ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

লবণাক্ততার কবলে উপকূল

সংকট মোকাবিলায় দরকার সমন্বিত উদ্যোগ
লবণাক্ততার কবলে উপকূল

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে উপকূলীয় ১৮ জেলার ৯৩টি উপজেলা বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততার কবলে পড়েছে। দিন দিন উন্মুক্ত জলাধার কমে যাওয়ার কারণে তাপপ্রবাহ বাড়ছে। আর এর প্রভাবে মানুষসহ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রাণীকূল। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি, স্বাস্থ্য ও পানি খাত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় জাতীয়ভাবে সমন্বিত উদ্যোগ ও পরিকল্পনা জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ খুব বেশি দায়ী না হলেও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় দিন দিন বাস্তুহীন ও গৃহহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। পাশাপাশি ফসল, মৎস্য উৎপাদন কমছে। লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় খেটে খাওয়া মানুষ বিশেষ করে নারী ও শিশুস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে। যে কোনো ধরনের নীতিমালা গ্রহণের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অভিমতকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় আনতে হবে। ভুক্তভোগী ও সংকটাপন্ন মানুষ কীভাবে তাদের ক্ষতি পুষিয়ে উঠবে বা কীভাবে ক্ষতিপূরণ পেতে পারে সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে। সুস্থ্য জীবনযাপনের জন্য পরিবেশগত বায়ু, পানি ও শব্দ দূষণ কমানো, বৃক্ষরাজি গড়ে তোলা, নদী-খাল, হাওর, বাঁওড়গুলোর পানিপ্রবাহ নিশ্চিত, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিশেষ করে অপরিকল্পিত উন্নয়ন বন্ধ এবং ভূগর্ভস্থ পানির নির্ভরতা যথা সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। এ জন্য জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দেশি ও আন্তর্জাতিক আইন-নীতিমালাগুলোর সমন্বয় করতে হবে। সেইসঙ্গে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সচেতনভাবে এসব কাজে সম্পৃক্ত হতে হবে। ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। সেটা যেমন আমরা জানি। তেমনি বিশ্ব নেতারাও জানে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে বাঁচতে ও সুরক্ষা পেতে নানা দিক নিয়ে ভাবছি, পরিকল্পনা করছি এবং সে অনুসারে কাজও করছি। তবে ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা ৫৪টি নদীর ফয়সালা না হলে এর প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়া বাস্তবিক অর্থে কঠিন। পানিপ্রবাহ না থাকায় নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। এক ফসলির জমিতে একাধিক ফসল উৎপাদন করায় পানি সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। কারণ উজানের পানি নেই। বাধ্য হয়ে সাগরের পানির ওপর ভরসা করায় লবণের মাত্রা বাড়ছে। সুন্দরবন সুরক্ষায় ঘষিয়াখালী খালের সুফল পাওয়া যাচ্ছে পুনঃখননের মাধ্যমে। ৫৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮৩টি খাল খনন করার পরও পানি সংকটের সমাধান হচ্ছে না। নিয়মিত খনন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। উজানের পানি প্রবাহ আনতে ৫৪ নদীর সমাধান দরকার। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বেশি আছে কৃষি ও পানির ওপর। বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ কমে যাওয়ায় মাছ চাষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ফলে মাছের স্বাভাবিক উৎপাদনও বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়ায় তাপমাত্রায় পরিবর্তন আসছে। মৌসুমি বৃষ্টি নিয়েও শঙ্কা বাড়ছে। লবণাক্ততা বাড়ছে। মিষ্টি পানির স্থলে লবণ পানি পৌঁছে গেছে। ফলে খাদ্য উৎপাদনের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যা উদ্বেগের বিষয়। সেইসঙ্গে মানব স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য নিরাময় ও অভিযোজনের ওপর জোর দিতে হবে। তবে আশঙ্কার কথা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় কোনো তহবিল নেই। নিজস্ব উদ্যোগে পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানি মানুষ থেকে আসে মাত্র দশমিক ৫ শতাংশ। এটাই আমাদের জন্য প্রধান উদ্বেগের বিষয়। বায়ুমণ্ডলে কম কার্বন নিঃসরণ করতে হবে। পলিথিন উৎপাদনে কার্বন নিঃসরণ বেশি হওয়ায় পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। দেশে ১০০ টন পলিথিন ব্যবহার হয়। যার ৫০ শতাংশ দেশে উৎপাদন হয়। বাকিটা বাইরে থেকে আসে। পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করতে অভিযান চলছে। জেল জরিমানা করা হচ্ছে। তবুও বন্ধ হচ্ছে না। দশমিক ৭ শতাংশ কার্বনডাই অক্সাইড মনুষ্য সৃষ্ট। এটা বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরকে সাধ্যমতো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দেশের নদী ও খালগুলো দিন দিন দখল হয়ে যাচ্ছে। বর্জ্য ও পলি অপসারণ করে খালের পানি প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে। এখন কেবল শহরেই নয়, গ্রামেও বাড়ি করতে হলে প্ল্যান নিতে হচ্ছে। এটা পরিকল্পিত উন্নয়নেরই অংশ। জলবায়ু পরিবর্তন ও শহরায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করে পদক্ষেপ নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পরিবর্তন মোকাবিলায় বাসযোগ্য শহরের পাশাপাশি পরিষ্কার নগর পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দৃশ্যমান হচ্ছে। কেননা সেচের জন্য পানির অভাব দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে জলাবদ্ধতা, কৃষি শ্রমিক স্বল্পতা ও বেড়িবাঁধ সমস্যা তো রয়েই গেছে। নদী ও খাল খনন করাসহ স্লুইস গেট সংস্কার করা প্রয়োজন। খালের ইজারা মৎস্য চাষিদের দেয়ার কারণে কৃষক পানি পায় না। অথচ সরকার নামমাত্র রাজস্ব পায়। খালের পানি প্রবাহ গতিশীল থাকবে। জলাধার থাকতে হবে। জলাধার নেই বলেই তাপপ্রবাহ বাড়ছে। একটা কথা স্মরণ রাখা দরকার যে, প্রকৃতিকে বাঁধাগ্রস্ত করলে প্রকৃতি প্রতিশোধ নেবে। ১৯৭৩ সালে জরিপে ৮ লাখ ৩৩ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততা পাওয়া যায়। ২০০০ সালের জরিপে লবণাক্ততার মাত্রা ১ লাখ ২০ হাজার ৭৫০ হেক্টর। ২০০৯ সালের জরিপে লবণাক্ততা ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ২৬০ হেক্টর। ২০২১ সালের জরিপের ফলাফল আগামী নভেম্বরে প্রকাশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ১৯৭৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ জমি লবণাক্ত হয়। ২০০০ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত লবণাক্ত হয় ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ জমি। বৃষ্টি কমলে লবণাক্ততা বেড়ে যায়। আগে আমন চাষের পর জমি পতিত থাকত। তবে আশার কথা হচ্ছে এখন ভুট্টা ও সূর্যমুখীসহ লবণসহিষ্ণু ধান চাষ হচ্ছে। এটা সম্ভব হয়েছে দেশের কৃষি বিজ্ঞানীদের গবেষণা আর সরকারের তরফ থেকে এ ব্যাপারে যথেষ্ট প্রণোদনা দেয়ার ফলে। প্রাকৃতিক কারণে আমাদের উপকূল লবণাক্ততার শিকার হচ্ছে। তবে আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত