ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জলাবদ্ধতা এবং ভয়ংকর বিপদ

প্রদীপ সাহা
জলাবদ্ধতা এবং ভয়ংকর বিপদ

প্রায় সব জায়গাতেই এখন জলাবদ্ধতার সমস্যা প্রবলভাবে দেখা দিয়েছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এ যাবত শত শত কোটি টাকা খরচ করলেও ঢাকাবাসী মুক্তি পায়নি জলাবদ্ধতা থেকে। বছরের পর বছর প্রতিকার ও ব্যবস্থার কথা বলা হলেও এ সমস্যার এখন পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি। একটু ভারি বৃষ্টি হলেই রাজধানীর অধিকাংশ সড়ক ডুবে যায়। অনেক বাড়ির দোরগোড়ায়ও জমে থাকে হাঁটুপানি। এই জলাবদ্ধতার দুর্ভোগের মধ্যেই অফিসসহ নিত্যদিনের কাজ করতে হয় নগরবাসীকে। বৃষ্টির ফলে জলাবদ্ধতার এ বাস্তবতা যেন সহ্য করে নিয়েছে সবাই একরকম বাধ্য হয়ে। প্রায় দুই যুগ ধরে এ দুর্ভোগ রাজধানীবাসীর গা-সওয়া হয়ে গেলেও সমস্যা দূরীকরণে বাস্তবভিত্তিক স্থায়ী কোনো সমাধানই হচ্ছে না। সামান্য বৃষ্টিতে বেশিরভাগ সময়ই মিরপুর, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, রামপুরা, বাড্ডা, উত্তরা, মগবাজার, মালিবাগ, তেজগাঁও, শান্তিনগর, বংশাল, পুরান ঢাকা, খিলক্ষেতসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা একটি নিয়মিত চিত্র। বেশিরভাগ রাস্তায়ই প্রায় হাঁটু পর্যন্ত পানি জমে থাকে। কোথাও আবার কোমরপানি। পানিতে থইথই করে রাজপথ। নৌকাও চলতে দেখা যায় কখনো কখনো রাজপথে। জলাবদ্ধতায় যানবাহন চলতে না পারায় সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হয় রাস্তায়। পানিতে তলিয়ে যাওয়া রাস্তার যানজট পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় ট্রাফিক সদস্যদের। দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী। সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে অফিসমুখী যাত্রীরা পড়েন বিড়ম্বনায়। অনেক স্থানে মানুষের বাসাবাড়িতেও পানি প্রবেশ করে। সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হয় জনগণকে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, এতদিন ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসার ওপর। গত ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দুই সিটি করপোরেশনকে এ দায়িত্ব দেয়। ঢাকা ওয়াসা ও সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, গত এক যুগে জলাবদ্ধতা নিরসনে কমপক্ষে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। দায়িত্ব পাওয়ার পর সিটি করপোরেশন পানি নিষ্কাশনের জন্য কয়েকটি খালকে আবর্জনামুক্ত করে পানিপ্রবাহের ব্যবস্থা করে। তাছাড়া কয়েকটি বক্স কালভার্ট থেকেও বর্জ্য অপসারণ করা হয়। কিন্তু এতে কয়েকটি এলাকায় কিছুটা সুফল হলেও ভারি বৃষ্টিপাতে তেমন কোনো কাজে আসে না। জলাবদ্ধতা থেকে রেহাই পায় না এলাকাবাসী। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে ভারিবর্ষণ হলেই রাজধানীতে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। কর্তৃপক্ষ এ জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন আশ্বাস দিলেও তা যথার্থভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। প্রতিবছর সামান্য বৃষ্টি হলে একই চিত্র চোখে পড়ে এবং নগরবাসীকে একই ভোগান্তি পোহাতে হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানীর পানি নিষ্কাশনের পথগুলো আবর্জনায় ভরাট হয়ে থাকায় দ্রুত পানি নামতে পারে না। আর তাই প্রতিবারই এমন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকার পানি সরে যাওয়ার কোনো পথই খোলা নেই। তাই এখন কোনো কোনো স্থানে হাঁটুপানির জলাবদ্ধতা কোমড়পানির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির পানির এ জলাবদ্ধতায় আবারও সামনে ওঠে আসছে খালের কথা। খালগুলো ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি হওয়ার ফলে বৃষ্টির পানি সেই খালে সরতে পারছে না। তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় এখন কাগজে-কলমে মাত্র ২৭টি খাল রয়েছে। একসময় এই খালের সংখ্যা ছিল ১১৭টি। বৃষ্টির পানি দ্রুত সরানোর ব্যবস্থা না থাকলে পানি তো জমবেই। সূত্রে জানা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বৃষ্টির পানি সরানোর জন্য আছে ২৫ হাজার কিলোমিটার খোলা ড্রেন এবং ৪ হাজার কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ ড্রেন। কিন্তু এসব ড্রেন পরিষ্কার থাকে না। ৪০ ভাগেরও বেশি ময়লা-আবর্জনা জমে থাকে এসব ড্রেনে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ঢাকায় প্রতিদিন ১৫ লাখ ঘনমিটার বর্জ্য উৎপাদিত হয়, যার একটি বড় অংশ এসব ড্রেনে প্রবেশ করে। অন্যদিকে, ঢাকায় কংক্রিটের স্থাপনা আছে ৮৫ ভাগের মতো। এর ফলে ৯০ ভাগ পানি ড্রেনে চাপ সৃষ্টি করে এবং এ চাপ নেওয়ার মতো অবস্থা ড্রেনগুলোর নেই। অর্থাৎ খুব সহজেই বুঝা যাচ্ছে, স্বাভাবিক পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা আমরা ধ্বংস করে ফেলেছি। আর এ সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে আমাদের দ্বারাই।

সাধারণভাবে ঘণ্টায় ৪০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি না হলে ঢাকায় জলাবদ্ধতা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এখন দেখা যায়, ঘণ্টায় মাত্র ১০ মিলিমিটার সাধারণ এবং স্বাভাবিক বৃষ্টিতেই ডুবে যায় ঢাকা শহর, যেখানে প্রায় দেড় কোটি মানুষের বসবাস। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, সামনে আরো বেশি জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে এবং ঘরে ঘরে পানি ঢুকবে। এর কারণ, উন্নয়নের বিভিন্ন প্রয়োজনে ড্রেনেজ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পানি সরতে পারছে না। ড্রেন যা আছে, তা-ও কার্যকর নয়। বক্স কালভার্টের গভীরতা ছিল যেখানে ৯ থেকে ১১ ফুট, এখন তা আছে মাত্র দেড় থেকে ২ ফুট। এসব সমস্যা দেখার যেন কেউ নেই! বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জনশুমারির (২০২২) প্রাথমিক প্রতিবেদন বলছে, রাজধানী ঢাকায় ১ কোটি ২ লাখেরও বেশি মানুষ বসবাস করে। জলাবদ্ধতা মানুষের জীবনে নানাভাবে দুর্ভোগ তৈরি করে; চলাচলের ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। জলাবদ্ধতা অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি করে। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বছরে জলাবদ্ধতার কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ গড়ে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। এখন এই ক্ষতির পরিমাণ তো আরো বেশি।

জলাবদ্ধতার কারণে নগরীতে ভোগান্তি ও হয়রানি যেন এক স্থায়ী রূপ নিয়েছে। প্রতি বছর এ কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হলেও এর বাস্তব কোনো স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। দিনে দিনে ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে জলাবদ্ধতার চিত্র। সামান্য বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় শহরের দুই-তৃতীয়াংশ স্থান এবং দীর্ঘ সময় পর্যন্ত জলমগ্ন থাকে বিভিন্ন সড়ক ও জনপদ। নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করেন, জলাবদ্ধতা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা দ্রুত গ্রহণ না করলে অল্প বৃষ্টিতেই আরো অনেক সমস্যার সৃষ্টি হবে।

এ জলাবদ্ধতায় সৃষ্টি হবে নগর বন্যা। এজন্য প্রয়োজন যথাশিগগির স্থায়ী প্রতিকার এবং সুপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প। আমাদের সবার দায়িত্ব নিষ্ঠাই এ জলাবদ্ধতা ও সড়কডুবি সমস্যার দ্রুত সমাধান করতে পারবে। প্রয়োজনে পানি নিষ্কাশনের জন্য ওয়াসা, সিটি করপোরেশন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডকে একত্রে কাজ করতে হবে। বিশেষজ্ঞ মহল মনে করেন, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য প্রাকৃতিক আঁধারগুলোকে অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে। এজন্য নদী-খাল দখলমুক্ত করে পানি নিষ্কাশনের সহজ ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসনে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করারও প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, আমাদের ফেলে রাখা ময়লা-আবর্জনাই জলাবদ্ধতা সৃষ্টির অন্যতম কারণ। আমরা যদি সচেতন না হই, তাহলে এ জলাবদ্ধতা একদিন আমাদের ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে ঠেলে দিবে- এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত