ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাল্যবিয়ের যাঁতাকলে কন্যাশিশু

রহিমা আক্তার মৌ
বাল্যবিয়ের যাঁতাকলে কন্যাশিশু

‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’, ‘আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি দিব’ এই বাক্যগুলো আমাদের মাঝে কে না পড়েছে। কে কতবার উদাহরণস্বরূপ বাক্যগুলো বলেছেন, তার হিসাব নেই কারো কাছেই। মাঝেমধ্যে মনে হয় আমরা নিজেরা নিজেদের স্বার্থে এই বাক্যগুলো ব্যবহার করি। ‘বাল্যবিয়ের যাঁতাকলে কন্যাশিশু’ বিষয় নিয়ে যখন লিখতে বসেছি, তখন সময় নভেম্বর ২০২৩-এর প্রথম সপ্তাহ। কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার মরিচ্যায় একটি বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে গিয়ে ২০২৩ সালের অগ্রিম করা ৪০টি বাল্যবিয়ের তথ্য পায় উপজেলা সমবায় অফিসার আল মাহামুদ হোসেন। একটি বাল্যবিয়ের খবর নিতে কাজী অফিসে গিয়ে দেখা যায়, ২০২৩ সালে ১৮ বছর বয়স হবে এই ধরনের অগ্রিম ৪০টি বিয়ে করিয়েছেন ওই কাজী। কাজী অফিস থেকে উদ্ধার করা ওই ৪০টি বিয়ের নিবন্ধিত নিকাহনামায় সময় উল্লেখ করা আছে ২০২৩ সাল। অথচ বিয়েগুলো সম্পন্ন হয়ে গেছে অনেক আগেই এবং তারা সংসারও করছেন। এই ৪০টির সবগুলোই বাল্যবিয়ে। (তথ্যসূত্র : ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, দৈনিক সমকাল)। নাদিয়ার বয়স ১৩ কি ১৪ বছর। বড় বোন আর দুলাভাই শহরে থাকে। বোন ছুটা বুয়ার কাজ করে আর দুলাভাই কখনো গার্ড কখনো রিকশা চালায়। ৪ থেকে ৫ বছর হয়েছে নাদিয়া এসেছে শহরে। বোনের মতো বিভিন্ন বাসায় ছুটা কাজ করে। সেই হিসাবে ৮ থেকে ৯ বছর বয়স থেকেই নাদিয়া কাজ করে শহরের বাসাবাড়িতে। প্রথম কয়েক মাস বোনের সঙ্গে হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করলেও পরে ওকে আলাদা কাজ নিয়ে দেয়। শরীরে মাংস দেখাই যায় না, হাড়গুলো যা আছে তাও রক্তশূন্যতা। প্রকৃতিগত কারণে এদেশের মেয়েরা এখন অল্প বয়সেই পিরিয়ডের সম্মুখীন হয়, নাদিয়ারও তাই। মাস ঘুরতেই কাজে অনুপস্থিত। কারণ ওই একটাই। পেটের ব্যথা কোমরের ব্যথায় এই ওষুধ ওই ওষুধ। কয়েকদিন পর বোন গ্রামে নেয় পানপড়া খাওয়াইতে। সপ্তাহ পর ফিরে আসে কাজে। একই রুমে একই বিছানায় বোন, দুলাভাই, উপযুক্ত ভাগনাসহ দিন-রাত কাটে নাদিয়ার। নাদিয়া প্রেম করে এক হোটেলে কাজ করার ছেলের সঙ্গে। দুইমাস পর একরাতে নাদিয়াকে গ্রামে নিয়ে যায়।

যাওয়ার সময় মায়ের অসুস্থতা বললেও আসলে গ্রামে নিয়ে নাদিয়াকে বিয়ে দিয়ে দেয়। অবশ্য বিয়ে হয় সেই হোটেল বয়ের সঙ্গেই। মনে মনে ভাবছি কবে জানি শুনতে পাই ‘নাদিয়া মা হবে’। হ্যাঁ ঠিক বলেছি ১৪ থেকে ১৫ বছর বয়সি শিশু নাদিয়া আরেকটা শিশুর মা হবে। সাবিহার ন্যাশনাল আইডির বয়স না হলেও এরই মধ্যে তিন সন্তানের মা সে। গ্রামে কাজের অভাব, জামাইকে দারোয়ানের কাজ দিয়ে শহরে আনে শ্বশুর-শাশুড়ি। এরপর সাবিহাও আসে বাচ্চাদের নিয়ে। চতুর্থ সন্তান গর্ভে, পিরিয়ড হওয়ার ওষুধ এনে খাওয়ায়। শুরু হয় রক্তপাত। আবার ওষুধ আনে রক্তপাত বন্ধ হবার; কিন্তু সেটা আর বন্ধ হয় না।

৩ থেকে ৪ দিন ধরে রক্তপাতের সঙ্গে এখন দুর্গন্ধ। গাইনি ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করার পর বলা হয় ওর গর্ভে পাঁচ মাসের ছেলে সন্তান, যা মরে গেছে। ডাক্তার এই রোগীকে ধরবে না। অনেক অনুরোধে স্বাক্ষর নিয়ে ডাক্তার এমআরআই করে। এই যাত্রায় বেঁচে যায় সাবিহা। কি আজব বিষয়, অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে আর বছর বছর সন্তানের জন্ম। এক কন্যাশিশুর কোলে তিন শিশু। শায়লার মা শহরের বাসাবাড়িতে কাজ করে, বাবা বাসাবাড়ির দারোয়ান। নানির কাছে থেকে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে শায়লা। পাশের গ্রামের রইজউদ্দিন নাকি কম্পিউটার শিখেছে। দোকানে কাজ করে। শায়লার জন্য আসে প্রস্তাব। প্রস্তাব আসার মাথায় বিয়ে। এমন শিক্ষিত ছেলে হাতছাড়া করতে চায় না বাবা-মা ও পরিবার। বিয়ের পর জানা যায় সবই মিথ্যে। বন্ধুর দোকানে আসা-যাওয়া করত রইজউদ্দিন। বিয়ের বছর ঘুরে সন্তান আসে কোলে, বাড়ে পরিবারের সদস্য। কিন্তু পরিবার চালাতে তো অর্থের প্রয়োজন। রইজউদ্দিনকে অটোরিকশা কিনে দিতে বলে, অনেক চেষ্টা করে শ্বশুর-শাশুড়ি তা দেয়। কয়েকমাস চললেও এই ওই সমস্যা বলে বাদ দেয়। শহরের দারোয়ানের কাজ দেয়; কিন্তু তাতেও মন বসে না। ওদিকে শায়লার সন্তান বড় হয় খরচ বাড়ে কিন্তু... দীপালির দুই মেয়ে তিন ছেলে। স্বামীর দ্বিতীয় বউ সে। প্রথম বিয়ের কথা গোপন করেই বিয়ে করে। দীপালির পর করে আরো দুইটা। বর্তমানে দুই স্ত্রী থাকে দুই জায়গায়। দীপালির বড় মেয়ে অনুকে যখন বিয়ে দেয় তখন অনুর পিরিয়ড শুরু হয়নি। পাঁচ বছরে দুই সন্তানের জন্ম। ছোট মেয়ে বিথি ক্লাস ফাইভে পড়ে। বিনা বেতনের স্কুলে পড়ে, বই পায় সরকারি। ক্লাসের পড়া শেষ করতে পড়তে হয় প্রাইভেট। কিনতে হয় খাতাণ্ডকলম আর গাইড বই। দীপালি এই বাসায় ওই বাসায় কাজ করে। বেতনের উপড়ি প্রতিমাসে কে দিবে। তবুও মেয়ের পড়ার কথা বললে হয়তো কেউ সহযোগিতা করে। ফাইভ পাস করার পর বিনা বেতনের স্কুলে আর লেখাপড়া নেই। দীপালির কথা- বিথির পড়ার মাথা অতো ভালো না। তাই ফাইভ পাস করলে আর পড়াবে না। বিথির ভাই ও ভাবি পোশাক কারখানায় কাজ করে, তাদের কাছে পাঠিয়ে দিবে ওকে। ওদের বাচ্চা দেখবে। ঘটনাটি এখান পর্যন্ত হলে- হয়তো ঠিক ছিল। কিন্তু আজ থেকে ১ বছর পর ২০২৪ সালের এই নভেম্বর বা ডিসেম্বরে বিথির গর্ভে বা কোলে আরেকটা শিশু থাকবে না তার নিশ্চয়তা কি? ২১ বছর বয়স হওয়ার আগে কোনো পুরুষ এবং (কিংবা) ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে কোনো নারী যখন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তখন সে বিয়েকে বাল্যবিয়ে হিসেবে গণ্য হয়। বাল্যবিয়ে বর্তমান বাংলাদেশের একটি বিপর্যয়। যদিও সরকারিভাবে তা স্বীকার করে না কেউ। ২০০৬ থেকে ২০২২ সালের তথ্য পর্যালোচনা করে বলা হয় ১৮ বছর হওয়ার আগেই বাংলাদেশের ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ২৭ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে বয়স ১৫ বা তার কম বয়সে। বাল্যবিবাহ নিরোধ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ২০১৭ সালে চাইল্ড মেরিজ রেসট্রেইন্ট অ্যাক্ট। ১৯২৯ বাতিলপূর্বক সময়োপযোগী করে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন প্রণয়ন করেন। অবশ্য এতে এতটা আনন্দের কিছুই ছিল না। কারণ আইনটির একটি বিশেষ ধারায় বাল্যবিয়েকে বৈধতা দেওয়া হয়। এই ধারায় বলা হয়, ‘বিধি দ্বারা নির্ধারিত কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্ত বয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে, আদালতের নির্দেশ এবং পিতামাতা বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতিক্রমে, বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণক্রমে, বিবাহ সম্পাদিত হইলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে না।’ উপরে উল্লেখিত নাদিয়া, সাবিহা, শায়লা ও অনু ওই নির্ধারিত ধারার মাঝে পড়েই বাল্যবিয়ের যাঁতাকলে। হয়তো বছর ঘুরতেই বিথির ভাগ্যেও তাই হবে। এদের সবার বাল্যবিয়ের কারণ হলো দারিদ্র্যতার কষাঘাত আর শিক্ষার অভাব। বিভিন্ন তথ্য বলছে মহামারি করোনার পর বাল্যবিয়ের হার বেড়ে গেছে। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে গৃহে থাকা অল্পবয়সি মেয়েদের বিয়ে দেয়ার প্রবণতা বেড়েছে পরিবারে। কার্যত আইন থাকলেও আইনের ফাঁক থাকার কারণে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বাল্যবিয়ে। এপ্রিল ২০২৩ মাসে প্রকাশিত বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০২২-এর প্রাথমিক ফলাফল অনুসারে, বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার ৫০ শতাংশের বেশি। বিডিএইচএস ২০১৭-১৮ সালের প্রতিবেদনে বাল্যবিয়ের হার প্রায় ৫৯ শতাংশ উল্লেখ করা ছিল। বাংলাদেশের বাল্যবিয়ে পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ইউএনএফপিএর প্রতিনিধি ক্রিশ্চিন ব্লুখস বলেন, ‘এশিয়ায় বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটছে। বাল্যবিয়ে বাড়লে কম বয়সে গর্ভধারণের ঝুঁকি বাড়ে। বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ৭৪টি শিশুর জন্ম দিচ্ছেন ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সি মায়েরা। বাল্যবিয়ের সার্বিক প্রভাব পড়ে মা ও শিশুস্বাস্থ্যে। বাল্যবিবাহের কারণে মা ও নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকিও বাড়ে।’ (তথ্যসূত্র : ১ মে ২০২৩, দৈনিক প্রথম আলো) বিগত ১০ থেকে ১৫ বছরের হিসাব থেকে বাল্যবিয়ে কমে এসেছিল; কিন্তু করোনা ও এর পরের অবস্থা বাল্যবিয়ের চিত্র পাল্টে দিয়েছে। একজন সাধারণ বা সচেতন নাগরিক হিসাবে একটা বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যায়; কিন্তু ওই যে আইনের ধারার অংশ। মেয়েদের লেখাপড়ায় অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আসছে সরকার, বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। শিক্ষাব্যবস্থা অনেক বদলে গেছে, পড়তে গেলে শুধু বই হলেই হয় না, লাগে আরো অনেক কিছু। এখনো অনেক পরিবার কন্যাশিশুর শিক্ষার ক্ষেত্রে টাকা ব্যয় করাকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে না। তারা মনে করে মেয়েকে তো পরের ঘরে যেতে হবে, তার পেছনে খরচ করার মানে হয় না। বাল্যবিয়ের মতো এই বিষাক্ত বিষয় থেকে কন্যাদের পরিত্রাণ দিতে হলে সামাজিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে পুরো সমাজকে। নইলে শিক্ষিত মায়ের জায়গা দখল করবে অপ্রাপ্ত বয়সি শিশুমায়েরা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত