ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিনা বেতনে নিম্ন মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা

বাস্তবায়নের অপেক্ষায় অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা
বিনা বেতনে নিম্ন মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা

বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে (অবৈতনিক শিক্ষা) পড়াশোনা করছেন শিক্ষার্থীরা। এটি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করতে যাচ্ছে সরকার। ফলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়তে পারবেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষাকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রথম ধাপে নিম্ন মাধ্যমিক স্তরকে অবৈতনিক করা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে শিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় আলাদা আলাদা উদ্যোগ নিয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে শিক্ষা জাতীয়করণের পথ সুগম হবে এমনটা মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী চলতি বছরের জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি অগ্রাধিকার কিছু খাত নির্বাচন করেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো- নিম্ন মাধ্যমিক স্তরে অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা। এরই অংশ হিসেবে গত ৫ মে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দেশের বিশিষ্ট কয়েকজন শিক্ষাবিদ, দুই মন্ত্রণালয়ের তিন সচিব, মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। প্রাথমিক সমাপনীতে পাস করা ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে এসএসসিতে অংশ নেয় ২১ বা ২২ লাখ। অর্থাৎ ৫৮ বছরের ব্যবধানে ৮ লাখের বেশি শিক্ষার্থী ঝরে যায়। এ বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী অদক্ষ হয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। সরকারের লক্ষ্য এই শিক্ষার্থীদের ক্লাস রুমে ধরে রাখা। ২০১৯ সালে বলা হয়েছিল, ২০২৩ সালের মধ্যে নিম্ন মাধ্যমিক এবং ২০২৫ সালের মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক বা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হবে। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়। করোনার পর সরকার আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়ে। সে কারণে ওই উদ্যোগে আর হাত দেওয়া হয়নি।

গত একদশকের বেশি সময় ধরে বিনা মূল্যে পাঠ্যবই ও উপবৃত্তি দিয়ে আসছে সরকার। এটি সারা বিশ্বের একটি বিস্ময়। এর সুফল পাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। এখন সরকারের পরবর্তী টার্গেট বিনা বেতনে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা করানো। নিম্ন মাধ্যমিক স্তর যদি অবৈতনিক করা যায় তা হলে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেকাংশে কমানো সম্ভব। নিম্ন মাধ্যমিক অবৈতনিকের পাশাপাশি এ স্তরের শিক্ষার্থীদের কারিগরি শিক্ষা দেওয়া হলে তারা দক্ষ হয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারে। দেশ ও বিদেশে সে আর অদক্ষ শ্রমিক হয়ে থাকবে না। বর্তমানে দেশের সরকারি প্রাথমিক স্কুলে বিনা বেতনে শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করার সুযোগ পান।

অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক হলে প্রাথমিকের মতো তারাও বিনা বেতনে পড়তে পারবেন। লেখাপড়ার পেছনে শিক্ষার্থীদের বড় দুই দাগে ব্যয় হয়। একটি প্রাতিষ্ঠানিক আর অন্যটি পারিবারিক। পারিবারিক ব্যয়ের মধ্যে আছে খাতা, কলম, জামা-কাপড় ইত্যাদি। অবৈতনিক হলে প্রাতিষ্ঠানিক খরচ সরকার বহন করবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক এক জরিপে বলা হয়েছে, বর্তমানে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে ৪৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। বাকি ৫৩ দশমিক ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে।

তবে, সম্প্রতি ইউনেস্কোর গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্টের প্রতিবেদন বলছে, দেশের ৫৫ শতাংশ শিশু প্রাক-প্রাথমিক স্তরে বিভিন্ন ধরনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়। মাধ্যমিক পর্যায়ে এই হার ৯৪ শতাংশ, যা বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ২০১২ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে এ খাতের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ। ছয় হাজার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিপরীতে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে মাত্র ৯০০টি। উচ্চ মাধ্যমিক বা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়ালেখার ব্যবস্থা করা গেলে জাতীয়করণের কাজটি অনেক দূর এগিয়ে যাবে।

অবৈতনিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করা হলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো টিউশন বা অন্যান্য ফি আদায় করা হবে না। এর পরিবর্তে সরকার দুভাবে টিউশন ফি’র সংস্থান করবে। একটি হচ্ছে, প্রত্যেক স্কুল-মাদ্রাসা একই হারে টিউশন ফি নেবে। সেই ফির অর্থ সরকার শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠাবে। শিক্ষার্থীরা তা স্কুলে জমা দেবে। অথবা, ধার্য টিউশন ফি সরকার সরাসরি প্রতিষ্ঠানে পাঠাবে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পেছনে সরকার কত টাকা ব্যয় করবে, তা আলাদাভাবে নির্ধারণ করা হবে। এরপর সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেণিভিত্তিক মোট কত টাকা সরকার ব্যয় করবে, তা বের করা হবে। এ ক্ষেত্রে স্কুলের টিউশন ফি ও অন্যান্য ব্যয় হিসাবে আনা হবে। এক দশক আগে এটি হওয়ার কথা ছিল। সরকারের নানা নীতির কারণে হয়নি। তারপরও সরকার আবারও শুরু করতে যাচ্ছে। এটাকে স্বাগত জানিয়েছেন দেশের শিক্ষাবিদরা। আপাতত অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষাকার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হলেও আগামী ছয় বছরের মধ্যে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের টিউশন ও সেশন ফিসহ প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের ব্যয় বহন করবে সরকার। শিক্ষানীতি-২০১০ অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে আট বছর করার কথা ছিল। এর অংশ হিসেবে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারণ করার কথা। কিন্তু বিগত ১৩ বছরে মাত্র ৬৯৬টি বিদ্যালয় সম্প্রসারণ করা হয়েছে। সেগুলো নিয়েও নানা জটিলতা রয়েছে। আমাদের ৬৯৬টি বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষাকার্যক্রম চলমান আছে। সহস্্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য-এসডিজিতে বলা আছে, সরকার দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়ালেখা করাবে। সরকার সেখানে স্বাক্ষর করেছে।

এখন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক ব্যবস্থা চালু করতে পারলে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত এটি উন্নীত করার পথ সুগম হবে। শিক্ষাবান্ধব সরকারের এই সিদ্ধান্ত যত শিগগির বাস্তবায়ন হবে, ততই মঙ্গল। অভিভাবক ও শিক্ষাথীঁরা সেই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত