে বনে ক্ষতি হয় বেশি।

সুন্দরবন গবেষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ আজিজ জানান, সুন্দরবনের যে জায়গায় আগুন লেগেছে জায়গাটি তুলনামূলকভাবে উঁচু। ফলে এলাকায় জোয়ারের পানি সাধারণত ওঠে না। এতে করে সেখানকার বনতল সব সময় শুকনো থাকে এবং পাতা পড়ে আগুন লাগার একটা ঝুঁকি তৈরি হয়। এর আগেও আমরা এখানে আগুন লাগার ঘটনা দেখেছি। আর আগুন লাগলে যেমন বনের ক্ষতি, তেমনি বন্যপ্রাণীর উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সুন্দরবন একাডেমির পরিচালক ফারুক আহমেদের মতে, বলতে গেলে প্রায় প্রতিবছরই কম-বেশি সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। এতে পুড়ছে বন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বন্যপ্রাণী। বনবিভাগ সুন্দরবনের অগ্নিকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারেনি। এমনকি আগুন নেভানোর জন্য বনবিভাগকে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কোনো জনবল তৈরি করতে সক্ষম হয়নি। বন আইন বা বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ অনুযায়ী সংরক্ষিত বনাঞ্চলে আগুন দেওয়ার বিরুদ্ধে আইনি বিধান থাকলেও বিগত বছর এসব আইনে তেমন কেউ সাজা পায়নি। সুন্দরবন একটি জাতীয় সম্পদ হলেও সরকার বিষয়টিকে অধিক গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে না বলে অভিযোগ তোলেন তিনি। শরণখোলার সুন্দরবন সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম আকনের মতে, সুন্দরবনের যে এলাকায় আগুন লেগেছে ওই এলাকায় আশপাশে কোনো জনবসতি নেই। তবে বনের এই অংশে মধুর চাক রয়েছে। মৌয়ালদের যাতায়াত রয়েছে। তবে কীভাবে কি কারণে আগুন লেগেছে, তা এখন বলা সম্ভব না। পরিশেষে বলা যেতে পারে, সুন্দরবনে নতুন করে আগুন লেগেছে, নাকি কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে- সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত