ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

গুরুর বেত বনাম শিশুর মন

অলোক আচার্য
গুরুর বেত বনাম শিশুর মন

স্কুলভীতি বা স্কুলের প্রতি অনীহা জন্মানোর একটি বড় কারণ হলো- সেই শিক্ষার্থীকে শারীরিক বা মানসিকভাবে শাস্তি দেওয়া। অতীতে এ ধরনের শাস্তি ব্যবস্থা বহাল তবিয়তে চালু থাকলে আধুনিককালে মনোবিশেষজ্ঞরা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শাস্তি কোনো কার্যকর পদ্ধতি নয় বরং তা শিশুর মনে স্থায়ী ভীতি বা বিরক্তি জন্মানোর কারণ। ফলে এখন এটি নিষিদ্ধ। এটা সত্ত্বেও দেখা যায়, প্রায়শই দেশে শিক্ষার্থীকে শারীরিক শাস্তির খবর পাওয়া যায় এবং মাঝেমধ্যে তা শিউরে ওঠার মতো। আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থায় দেখা যায়, একটি শিশু সাধারণত ৪ বছর হওয়ার পরেই তাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে হয়। প্রাথমিক শিক্ষায় যা অল্প কয়েক বছর হলো- প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি চালু হয়েছে। যখন হাজার হাজার কিন্ডারগার্টেনে এসব শ্রেণি বিভিন্ন নামে চালু রয়েছে। বহু আগে থেকেই কিন্ডারগার্টেনে পড়ালেখা করা একজন শিক্ষার্থী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় প্রাথমিকের চেয়ে এগিয়ে থাকত। মাঝেমধ্যে পত্রিকার পাতায় প্রাক-প্রাথমিকের আগে একটি শ্রেণি চালু করার কথা শোনা গেলেও বিষয়টি নিয়ে অগ্রগতি জানা যায়নি। শিশু পরিবারে বেড়ে ওঠার পর্যায়ে সাধারণত ৩ বছর বয়স থেকেই শেখার প্রক্রিয়া শুরু হয়। মা-বাবার কাছ থেকে আমাদের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিচিতি এবং পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান সম্পর্কে পরিচিত হয় এবং এসবের ভাষান্তর করতে শেখে। এসব জ্ঞান লাভের একপর্যায়ে শিশুকে বিদ্যালয়ের সঙ্গে পরিচিত হতে হয়। একটি নতুন পরিবেশে নতুন মুখ এসব কিছু থেকে শিশু স্বাভাবিকভাবেই ভীত হয়ে পরে। তাকে মা-বাবা এবং শিক্ষক উৎসাহ দিলেও তার মধ্যে একধরনের ভয় বা সংকোচ কাজ করতে থাকে। এই ভয় স্কুল ভীতি নামে পরিচিত।

সাধারণ ভাষায় শিশুর এই ভীতির বিষয়টাকে ’স্কুল অ্যাভয়ডেন্স, স্কুল রিফিউজাল বা স্কুল ফোবিয়া’ বলা হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এটিকে ডিডাসক্যালেই নোফোবিয়া নামে পরিচিত। যেসব শিশু স্কুল পলায়নের প্রবণতা বা এ নিয়ে অজুহাত দেখা যায়, তারা স্কুল ফোবিয়ায় আক্রান্ত। আমাদের দেশে ছাত্রছাত্রীর মধ্যে স্কুল ভীতি ব্যাপকভাবে কাজ করে। স্কুল মানেই ছাত্রছাত্রীর কাছে শুধু লেখাপড়া এবং শিক্ষকের শাস্তির জায়গা। যেকারণে স্কুল ফাঁকি দেয়ার প্রবণতাও কাজ করে। যদি কোনো ছাত্রছাত্রীর শ্রেণির কাজ প্রস্তুত না হয়, তাহলে সে হয় স্কুলে যায় না অথবা স্কুলে গেলেও সেই ক্লাস ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করে। এই স্কুল ভীতি ছাত্রছাত্রীর অন্তত মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত থেকে যায়। স্কুল ভীতি থেকে তার ভেতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিও অনীহা জন্ম নেয়। অনেকেই মনের বিরুদ্ধে গিয়ে স্কুল-কলেজের লেখাপড়া শেষ করে। তবে এই ভীতি বা ধারণা উচ্চ মাধ্যমিক বা তার পরবর্তী পর্যায়ে গিয়ে পরিবর্তিত হয়। যদিও আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক বা মানসিক শাস্তি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে শিক্ষকদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করার জন্য উৎসাহ দেয়া হয়। কিন্তু বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। কাগজে-কলমে বিধিনিষেধ থাকলেও বাস্তব অবস্থা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আজও শারীরিক শাস্তি বহাল রয়েছে। মাঝেমধ্যে পত্রিকার পাতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের আঘাতে আহত হওয়ার খবর আমরা পাই। প্রাথমিক শ্রেণি থেকেই ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক শাস্তি দেয়া হয়। বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) বার্ষিক শিশু অধিকার পরিস্থিতি, ২০২৩-এ বলা হয়েছে, গত বছর শিক্ষকের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২৪০ জন শিশু। চলতি বছরের প্রথম ৩ মাসে শিক্ষকের কাছে নির্যাতনের শিকার ১২ শিশু।

শিক্ষকরা আজও লেখাপড়া করার উপায় হিসেবে শারীরিক শাস্তিকেই উত্তম উপায় হিসেবে বোঝেন। শারীরিক শাস্তির ভয়ে যে ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া করে না এমন নয়। শাস্তি প্রদানও একটি উপায় হিসেবে একসময় ছিল। কিন্তু এই পদ্ধতিটি অস্থায়ী এবং একরকম বল প্রয়োগপূর্বক গেলানোর মতো অবস্থা। যা মনের ওপর চাপ বৃদ্ধি করে এবং যে পড়া প্রস্তুতের জন্য শাস্তি দেয়া হয়, তা খুব বেশি সময়ের জন্য মনে থাকে না। কারণ যে পাঠের সঙ্গে আনন্দ নেই, সেই পাঠ মস্তিষ্ক বেশিদিন ধরে রাখতে পারে না। কিন্তু এই পদ্ধতিটি সেকেলে এবং আধুনিক বিজ্ঞান বিষয়টিকে মোটেই সমর্থন করে না। স্কুল ভীতি বা অনীহার একটি বড় কারণ হলো এই শাস্তি প্রদান। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে ছাত্রছাত্রীকে শাস্তির পরিবর্তে উৎসাহমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেয়া হয়। উৎসাহ প্রদান বা পড়ালেখায় মনোযোগী করতে ইতিবাচক পদ্ধতি গ্রহণের বহুবিধ সুবিধা রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হলো বিদ্যালয়ের প্রতি শিক্ষার্থী কখনোই উৎসাহ হারায় না এবং যে পাঠ আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়, তা অপেক্ষাকৃত স্থায়ী। শারীরিক শাস্তির পাশাপাশি মানসিক শাস্তিও কম প্রভাব ফেলে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, দেশের ১ থেকে ১৪ বছর বয়সি ৮৯ শতাংশ শিশু জরিপ-পূর্ববর্তী ১ মাসের মধ্যে শারীরিক শাস্তির শিকার হয়েছে। বিশ্বের ৬৫টি দেশ সব জায়গায় (বাড়ি, বিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র, বিকল্প শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান) শিশুদের শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করে আইন করেছে। দেশে এমন আইন এখনো হয়নি। শারীরিক শাস্তি শরীরে প্রভাব ফেলে আর মানসিক শাস্তি অনেক সময় মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। একটি দীর্ঘ সময় ধরে শিশুর মনে যে নেতিবাচক বক্তব্য যা শিশুর উদ্দেশ্য নিয়ে করা হয় তা পরবর্তীতে প্রভাব ফেলতে বাধ্য। পরীক্ষা বা মূল্যায়ন বিষয়টি এতদিন এই আনন্দময় কৌশলের একটি প্রতিবন্ধক ছিল। তবে সম্প্রতি তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না নেয়ার সিদ্ধান্ত ছাত্রছাত্রীকে পাঠে আনন্দময় করে তুলবে বলে মনে হয়। এ বিষয়টি ছাড়া বিদ্যালয়ে শাস্তি প্রদান বিদ্যালয় বিমুখতার অন্যতম কারণ। একটি আনন্দময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে মূল ভূমিকা পালন করবেন শিক্ষকরা। যেহেতু দিনের একটি বড় সময় তারা স্কুল-কলেজ পার করে, ফলে তাদের সঙ্গে শিক্ষকদের সম্পর্ক উন্নয়নে জোর দিতে হবে। না হলে স্কুল ফোবিয়া কোনোদিনই কাটবে না। কখনোই স্কুল-কলেজ কোনো আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠবে না। পূর্ণ বয়সে স্কুল-কলেজের স্মৃতি যতই মধুর হোক না কেন, যে সময়ে তার স্কুল ভালো লাগার কথা, সে সময়ে অনাগ্রহ থেকে আগ্রহী করে তুলতে হবে। শুধু পাঠ্যবইয়ের পাতায় আবদ্ধ করে রাখলে চলবে না, আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে আরো অনেক সময় লেগে যাবে। তাছাড়া শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নয়, বাড়িতেও শারীরিক শাস্তি প্রদান করা উচিত নয়। সময় বদলেছে, যুগ এগিয়েছে মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বের করে দেখেছেন, শিশুকে শারীরিক শাস্তি প্রদান তার মনে ভীতির সৃষ্টি করে। যা তার শিখন ঘাটতি অগ্রসর হলেও তা স্থায়ী হচ্ছে না। এর ফলে শ্রেণিকক্ষে শাস্তি বা তিরস্কারের পরিবর্তে শিশুকে উৎসাহ প্রদান করা উচিত। এক্ষেত্রে শিক্ষকের ব্যক্তিগত মোটিভেশনাল কৌশল গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তার ছাত্রছাত্রীকে কীভাবে ম্যানেজ করবেন, সেই কৌশল তার নিজের। তবে অবশ্যই শারীরিক বা মানসিক শাস্তি বাদ দিয়ে অন্য কোনো কৌশল অবলম্বন করতে হবে। এ বিষয়ে সরকার থেকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও দিকনির্দেশনাও রয়েছে। সেসব কাজে লাগাতে হবে। এটা শুনতে বা দেখতে অত্যন্ত খারাপ যে কোনো শিক্ষক তার ছাত্রকে পিটিয়ে আহত করে হাসপাতালে ভর্তি করেছেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত