ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে প্রয়োজন ‘সুখ’

প্রদীপ সাহা
সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে প্রয়োজন ‘সুখ’

সুখ জিনিসটি সত্যিই এক সোনার হরিণ। সবার জীবনে যেমন সুখ আসে না, তেমনি সুখ সবার জীবনে চিরস্থায়ীও হয় না। কারো জীবনে সুখ আসে, আবার হঠাৎ করে তা চলেও যায়। ‘সবাই তো সুখী হতে চায়, তবু কেউ সুখী হয় কেউ হয় না ...’ গানটি মনে করিয়ে দেয়, মানুষ চেষ্টা করেও অনেক সময় সুখকে ধরতে পারে না। আবার কারো জীবনে সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে বসে থাকে। ২০২৩ সালের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে জানা যায়, ফিনল্যান্ড হচ্ছে সবচেয়ে সুখী দেশ। পরপর ৬ বছর শীর্ষ অবস্থানে দেশটি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে ছিল ডেনমার্ক ও আইসল্যান্ড। চতুর্থ ইসরায়েল ও পঞ্চম নেদারল্যান্ডস। অন্যদিকে, সুখী দেশের তালিকায় সবচেয়ে নিচের অবস্থানে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান। ১৩৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১১৮তম অবস্থানে। প্রতিবছর ২০ মার্চ বিশ্ব সুখ দিবসে ‘সুখী দেশের তালিকা’ প্রকাশ করে জাতিসংঘ। সুখ পরিমাপের ধারণাটি এসেছে ভুটান থেকে। ২০১২ সাল থেকে প্রকাশ করা হয় ‘বিশ্ব সুখ সূচক’। প্রতিটি পরিবারে যেমন সুখী এবং অসুখী দু’ধরনেরই লোক থাকে, তেমনই প্রতিটি দেশেও সুখী এবং অসুখী দু’ধরনেরই লোক থাকে।

যারা নিজেকে সবসময় অসুখী মনে করেন, তারা অনেকেই মানসিক ডাক্তার ও মনস্তত্ত্ববিদের কাছে যান সাহায্যের জন্য। জার্মানির ডাসেলডর্ফের মনস্তত্ত্ববিদ আন্ড্রেয়াস সোলইয়ান বলেন, ‘তাদের কাছে এমন সব মানুষ আসেন, যারা কোনো কিছু হারানোর যন্ত্রণা ভোগ করছেন।’ সুখের প্রাচুর্যও অনেককে অসুখী করে তোলে। অল্প সময়ের মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ অনেক কিছু ঘটে গেলে মানসিক দিক দিয়ে অনেকে তাল সামলাতে পারে না। ভালো একটি কাজ পাওয়া, নতুন জীবনসঙ্গী পাওয়া, বিয়ে হওয়া, সুলভ মূল্যে একটি বাড়ি কেনার সুযোগ হওয়া- এসব স্বল্প সময়ের মধ্যে ঘটে গেলে বিহ্বল হয়ে যেতে পারে মানুষ; জেগে উঠতে পারে একটা মনমরা ভাব।

জার্মানির এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রোলান্ড উরবান মনে করেন, দুঃখের অনুভূতির ব্যাপারে একটা মিল দেখা যায় সব ক্ষেত্রে। এর কারণটার ওপর মানুষের হাত নেই। মানুষ এটিকে প্রভাবিত করতে পারে না। যেমন অসুস্থতা, আপনজনের মৃত্যু কিংবা অন্য কোনো ক্ষতি হওয়া। তবে মানুষের ভেতরের একটা নিরাময় ক্ষমতা দুঃখবোধকে কমিয়ে দিতে পারে। রোলান্ড উরবান বলেন, ‘ভুক্তভোগী যদি এমন কিছু খুঁজে পান যা তার জীবনে একটা পরিবর্তন আনতে পারে, তাহলে দুঃখবোধটাও অনেক কমে যায়।’ এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দেন তিনি। এক মহিলা তার স্বামীর মৃত্যুর পর শোকাভিভূত হয়ে পড়েন। কিন্তু ‘যখন থেকে তিনি পাশের বাড়ির এক অসহায় মহিলাকে সাহায্য করতে শুরু করেন, তখন থেকে নিজের দুঃখবোধও অনেকটা কমে যায়। সামাজিক কাজকর্ম, অন্যের প্রতি ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ মনটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়। দুঃখবোধকে মানসিক অসুস্থতার সঙ্গে তুলনা করা উচিত নয়। অসুখী বোধ করা একটি গভীর যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি। এটা কোনো অসুস্থতা নয়।

প্রশ্ন হলো সুখ কী? একে কি কোনো সংজ্ঞায় ফেলা যায়, কোথায় এর ঠিকানা, নাকি সুখ শুধুই সোনার হরিণ? ক্ষুধার্ত মানুষের খাওয়ার সুখ আর সঙ্গীতপ্রেমী কারো গান শোনার সুখ কি এক হতে পারে? এসব প্রশ্ন আদিকাল থেকেই মানুষের মনে উঁকি দিচ্ছে। ফলে সুখের তত্ত্ব তালাশ করতে গবেষকদের অনেক বেগ পেতে হয়েছে। সাহিত্য, সংগীত বা শিল্পকলায় সুখ নিয়ে আছে অঢেল উচ্চারণ এবং উপস্থাপন। তবে সুখের সঙ্গে অর্থের সম্পর্ক অস্বীকার করার উপায় নেই। রাশিয়ার সামাজিক মতামত গবেষণা কেন্দ্র এক তথ্যে জানিয়েছে, রাশিয়ার অর্ধেকের বেশি লোক নিজেদের সুখী মনে করেন এবং প্রতি বছরে তাদের দেশে সুখী লোকের সংখ্যা বাড়ছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রুশীদের মধ্যে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ লোক নিজেদের মনে করেন একেবারেই সুখী। বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে, এই ধরনের উঁচুমাত্রার কারণ প্রাথমিকভাবে বহু লোকই নিজেদের ভবিষ্যতের ওপর ভরসা করতে পারছেন। বিশেষজ্ঞরা মতে, সুখ হতে পারে তিনটি মুখ্য কারণের অনুপস্থিতিতে- যা মানুষের অনুভূতির ওপর প্রভাব বিস্তার করে। প্রথমত হচ্ছে আয়। নিঃস্ব বা দরিদ্র অবস্থায় সুখী হওয়া সত্যিই কঠিন, তা যতই আশাবাদী হোক না কেন। দ্বিতীয়ত হচ্ছে স্বাস্থ্য। আর তৃতীয়ত হচ্ছে বিশ্বের সঙ্গে এবং পাশাপাশি প্রতিবেশী, আত্মীয়, পরিচিত বা নিজের দেশের নাগরিকদের সঙ্গে নিজেকে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ থাকা।

কয়েক বছর আগে ব্রিটেনের ‘নিউ ইকোনমিক ফাউন্ডেশন’ নামের গবেষণা কেন্দ্র বিশ্ব সুখী সূচক বের করেছিল। ২০০৭ সালে এ কেন্দ্র থেকে প্রথমবার রেটিং পেশ করা হয়েছিল। তখন বিশ্বের এক দরিদ্রতম দেশ ভানুয়াতু (যা অস্ট্রেলিয়া থেকে পূর্বদিকে আছে), তারা সবচেয়ে সুখী বলে প্রমাণিত হয়েছিল। ব্রিটেনের লোকদের তৈরি সূচকে লাতিন আমেরিকা কয়েক বছর ধরেই নেতৃস্থানীয় হয়ে রয়েছে। ২০১৭ সালে তারা প্রথম দশের মধ্যে ৯টি জায়গাই পেয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে ছিল ভিয়েতনাম। এই কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞরা সব দেখেশুনে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, জাতির সত্যিকারের আত্মঅনুভূতির ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নতির সূচক অথবা উৎপাদনের উন্নয়ন ততটা প্রতিফলন করতে পারে না। দেখা গেছে, মানুষ সম্পদের কথা তত ভাবে না- ভাবে স্বাস্থ্য ও আনন্দ নিয়ে। গ্যালাপ কোম্পানীর তথ্যানুযায়ী, গত কয়েক বছরে বিশ্বে সুখী লোকের সংখ্যা শতকরা পঁচিশ ভাগ বেড়েছে। রাশিয়াতে শতকরা ৭৭ ভাগ মানুষ ভাবেন, সুখের প্রথম পরিমাপ স্বাস্থ্য দিয়ে করা উচিত। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সুখী বিবাহ ও ভবিষ্যতের বিষয়ে ভরসা। তারপরই আসছে আর্থিক সচ্ছতার কথা। জার্মানির নিউরো ও প্যাথো-সাইকলজি বিভাগের প্রধান নাতালিয়া জেরেভা বলেন, ‘মানুষ সারা জীবন সুখী থাকতে পারে না। জীবনে মানুষের কয়েকটা মুখ্য সংজ্ঞা রয়েছে, যা দিয়ে নিজেকে সুখী বা অসুখী বোঝা যায়।’

২০১০ সালে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও মনস্তত্ত্ববিদ ডানিয়েল কানেম্যান ও অ্যাঙ্গাস ডিটন বলেন, আয়ের সঙ্গে সুখ বাড়ে। কিন্তু আয় সেখানে মোটামুটি বছরে ৭৫ হাজার ডলারের ঘরে থাকতে হয়। অঙ্কটা আজকের বাজারে মোটামুটি লাখ ডলার। অবশ্য দেশের ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ এতটা আয়রোজগার করে না। আমরা তো অনেকে সেই গল্পটা জানি- এক ধনী ব্যক্তির অসুখ সারানোর জন্য নিদান দেওয়া হয়েছিল সুখী মানুষের জামা পরার। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একজন সুখী মানুষকে পাওয়া গেল। দেখা গেল, তার জামা নেই; তিনি সম্পদহীন। সে কারণেই তিনি সুখী। এ বছর বিশ্ব সুখ দিবসের প্রতিপাদ্য- ‘যূথবদ্ধ থাকাতেই সুখ’ অর্থাৎ একসঙ্গে মিলেমিশে থাকলে সুখী হওয়া যায়। তাই একসঙ্গে মিলেমিশে থাকা ছাড়া সুখ আশা করা সত্যিই কঠিন।

সুখ হলো বেতার তরঙ্গের মতো। এটা সবসময় থাকে, একে শুধু বের করে আনতে হয়। হার্ভার্ড ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, যদি মানুষের চারপাশে বেশিরভাগ লোকই হয় হাসি-খুশি ও দয়ালু, তবে তাদের বিশ্ব অনুভব সেই ব্যক্তির ওপরেও পড়ে। সবচেয়ে মজার ব্যাপারটি হলো, আনন্দ কী করে সংক্রমিত হতে পারে বিজ্ঞানীরা তার ফর্মুলাও বের করেছেন। এই তথাকথিত রোগ একদিন অনুভব করতে পারলে মানুষ এই ভাইরাসের কবলে বার বার পড়তে চাইবে। তাই এখন থেকে সবাই খুশির সঙ্গে সুখী হওয়ার রোগে ভুগতে থাকুন। মানুষের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য ‘সুখ’ নামক জিনিসটা খুবই প্রয়োজন। যারা নিজেকে অসুখী মনে করেন, তারা সুখের ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার চেষ্টা করুন- নিজেকে সুখী ভাবুন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত