দেশের কৃষক পর্যায় থেকে শুরু করে প্রতিটি পদে পদে অতি মুনাফার বিষয়টি ছড়িয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচএম সফিকুজ্জামান। গত শুক্রবার বিকালে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের সভাকক্ষে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কার্যক্রম শক্তিশালীকরণ বিষয়ক এক সেমিনারে তিনি এই মন্তব্য করেন। অধিদপ্তরের সহযোগিতায় এই সেমিনারের আয়োজন করে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সফিকুজ্জামান বলেন, আমাদের ওপর মানুষের অনেক প্রত্যাশা থাকে। আমরা হয়তো অনেক কিছু করতে পারিনি। টিভির খবরে দেখলাম পেঁপের কেজি ১০০ টাকা হয়ে গেছে। সকাল বেলা আমি বাজারে পাঠিয়েছি, আমার এলাকার বাজারে পেঁয়াজ কিনেছে ৭৫ টাকা কেজি। আলুর দামও কিন্তু ৫৫-৬০ টাকা। এখন এটা হওয়া উচিত ছিল কি না- এটাই বড় প্রশ্ন। কেন এটি হচ্ছে, সেটা আমরা সবাই জানি। আমাদের এখানে প্রতি পদে পদে অতি মুনাফার বিষয়টি ছড়িয়ে গেছে। পাশাপাশি আমাদের নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১৫ শতাংশ। এটাই বাস্তবতা। সেই বাস্তবতা থেকে ভোক্তা অধিদপ্তর বা ক্যাবের খুব বেশি কিছু করার সুযোগ আছে বলে এই মুহূর্তে আমার মনে হয় না। এখন আলুর মৌসুম চলছে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, এখন কেন আলুর দাম ৬০ টাকা হবে? একইভাবে আমাদের পেঁয়াজের মৌসুমের প্রথম সময় চলছে। সাধারণত আমাদের আগস্ট বা অক্টোবর-নভেম্বরে দাম বাড়ে। সেখানে এখন কেন এত অস্থিরতা। এই জায়গাগুলোতে আমরা কাজ করতে গিয়ে যেটা দেখলাম, কৃষক থেকে শুরু করে প্রতিটি ধাপে ধাপে পণ্যের দাম বাড়ে। এটি তো হওয়া উচিত ছিল না।
নকল পণ্যে বাজার ভরে গেছে বলেও মন্তব্য করেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। তিনি আরো বলেন, কারওয়ান বাজারে অভিযান পরিচালনা করে দেখা গেছে, নকল কফি বিক্রি হচ্ছে। পঁচা মিষ্টির মধ্যে ময়দা মিশিয়ে কাঁচাগোল্লা বানাচ্ছে। বাজারে পাকা কাঁঠাল, আম চলে এসেছে। সেগুলো কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো হচ্ছে। ডায়াবেটিসের স্ট্রিপ থেকে শুরু করে হার্টের বাল্বও নকল হচ্ছে। একদিকে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাচ্ছে, আবার যে জিনিসটা কিনছি সেটি কতটুকু নিরাপদ? আমাদের প্রতিটি স্তরে প্রতিটি ব্যক্তি যারা এগুলোর সঙ্গে জড়িত, তারা সুযোগ পেলে অতি মুনাফার লোভে এই কাজগুলো করছে। ভোক্তাদের এই অবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা যদি ভোক্তাদের জাগিয়ে তুলতে পারি, তাহলেই তাদের অধিকার আদায় সম্ভব। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে কিছু দুর্বলতা ও জনবল সংকট রয়েছে জানিয়ে সফিকুজ্জামান আরো বলেন, ১৭টি জেলায় অধিদপ্তরের কোনো কর্মকর্তা নেই। তারপরও সারাদেশে প্রতিদিন অধিদপ্তরের ৪০-৫০টি টিম দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন সংশোধনের কাজ চলমান। ভোক্তার ডিজি এই প্রথম বোধকরি দেশের বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করলেন। তিনি সরকারের একজন আমলা। তার মুখ দিয়ে তো এমন সমালোচনামূলক বক্তব্য সাধারণত আসার কথা নয়। তিনি বোধহয় ইদানিং নিজে হাটবাজার না করলেও কাউকে দিয়ে হয়তো করান। নিজের সংসারের বাজার খরচ বেড়ে গেছে বলে আমাদের সাধারণ মানুষের মতো করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি যদি পণ্যের মূল্য নিয়ে প্রকৃত অর্থে বিক্ষুব্ধ থাকেন, তাহলে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে কেন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। তিনি তো আর আমাদের দেশের কোনো জনপ্রতিনিধি নন যে, তার ভোটের দরকার হবে। তিনি রাখঢাক করে কথা বলবেন। তিনি তো একজন আমলা। তিনি তার অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করবেন। পণ্যের মূল্য সহনীয় রাখা কিংবা অতিমুনাফা রোধ করার দায়িত্ব কি তিনি এড়াতে পারেন? সেই প্রশ্ন তো মানুষ করতেই পারে। আজ হয়তো তার বাজার খরচ বেড়ে গেছে বলে তার পকেট টান পড়েছে। তিনি মোটা অঙ্কের বেতন পান, তার তিনবেলা মাছ-মাংস-সবজি খাওয়ার সামর্থ্য রয়েছে। তবে সাধারণ মানুষ আর কতদিন এভাবে ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই করবে। মানুুষ না খেয়ে থাকে না কিংবা না খেয়ে মারাও যায় না। তবে কি খেয়ে জীবনযাপন করে, সেই খবর তো নিতে হবে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম চরম পুষ্টিহীনতার মুখোমুখি হচ্ছে। তারা যদি পরিবারের কর্তা ব্যক্তির স্বল্প আয়ের কারণে কিংবা বাজারে পণ্যের মূল্য অধিকহারে বেড়ে যাওয়ার কারণে কম পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করে, তাহলে আগামী দিনে তো সুস্থ ও সবল জাতি গড়ে উঠবে না। ভোক্তার ডিজির বক্তব্যে দেশে মানুষের মানুষের অভিব্যক্তির প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর তিনি যদি জনতার কাতারে আসতেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন, তাহলে তো আজ তার এ ধরনের ক্ষোভ প্রকাশ কিংবা প্রশ্ন করার সুযোগ থাকত না। তবে এখনো সময় আছে, বাজার তদারকি করুন, মাঠপর্যায়ে নজরদারি বাড়ান। বাজারের আসল খবরটি নিন। মাঠপর্যায়ের প্রকৃত অবস্থা কি, তা নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জানার চেষ্টা করুন। তাহলেই জনগণ উপকৃত হবে, দেশ উপকৃত হবে- একটি স্স্থু জাতি গড়ে উঠবে।