ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বহুরূপে সম্মুখে ছাড়ি ...

অলোক আচার্য
বহুরূপে সম্মুখে ছাড়ি ...

বহুরূপে সম্মুখে ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর, জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর- এই উক্তিটি স্বামী বিবেকানন্দের বহু বিখ্যাত উক্তির মধ্যে একটি। কেন এই বক্তব্য দিয়ে শুরু করছি তার কারণ হলো আজকাল এই সমাজে সমাদ্দারদের মতো ভণ্ড আর মুখোশধারী মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে। এই মিল্টন সমাদ্দার দাদারা কিন্তু একদিনেই সৃষ্টি হয়নি এই সমাজে। ধীরে ধীরে সামাজিক বিবর্তনে নিজেকে প্রস্তুত করেছে। যে সমাজে বাহবা পাওয়ার জন্যই কেবল ঈশ্বর খোঁজা হয়! দল বেঁধে হাসি মুখে একটি বস্তা হাতে দান করার ছবি ধরিয়ে দেওয়া হয় এবং সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করার চেষ্টা করা হয়। কারণ আর কিছুই না প্রচার। নিজের বিজ্ঞাপন দেওয়া আরকি। আজকাল মানুষের দুর্দশার দাম নেই, দাম আছে বিজ্ঞাপনের।

যে যত বেশি মানুষের দুঃখ দুর্দশা বা দারিদ্র্যতা নিয়ে ভাইরাল হতে পারবে তার ভাগে তত বেশি অর্থ জমা হবে। মানুষের আবেগ কাজে লাগিয়ে বিবেককে নাড়া দিয়ে বিশ্বাস পুজি করে মানুষ গাড়িতে চড়ছে, এসির হাওয়া খাচ্ছে। এই যেমন সমাদ্দার এতদিন কাটিয়েছেন। অথচ তার মানবিক কাজগুলো এতদিন রীতিমতো গল্পের মতো মনে হয়েছে সবার কাছে। মনে হয়েছে তিনি স্বয়ং ঈশ্বরের অংশ! আর আজ? শয়তানও বুঝি তার থেকে উত্তম! মানে পরিস্থিতি সেটিই বলছে। স্বামী বিবেকানন্দের বাণী মর্মে শ্রবণ করে তিনি রাস্তাঘাট থেকে অসহায়, অসুস্থ বয়স্ক মানুষকে তার আশ্রমে ঠিক নিয়ে গেছেন। তাদের দেখিয়ে টাকা লুটেছেন। কিন্তু তারপর কী হয়েছে তা কেউ জানত না। তাদের অঙ্গ কেটে ব্যবসা করার অভিযোগ রয়েছে। প্রশ্ন হলো এরকম সমাদ্দার কি সমাজে একাই? মানে সমাজ কি এরকম একটি মিল্টন সমাদ্দারের জন্ম দিয়েছে? আমি মনে করি খুঁজলে বা গভীরে তলিয়ে দেখলে এরকম বহু মিল্টন সমাদ্দারের খোঁজ পাওয়া যাবে যাদের মূল কাজ হলো মানুষের আবেগ নিয়ে ব্যবসার ভাগ বৃদ্ধি করা। প্রচারসর্বস্ব সমাজে নিজেকে জাহির করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে সবাই। পত্রপত্রিকায় হাসি হাসি মুখ করে দান করার ছবি, কাউকে সাহায্য করার ছবি নিয়মিত পোস্ট দেন অনেকেই। এর উদ্দেশ্য কী? এর উদ্দেশ্য হলো নিজের বিজ্ঞাপন দেওয়া!

এক মিল্টন সমাদ্দার যখন আইনের হাতে ধরা পড়ে তখন আরো মিল্টন সমাদ্দার সমাজের অলি-গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অবৈধ পথে টাকা উপার্জন করে সমাজে টাকা ছড়িয়ে নিজেকে নেতার সাথে হাসি হাসি মুখে ছবি তুলে বড় নেতা বনে যাওয়াও অনেকের উদ্দেশ্য! মানুষ ব্যস্ত আছে কে কত ক্ষমতাশালী, কার কত টাকা আছে, টাকার পরিমাণে সমাজে কার অবস্থান কোথায়, কে কতটা বিলাসী জীবনযাপন করতে পারে, কে কতভাবে মানুষকে ঠকিয়ে বড় হতে পারে ইত্যাদি নিয়ে। সেই সাথে আরো একটি বিষয় মানুষের স্বভাবজাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রচারসর্বস্ব জীবন বেছে নিচ্ছে মানুষ। সবাই প্রচারে ব্যস্ত। প্রচারের আজ মাধ্যমেরও অভাব নেই। অভিনব সেসব প্রচার ব্যবস্থা! এই প্রচারের জোরেই আজ কর্মীর চেয়ে নেতার সংখ্যা বাড়ছে, পাঠকের চেয়ে লেখকের সংখ্যা বাড়ছে, দর্শক কমছে আর সেই সাথে সাধারণ মানুষের আগ্রহ কমছে। এসব থেকে ফিরতে হলে মানুষের সেই মানবিক গুণগুলো ফিরিয়ে আনতে হবে। যে গুণের জন্যই মানুষ শ্রেষ্ঠ। দান করা, সাহায্য করা প্রতিটি ধর্মেরই মূল কথা। সহানুভূতির বাণী ছড়িয়ে দেওয়াই সব ধর্মের মূলে। সেই দান করারও একটা নিয়ম আছে। এক হাতে দান করলে তা যেন অন্য হাত জানতে না পারে। ঢোল নিয়ে সাহায্য করে অনেকের সহানুভূতি আদায় করে আরো বেশি সুবিধা নেওয়াটাও একটি অন্যায়। যে সমাজে সবাই সবাইকে ঠকানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে থাকি, দুহাত পেতে বাইরে ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে কর্মক্ষম মানুষ হাত পেতে ভিক্ষা করতে সম্মানবোধ করে আর ভেতরে স্যুটেড-ব্যুটেড মানুষেরা ঘুষ নামক ভিক্ষা নিয়ে জীবনধারণ করে, মানুষ মানুষকে মারার জন্য নিত্য নতুন অস্ত্র তৈরি করে, ধর্মে-ধর্মে, বর্ণে-বর্ণে প্রতিনিয়ত রেষারেষি, শিক্ষার নাম করে বাণিজ্যের দুয়ার খুলে বসে থাকে, আতঙ্ক আর অস্থিরতায় সময় পার করতে হয় সে সমাজকে কেবল বড় বড় দালানাকোঠা, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রবৃদ্ধির মানদ-ে আধুনিক সভ্য সমাজ বলা যায় কি না তা ভেবে দেখতে হবে। সমাজের উৎকর্ষ সাধন কেবল পোশাকে-আশাকে হয়েছে, মননে-মানবিকতায় হয়নি।

সভ্যতা এগিয়েছে কিন্তু মানসিকতা পিছিয়েছে। সভ্যতার শুরুতে মানুষের পোশাক ছিল না। লজ্জা নিবারণের জন্য গাছের বাকল ব্যবহার করত। এখন বাহ্যিক লজ্জা নিবারণের জন্য স্যুট ব্যুট আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু চক্ষু লজ্জা প্রায় নেই বললেই চলে। এখন ইচ্ছা করলেই মিথ্যা বলা যায়, কারো সাথে প্রতারণা করা যায়, কাউকে মঞ্চে দাঁড়িয়ে মিথ্যা আশ্বাসের বাণি শোনানো যায়। এ লজ্জা ঢাকার কোনো পোশাক নেই। এদেশে একটা বালিশ কিনতে হাজার হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়, কেরানির চাকরি করে বড় বড় বাড়ি গাড়ির মালিক হওয়া যায়। অন্য চিত্রও আছে। সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে পান্তা ভাত দিয়ে রাতের খাওয়া শেষ করা মানুষগুলোও এ সভ্যতারই মানুষ। ভদ্র পোশাক পরা মানুষগুলো যারা সভ্যতার দোহাই দিয়ে অবলীলায় অসভ্য কার্যক্রম করে যাচ্ছে তাদের ভেতর থেকে আজও সেই আদিমতা ধুয়ে মুছে যায়নি। মনুষ্যত্বের কোনো বিচারেই এদের মানুষ বলা ঠিক হবে না। এইসব ভোগবাদী সমাজেই জন্ম হয় সমাদ্দারদের। তারা তো যে কোনোভাবেই সমাজে তথা কথিত সুনাম কিনতে চাইবেন। সেই সুযোগ তো ভোগবাদী সমাজই করে দিয়েছে। সমাদ্দারদের দরদী পোস্ট দেখেই যারা তাকে বিশ্বাস করে, দেবতার আসনে বসিয়ে সাহায্য পাঠিয়েছেন তারাও কিন্তু কেবল বিশ্বাসের জোরেই দিয়েছেন একবারও যাচাই করার প্রয়োজন মনে করেননি। এই সমাজে আদৌ কি কাউকে এতটা বিশ্বাস করা উচিত? মানুষকে ঠকিয়ে বড় হওয়ার চেষ্টা করে এই আধুনিক সভ্যতার মানুষগুলোই। মানুষের চোখে ধূলো দেওয়াই এই সমাজের মানুষের সবচেয়ে বড় পেশা। সবচেয়ে বড় ইনকামের পথ! বিশ্বাস হলো তার পুঁজি। একবার যদি বিশ্বাস অর্জন করতে পারেন তাহলে আর নেতা হওয়া ঠেকায় কে? বিবেক-বোধ, জ্ঞান, সংযম, প্রেম সবকিছু বর্জন করে আঁকড়ে ধরে আছি মিথ্যে অহমিকাকে। যান্ত্রিক সভ্যতার উৎকর্ষের সাথে সাথে মানবিক সভ্যতা বিলীন হতে আরম্ভ করেছে। দিন যত এগিয়ে যাচ্ছে এই মানবতার সংকট তত ঘনিভূত হচ্ছে। নিত্য নতুন ডিজাইনের পোশাক গায়ে দিয়ে রাস্তায় বের হচ্ছি কিন্তু প্রকৃত লজ্জার মাথা খেয়ে বসে আছি। আজ ঘুষখোর, চাঁদাবাজ, লম্পট বললেও কেউ তেমন একটা রাগ করে না। ঘুষ খাওয়ার মধ্যেই যেন আনন্দ নিহিত! যেখানে মন নেই, রুচি নেই, মনুষ্যত্ব নেই, বিবেক নেই, ঘৃণা নেই, মানবিকতা নেই সেখানে কোন সভ্যতার উত্তরণ ঘটছে জানি না। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশনের খবরে সমাজের বিপথে যাওয়ার খবর দেখি। দেখতে দেখতে চোখ সয়ে গেছে। সয়ে যাচ্ছে। মনের বোধের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। বিবেকের কোনো মূল্য নেই। আবেগ দিয়ে কিছুই হয় না। সেসব ভয়ংকর চিত্র দেখেও কোনো অনুভূতি হয় না।

মনটা অজানা আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। কিছুই করার থাকে না। সভ্যতার বিকাশ সাধন হয়েছে ঠিকই কিন্তু সেই যাত্রা তো ফের উল্টোদিকে টানছে না আমাদের। অল্প ক’জন ভালো মানুষ এ সমাজে আজ বড় বেকায়দায়। তারা এই আড়ম্বরপূর্ণ সমাজ নিয়ে কিছুটা বিরক্ত। বিপরীতে যারা অন্যের কাঁধে ভর করে নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে পকেট মোটা করে বসে আছে তারাই সমাজের হর্তাকর্তা। তাদের মুখের কথাই আইন। তাদের কথায় সবাই ওঠবস করে। তাদের দেখলে রাস্তাঘাটে সালামের হিড়িক লেগে যায়। কেউ ভয়ে আবার কেউ তোষামোদ করে চলছে প্রতিনিয়ত। তেল দেওয়াই যে এ সমাজের উপরে ওঠার সবচেয়ে কার্যকর ওষুধ। যে যত দক্ষ হাতে তেল দিতে পারবে সে তত উপরে উঠতে পারবে। তারপর একদিন তাকেও তেল দেওয়া শুরু হবে। এই তেলে কোনো ভেজাল নেই। এরা কিছু না বুঝলেও সব বোঝেন, কিছু না করলেও ফরমাশ দিতে ওস্তাদ, তারাই সমাজের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। এসব কর্তার চোটপাটে বাকিরা ভর্তা হবার যোগাড় সেদিকে কারো লক্ষ্য নেই! এরাই আজ সভ্যতার অগ্রগতি মাপার বড় মাপকাঠি। এই যেমন আমরা এতদিন সমাদ্দারকে গুরু মনে করেছি। আরো কত মিল্টন সমাদ্দার এই সমাজে ঘাঁপটি মেরে মানুষের আবেগ নিয়ে ব্যবসা করছে তার খোঁজ কে রাখছে? হয়তো একদিন সব বেরিয়ে আসবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত