সাগরপথে বিদেশ যাত্রায় শীর্ষে বাংলাদেশ

বাড়াতে হবে সচেতনতা, জাগাতে হবে আশা

প্রকাশ : ১০ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মাত্র কয়েক দিন আগে ভূমধ্যসাগরে সংকটাপন্ন অবস্থা থেকে বাংলাদেশিসহ ৮৭ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীকে উদ্ধার করেছে ইতালির মানবিক সংস্থা ‘ইমার্জেন্সি’র উদ্ধারকারী জাহাজ ‘লাইফ সাপোর্ট’। উদ্ধারের সময় নৌকায় কোনো খাবার বা পানীয় ছিল না। ছিল শিশু ও সন্তানসম্ভবা নারী। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে এভাবেই ইতালি কিংবা ইউরোপের দেশগুলোতে যাচ্ছেন লাখো অভিবাসী। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ১৭ হাজার ১৬৯ জন সমুদ্রপথে ইতালি প্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছে, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। এরইমধ্যে ২৩ শতাংশ বাংলাদেশি নাগরিক, যা সংখ্যায় ২ হাজার ৬৭০ জন। এই পরিসংখ্যান বাংলাদেশকে সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার তালিকায় শীর্ষে রেখেছে। বাংলাদেশের পরেই রয়েছে সিরিয়া, সাগরপথের অভিবাসীদের মধ্যে যাদের অনুপাত ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ এবং সংখ্যায় ২ হাজার ৮৪ জন। এই তালিকায় আরো আছে- তিউনিশিয়া, মিশর, গিনি, পাকিস্তান, মালি, গাম্বিয়া, ইরিত্রিয়া, সুদান, ইথিওপিয়া ও সেনেগালের মতো দেশ। ২০২৩ সালে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ প্রবেশে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ ছিল। ২০২২ সালে ছিল তৃতীয় এবং এর আগে ২০২১ সালে এই তালিকায় শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। ২০২০ ছিল দ্বিতীয় অবস্থানে। এবার ফের ৩ মাসে আবার এখন শীর্ষ অবস্থানে চলে এসেছে বাংলাদেশ।

ইউএনএইচসিআর’র তথ্য অনুযায়ী, এই বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৫ মে পর্যন্ত ৫৪ হাজার ৪১৮ জন অভিবাসী ইউরোপে পৌঁছেছেন। আর এদের মধ্যে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছে ৫২ হাজার ২৬ জন। তাদের মধ্যে ৫৪৭ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী নিখোঁজ অথবা মৃত্যুবরণ করেছেন, শুধু ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়েই। আর স্থলপথে ইউরোপে প্রবেশ করেছেন ২ হাজার ৩৯২ জন। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার মহাপরিচালক অ্যামি পোপ গত মঙ্গলবার ঢাকায় তাদের ওয়ার্ল্ড মাইগ্রেশন রিপোর্ট-২০২৪ প্রকাশ অনুষ্ঠানে জানান, সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার সময় মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ১২ শতাংশ বাংলাদেশি নাগরিক। সমুদ্রপথে যাওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীরা মূলত ইউরোপের দেশ- ইতালি, স্পেন, গ্রিস, সাইপ্রাস ও মাল্টায় প্রবেশ করেন। তবে বাংলাদেশিরা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন ইতালির পথ। সংস্থাটির ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত তথ্য বলছে, সমুদ্র পাড়ি দিয়ে গ্রিসে সবচেয়ে বেশি যায় আফগানিস্তানের নাগরিকরা। এরপর আছে সিরিয়ার নাগরিকরা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান অফিস ইউরোস্ট্যাটের তথ্য বলছে, গত বছর ইউরোপে নতুন আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ২০ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ আছে পাঁচ নম্বরে। ২০২৩ সালে ৪০ হাজারের কাছাকাছি বাংলাদেশি নাগরিক প্রথমবারের মতো ইউরোপে আশ্রয় নেওয়ার আবেদন করেছে। সংস্থাটির তথ্য বলছে, ২০২২ সালে আশ্রয় আবেদন করা ৭ হাজার বাংলাদেশির মধ্যে মাত্র ৫ হাজার ৩৮০ জনের আবেদন নাকচ করা হয়েছে। ওই বছর ইতালির সরকারের কাছে আশ্রয়ের মোট আবেদন করেছিলেন ১৪ হাজার ৫৯০ জন, যা ২০২২ সালের শীর্ষে ছিল। এই আবেদনের মধ্যে ৬ হাজার ৮২১ জনের আবেদন নাকচ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ওয়ার্ল্ড ডাটা ডট ইনফো।

মানবপাচারের মতো ঘটনা তদন্ত কর্মকর্তাদের মতে, ভিজিট ভিসায় দুবাই, এরপর ইরান হয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করা হয়। সমুদ্র পাড়ি দেওয়া এসব ঘটনা পর্যালোচনা করে জানা যায়, ২৬ থেকে ৪০ বছর বয়সিরা ইউরোপে ঢুকতে বেশি মরিয়া থাকেন। সিলেট, সুনামগঞ্জ, মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, ঢাকা, নোয়াখালী, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লা। এসব জেলা থেকে সবচেয়ে বেশি লোক এভাবে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। একেকজন খরচ করেছেন ৩ থেকে ১৫ লাখ টাকা। সমুদ্রপথে এরকম যাত্রাকে পাচারকারীদের ভাষায় বলা হয় ‘গেম’। ভূমধ্যসাগর হয়ে অবৈধভাবে ইউরোপ প্রবেশের আগে অভিবাসীদের অপেক্ষা করতে হয় লিবিয়ার ত্রিপোলির উপকূলীয় এলাকার একটি ঘরে। কয়েকদিন দিন সেই ঘরে চলে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার প্রশিক্ষণ। আর এখানেই শুরু হয় পাচারকারীদের ‘গেম’। ইতালি পৌঁছাতে পারা-না পারায় নির্ধারণ হয় এই ‘মরণ গেমের’ জয়-পরাজয়। ফেসবুকের বিভিন্ন পেজ এবং গ্রুপ আছে এমন, যেখানে প্রতিনিয়ত ‘গেম’-এর খবর প্রকাশ করা হয়। প্রতিদিন এই খবর প্রচার করে ‘সাফল্য’ দেখানো হয়, আর তাতে উদ্বুদ্ধ হয় তরুণরা।

সরকারের উদ্যোগে দেশে মানবপাচারের ওপর করা প্রথম জাতীয় গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় ২০২২ সালের অক্টোবরে। এতে বলা হয়, সারা দেশে আদালত ও পুলিশের কাছে মানবপাচারের বিপুলসংখ্যক মামলা করা হয়। ২০১২ সালের মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন এবং ৭টি বিভাগে প্রতিষ্ঠিত মানবপাচারবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ সংক্রান্ত অপরাধের বিচারের পরিধি প্রসারিত করেছে। তারপরও মামলা চূড়ান্ত করা ও সাজা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অর্থনৈতিক চাহিদার কারণে বাংলাদেশে মানবপাচারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যদিও বাংলাদেশ ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে এবং ২০১০-এর দশকের শেষের দিকে দারিদ্র্যের হার প্রায় ৩০ শতাংশ হ্রাস করেছে, এরপরও গ্রামীণ অঞ্চলে বসবাসকারী অনেক লোক সীমিত অর্থনৈতিক সুযোগ ও দারিদ্র্যসীমার ভেতরেই রয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশসহ উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে আয়-উপার্জনের ভালো সুযোগের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষদের পাচারকারীরা প্রলুব্ধ করে থাকে। সাগরপথে ইউরোপে যাওয়ার দিক থেকে বাংলাদেশ আজ প্রথম। এই তথ্য আমাদের জন্য লজ্জার। বাংলাদেশের সঙ্গে এই তালিকায় আছে সিরিয়া, আফগানিস্তান, সুদান ও ইরিত্রিয়ার মতো দেশগুলো। এগুলো যুদ্ধ ও দারিদ্র্যপীড়িত দেশ। বাংলাদেশের অবস্থা কিন্তু এমন নয়। তারপরও শুধু অলীক স্বপ্নে আমাদের লোকজন এভাবে ইউরোপে যাচ্ছে। পাচার প্রতিরোধে আমাদের যেমন সচেতন হতে হবে, তেমনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। শিক্ষিত মানুষরাও দেশ ছেড়ে কানাডার মতো দেশগুলোতে চলে যাচ্ছে, আসলে আমাদের সংকটা কোথায়; এটা খুঁজে বের করতে হবে। অভিবাসীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ছাড়াও দেশে-বিদেশে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা অত্যন্ত জরুরি। তারা কেন হতাশাগ্রস্ত হয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন, মারাত্মক ঝুঁকি নিচ্ছেন, তা নিয়ে আমাদের গবেষণা করতে হবে। দালালদের আইনের আওতায় আনতে হবে। যেসব দালাল লিবিয়া, তুরস্ক ও দুবাইয়ের ট্রানজিট পয়েন্টে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে প্রয়োজনে সেসব দেশের সরকারপ্রধানের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। আমাদের তরুণ প্রজন্ম নিজ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থায় ঘাটতি দেখেছে। যেই অর্থ দিয়ে তারা বিদেশ যায়, সেটি এখানে খরচ করে যে কিছু কাজ করা যায়, সেই অর্থ এখানে ব্যবহার করে জীবিকা নির্বাহে একটি নেতিবাচক ধারণা হয়েছে। অর্থপাচার, অনিয়ম তরুণদের অন্য দেশে যেতে প্রলুব্ধ করে। যেই টাকা খরচ করে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে, সেই টাকা বিনিয়োগে আস্থা পাচ্ছে না। দালালরা অনলাইনে এত সুন্দর করে প্রলুব্ধ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করে। এটাকে কাউন্টার করার জন্য আমরা কোনো প্রেক্ষাপট তৈরি করতে পারিনি। এসব ঘটনা অভিবাসীদের সমুদ্রপথে যাওয়ার বিষয়ে প্রলুব্ধ করে। তাদের আশা দেখাতে হবে- আস্থা আনতে হবে যে, দেশেই তার টাকা দিয়ে কিছু করা সম্ভব।