ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আইনজীবী সুরক্ষা আইন কবে পাস হবে!

অ্যাডভোকেট মো. রায়হান আলী
আইনজীবী সুরক্ষা আইন কবে পাস হবে!

সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ আইন ও বিচার বিভাগ। একটি পাখির দুটি ডানা তা হলো- বিচারক ও আইনজীবী। উভয়ের যৌথ সমন্বয়ে পরিচালিত হয় বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগে বিচারকদের সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও অপর ডানা তথা আইনজীবীদের তেমন সুরক্ষার ব্যবস্থা নেই। প্রতিনিয়তই মিডিয়াতে খবর সরব যে অমুক আইনজীবী লাঞ্ছিত, সন্ত্রাসী কিংবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে। এ খবর যে আইনজীবী সমাজকে কতদিন শুনতে হবে তার ইয়ত্তা নেই!

রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ হল রাষ্ট্রপতি। সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ও বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সাহেবসহ অনেক বিচারপতি, মন্ত্রী কিংবা সংসদ সদস্য বা জনপ্রতিনিধি আইনজীবী থেকে হয়েছেন। সুতরাং দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা নিয়ন্ত্রণ করে আইন ও বিচার বিভাগ। আর এই বিভাগের একটি ডানা হলো আইনজীবীরা। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যাদের অনবদ্য অবদান। আদালতে বিচারকার্য চলাকালীন উপস্থিত আইনজীবীও কোর্ট অফিসার। একমাত্র বিচারক-আইনজীবীদের নামের শুরুতে বিজ্ঞ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। কতই না সম্মানিত এই আইনজীবীরা। আজ এত বড় সম্মানের জায়গাটাকে বিজ্ঞ আইনজীবীদের পদে পদে লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে কারণে-অকারণে আইনজীবীদের হতে হচ্ছে মামলা-হামলার শিকার। অনেক ক্ষেত্রে সামান্যতেই আইনজীবীদের হেয়প্রতিপন্ন করা হচ্ছে, লাঞ্ছিত করা হচ্ছে, সন্ত্রাসীদের হাতে আহত-নিহত হতে হচ্ছে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতেও হেয়প্রতিপন্ন হতে হচ্ছে। আইনজীবীদের সঠিক মূল্যায়নের অভাবে সমাজে দিন দিন তাদের এলিট পার্সন থেকে সম্মানের জায়গাটা অনেকাংশে সংকুচিত হচ্ছে। এমন ঘটনাগুলো সত্যিই এটা দেশের জন্য খুব লজ্জাকর।

সম্প্রতি একটি খবর পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে দেখা যাচ্ছে- চলতি মাসের ২ তারিখের ঘটনা। পত্রিকার হেডলাইন হচ্ছে- ‘সিলেট আদালত চত্বরে পুলিশ-আইনজীবী হাতাহাতি’ পত্রিকায় ঘটনাটির বর্ণনা এমন এসেছে- ‘প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, দুপুরে শাহপরাণ (রহ.) থানা জিআরও’র এসআই শামীমা খাতুনের কাছে সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য কাজী সেবা বেগম একটি মামলার নথি দেখতে চান। কিন্তু শামীমা খাতুন নথি দেখাতে রাজি হননি।

এ নিয়ে এসআই শামীমা খাতুন ও তার পাশে থাকা কনস্টেবল বিউটি পুরকায়স্থের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়ান অ্যাডভোকেট কাজী সেবা বেগম। পুলিশ সদস্যদের অভিযোগ, বাগবিতণ্ডার এক পর্যায়ে অ্যাডভোকেট কাজী সেবা বেগম কনস্টেবল বিউটি পুরকায়স্থকে চড় মারেন। এরপর অ্যাডভোকেট কাজী সেবা বেগম ঘটনাস্থল থেকে বেরিয়ে জেলা ও দায়রা জজ আদালত ভবনের সামনে গেলে কনস্টেবল বিউটিসহ দুই নারী পুলিশ সদস্য তাকে ঝাপটে ধরেন এবং শারীরিকভাবে হেনস্তা করেন।

এ সময় তাদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এ ঘটনার পর আদালতের আইনজীবীরা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তারা আদালতপাড়ায় বিক্ষোভ মিছিল করেন। মিছিল নিয়ে উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) কার্যালয়ের বারান্দায় গেলে সেখানে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। তখন পুরো আদালতপাড়া উত্তপ্ত হয়ে ওঠে’। (তথ্য সূত্র : সিলেট ভিউ ২৪ ডট কম ০২ মে, ২০২৪)। গত বছরেও ময়মনসিংহে আইনজীবী হেনস্তার একটি ঘটনা পুরো আইনজীবী সমাজের হৃদয় বিদীর্ণ করেছিল। গণমাধ্যমের কল্যাণে জানতে পেরেছিলাম যে, পুলিশের ময়মনসিংহ রেঞ্জের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এনামুল কবীরের বিরুদ্ধে এক আইনজীবীকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। গত ১৫ জুন, ২০২৩ তারিখে দুপুরে ময়মনসিংহ জেলা আইনজীবী সমিতির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে এ অভিযোগ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন। লিখিত বক্তব্যে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক এনামুল কবীরকে বরখাস্তের দাবি জানান তিনি।

সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ময়মনসিংহ জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য আশিকুর রহমান গত বুধবার দুপুরে একটি পারিবারিক অভিযোগের শুনানির জন্য অতিরিক্ত ডিআইজি এনামুল কবীরের কক্ষে যান। শুনানির একপর্যায়ে অতিরিক্ত ডিআইজি এনামুল কবীর আশিকুর রহমানকে থাপ্পড় মারেন এবং পরে রড দিয়ে বেধড়ক পেটান। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আজ বেলা ১টায় জেলা আইনজীবী সমিতিতে জরুরি সাধারণ সভা হয়।

সভায় ঘটনার নিন্দা জানিয়ে অতিরিক্ত ডিআইজির বরখাস্তের দাবি জানানো হয়।

এর আগেও আইনজীবীরা অনেক লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে। সে ঘটনাগুলোও আইনজীবী সমাজকে বিস্মিত করেছে। এমন আরো অনেক ঘটনা আছে, তার মধ্যে আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল ২০২১ সালে। পটুয়াখালী জেলা আইনজীবী সমিতির সম্পাদককে লাঞ্ছিত করেছিল তৎকালীন পুলিশ প্রশাসন কর্তৃক। এ বিষয়ে পটুয়াখালী জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে তারা এঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে ঘটনার জানিয়েছে সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছিলেন।

২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি আইনজীবী সুরক্ষা আইন প্রণয়নের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া। আইনজীবী সুরক্ষা আইন না থাকায় আইনজীবীদের সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে- উল্লেখ করে রিট আবেদনকারী আইনজীবী ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, দেশে গত কয়েক বছরে ৬৭ জনের বেশি আইনজীবী হত্যা, নির্যাতন, হামলা ও অপহরণের শিকার হয়েছেন।

এ সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। আইনজীবীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর ও স্পর্শকাতর মামলা পরিচালনা ও শুনানি করতে হয়। ফলে কোর্ট থেকে বের হয়েই তারা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েন। বিভিন্ন সময়ে তারা প্রতিপক্ষের বা তাদের লেলিয়ে দেওয়া সন্ত্রাসীর দ্বারা নির্যাতনের শিকার হন।

রিট আবেদনে যেকোনো আইনজীবীর ওপর হামলা-মামলা বা আক্রমণ হলে তাৎক্ষণিকভাবে আইনগত ব্যবস্থাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। এছাড়া জুডিসিয়াল অফিসার, সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও বার কাউন্সিলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে স্বাধীন তদন্ত কমিটি বা কমিশন প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। আইনজীবীরা হয়রানির শিকার হলে তদন্তের ক্ষমতা ওই কমিটি বা কমিশনকে দেওয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে রিটে। আইনজীবীরা দেশের আইন জগতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মানুষের আইনী সেবা বা সহায়তা প্রদানে ভূমিকা রাখে।

আইনের সঠিক ব্যাখ্যায় কোর্টকে বিচারিক কাজে সহায়তা করে। নিরপরাধ ব্যক্তিরা অযথা হয়রানির শিকার হলে আইনি প্রক্রিয়ার তাদের আইনি সহায়তা প্রদান করে থাকেন।

আর সমাজ তথা রাষ্ট্রের এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা আজ সুরক্ষাহীনতায় ভুগছে। উপযুক্ত সুরক্ষার অভাবে নানান প্রকার হয়রানির শিকার হচ্ছেন এই আইনজীবীরা। যেহেতু রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন অনেক আইনজীবীরা। তাই আইনজীবীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করাও তাদের দায়িত্বের মধ্যে পরে। এ বিষয়ে আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বার কাউন্সিলকে সর্ব প্রথম এগিয়ে আসতে হবে, পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা পেলে আইনজীবী সুরক্ষা আইন পাস করা সম্ভব। আইনজীবী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দাবিতে পরিণত হয়েছে।

লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট,

জজ কোর্ট, খুলনা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত