ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পৃথিবীর সেরা মা আমার মা

মো: হেদায়েত উল্লাহ তুর্কী
পৃথিবীর সেরা মা আমার মা

পৃথিবীর সব মা সেরা মা। এক মায়ের সঙ্গে আরেক মায়ের কোনো তুলনা করতে হয় না। তবুও বলতে ইচ্ছে হয় পৃথিবীর সেরা মা আমার মা। চরম ধর্মীয় গোড়ামি পরিবারের মধ্যে থেকে তৃতীয় শ্রেণি পাস মা আমাদের চার ভাই বোনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করাতে সক্ষম হয়েছেন। ছোটবেলায় বাড়ি থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে নানা বাড়ির গ্রামের প্রাইমারিতে আমি এবং হাইস্কুলে আমার বড় বোন পড়তাম। মাওলানা সাহেবের নাতি-নাতনি এবং মাওলানা সাহেবের ছেলেমেয়ে হিসেবে সেখানে লেখা পড়া করার কারণে আমাদের নানা বাড়ির এবং পাশের গ্রামের ফুফু বাড়ির লোকজনের দোজখের যাওয়ার সম্ভাবনার ভয়ে আমাদের বাধ্য করেন স্কুল পরিবর্তন করতে। মায়ের অদম্য ইচ্ছায় গ্রাম ছেড়ে আমাদের ভর্তি করানো হয় শহরের পিটিআই এবং সরকারি গার্লস হাইস্কুলে। গ্রামের কৃষক পরিবারে বেড়ে উঠা বাবা আমার একটি বেসরকারি মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে কতই বা বেতন পেতেন। মা প্রতি সাপ্তাহে গ্রাম থেকে চাল, তরিতরকারী নিয়ে নিজে শহরে আসতেন অথবা কেউ শহরে আসলে তাদের অনুরোধ করে তাদের কাছে দিতেন। আর্থিক অনাটনে একসময়ে ফিরে যায় গ্রামে। গ্রাম থেকে ১০ কিলোমিটার দূরের হাইস্কুলে ভর্তি হয় দুই ভাই-বোন। মায়ের ইচ্ছা ছিল আমরা ডাক্তার হব। বাবা প্রতিদিন বাবার মাদ্রাসায় যাওয়ার সময় আমাদের দুই ভাই-বোনকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যেতেন, আবার আসার সময় নিয়ে আসতেন। ছোট বোন তখন গ্রাম থেকে দুই কিলোমিটার দূরের নদীর ওপারের একটা গার্লস স্কুলে এবং ছোট ভাই ১৫ কিলোমিটার দূরের বাবার মাদ্রাসায় নিজে সাইকেল চালিয়ে প্রাথমিকে পড়ালেখা করত।

কৃষক পরিবারের সকল গৃহস্থলি কাজ সামলিয়ে মা আমাদের ঠিক সময়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি করে দিতেন এবং সন্ধ্যার পর ক্লান্ত শরীর নিয়ে হ্যারিকেনের আলোয় আমাদের চার ভাই-বোনকে পড়তে বসাতেন। তৃতীয় শ্রেণি পাস মা আমার নবম দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া আমাদের পড়ানোর চেষ্টা করতেন। মায়ের অদম্য ইচ্ছায় দুই চার ইউনিয়নের মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগে প্রথম নারী শিক্ষার্থী হিসেবে বড় বোন এসএসসি পাস করেন। পরবর্তীতে আমি স্টারমার্কসহ আমি বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পাস করি। পর্যায়ক্রমে সকলে ভালো ফলাফল করে আজ বড় বোন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার, ছোট বোন মাস্টার্স শেষ করে গৃহিণী এবং ছোট ভাই জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার। আমাদের এই সফলতার জন্য আমার মাকে যে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, ইতিহাসে তা বিরল হয়ে থাকবে।

ধর্মীয় পরিবারে জন্ম নিয়ে আরবি শিক্ষায় শিক্ষা লাভ না করে সাধারণ শিক্ষার জন্য স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করার কারণে আমরা দাদা বাড়ি, নানা বাড়ি, ফুফু বাড়িসহ প্রায় সকল আত্মীয়-স্বজনদের থেকে ঘোষিত এবং অঘোষিত দুই প্রকারেই নিষিদ্ধ হয়েছিলাম। আমাদের শিশু-কিশোরকাল বা মায়ের যৌবনকালে আমরা একপ্রকার গৃহবন্ধী হয়ে কাটিয়েছি আত্মীয়-স্বজনের কটুকথা শোনার ভয়ে। ছোটবেলায় দেখতাম সব মায়েরা তাদের সন্তান নিয়ে বাবার বাড়িতে যেতেন; কিন্তু আমার মা যেতে পারতেন না। আমাদের মানুষ করতে গিয়ে মা তার জীবনে বাবা-মা, ভাই-বোনসহ সব আত্মীয়-স্বজনের আদর, স্নেহ, ভালোবাসা, আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা কিম্বা চাকরিতে যোগদানের দিন পর্যন্ত মা আমাদের সঙ্গে থেকেছেন। মা মনে করেন, এখনো আমরা ছোট আছি। মা, মা মুরগির মতো নিজের পাখনার নিচে আমাদের নিরাপদে রাখতে চান, তাইতো এখনো প্রতিদিন কমপক্ষে একবার করে সবার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলে সাহস জোগান এবং পাশে থাকার কথা বলেন। ২০১৭ সালে আজাদ প্রডাক্ট আয়োজিত রত্নগর্ভা অ্যাওয়ার্ড পেয়ে মা আমার ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কেঁদেছিলেন এবং বলেছিলেন আজ চোখের জলে আমার জীবনের সব দুঃখ-কষ্ট দূর হয়ে গেল, কারণ আজ আমি আমার কষ্টের স্বীকৃতি পেয়েছি। সারা জীবন আমাদের জন্য জীবন উৎসর্গ করে চলা মা বিগত ১০ বছর ধরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত আমার বাবাকে নিরলস সেবা করে যাচ্ছেন। তাইতো চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে পৃথিবীর সেরা মা আমার মা। পৃথিবীর সব মায়েরা ভালো থাকুক- কারণ পৃথিবীর সব মায়েরাই সেরা মা।

লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত