স্মার্ট বাংলাদেশ নতুন কারিকুলাম ও আমাদের প্রত্যাশা

ড. সৈয়দ নাজমুল হুদা

প্রকাশ : ১৩ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আমি যখন অনেক ছোট ছিলাম, তখন আমার মেঝ খালা বলত- লেখাপড়া শিখে যে, গাড়ি ঘোড়ায় চড়ে সে। লেখাপড়া শিখি আমরা চাকরির জন্য। গাড়ি-বাড়ির জন্য। শিক্ষাব্যবস্থায় লেখাপড়াটা চাকরিনির্ভর হয়েছে।

মানবিক, মনুষ্যত্ববোধ আর দেশাত্মবোধের সঠিক জন্ম দিতে না পারলে শিক্ষাব্যবস্থা অর্থহীন হয়ে পড়বে। ক্লাসের শিক্ষা বোঝার পর থেকেই দেখে আসছি, একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষাব্যবস্থায় লেখাপড়া, মুখস্থ ও পরীক্ষা এভাবেই করে থাকেন। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দেশে চলেছে এইভাবে শিক্ষাব্যবস্থা। একজন শিক্ষার্থী, শিক্ষক, শিক্ষার্থীর অভিভাবক সবাই এই ধারায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখাতে অভ্যস্ত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের নেতৃত্বে এদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন করে চালু হওয়া শিক্ষাক্রমে আর থাকবে না মুখস্থনির্ভরতা লেখাপড়া।

মুখস্থ করার পরিবর্তে নিজ দক্ষতা ও কাজের মধ্য দিয়ে ছাত্রছাত্রী আত্মস্থ করবে জ্ঞান। এতে করে পরীক্ষানির্ভর মূল্যায়ন ব্যবস্থাও বদলে যাবে। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, এতে করে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাতে আমূল পরিবর্তন আসবে। নতুন একটি ব্যবস্থা চালু হলে সেই ব্যবস্থার আশানুরূপ ফল পেতে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এক্ষেত্রেও বিদ্যমান কারিকুলামের পরিবর্তে নতুন কারিকুলামের দৃশ্যমান ফল পেতে আমাদের কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। তারপরেও যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে নতুন কারিকুলাম চালু করা হচ্ছে, সেটি আশানুরূপ ফল পেলে শিক্ষাপদ্ধতি স্বার্থক হবে। কতটুকু আশানুরূপ ফল হবে, সেটিই দেখার বিষয়। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা গতানুগতিক পরীক্ষানির্ভর মূল্যায়ন ব্যবস্থা না থাকায় নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে একাধিক অভিভাবক উৎকণ্ঠায় থাকলেও একসময় এটি সহনশীল ও গ্রহণযোগ্য হবে সবার কাছে এ পদ্ধতি। শিক্ষার্থীর একাডেমিক বিষয়ে প্রকৃত মূল্যায়নকারি শিক্ষার্থীর শিক্ষকরা। সুতরাং শিক্ষকের হাতে মূল্যায়ন পদ্ধতি এটি যথাপযুক্ত এবং সঠিক।

এই শিক্ষাক্রম সবটাই আউটকাম বেজড। শিক্ষার্থীরা তার নির্দিষ্ট ট্রপিকস সম্পর্কে আগে চিন্তা করবে। তারপর কাজ করবে। প্রথমে বুঝবে। সেটা শিখবে। পরে বাস্তবায়ন করবে। উন্নত বিশ্বে এ ধরনের কারিকুলাম চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল থেকে উন্নত বিশ্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শুধু যোগাযোগ কিংবা অবকাঠামোগত উন্নয়ন একটি দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত নয়। এই উন্নয়নে তার শিক্ষাপদ্ধতির একটি পরিবর্তন প্রয়োজন। এ কারণে আমাদের কারিকুলাম উন্নত বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন করার কাজ চলছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বর্তমান শিক্ষা মন্ত্রী ডা. দীপু মনি সফলভাবে কাজটি করছেন। এটি একটি সময় উপযোগী মাইলফলক সিদ্ধান্ত। এ পদ্ধতিতে কোনো শিক্ষার্থীকে কোনো শিক্ষক চাইলেও নম্বর দিয়ে অবমূল্যায়ন কিংবা অতিমূল্যায়িত করতে পারবেন না। করলেও সেটা হবে নীতিভ্রষ্ট কাজ। পরীক্ষা পদ্ধতি বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে সবার জন্য ব্যবস্থা করা হবে। পাশাপাশি প্রতিটি দিনই শিক্ষার্থীর জন্য একেকটি পরীক্ষা হিসেবেই কাজ করতে হবে। মেধার বিকাশ ও সৃজনশীলতা সৃষ্টিতে এটি একটি অন্যতম যুগোপযোগী কারিকুলাম। শিক্ষার্থীর মনে সৃজনশীলতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতি চালু করা হয়েছে ২০০৮ সালে দেশের মাধ্যমিক স্তরে। সৃজনশীল পদ্ধতিতে একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতার বিষয়টি মূল্যায়ন ও বিবেচনা করা হয়। সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতির বিষয়টিকে শুধু মাধ্যমিক স্তরে না রেখে পরবর্তী সময়ে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে দুই একটি বিষয় ছাড়া অধিকাংশবিষয় এই পদ্ধতির আওতায় আনা হয়েছে। ধীরে ধীরে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা পদ্ধতির সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে এবং উঠবে। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যা, গাইড, নোট বই, প্রাইভেট টিউটর, কোচিংয়ের সঙ্গে অতিপরিচিত। সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থীর মনের বিকাশ, তার বুদ্ধি, চিন্তার প্রখরতা বাড়ানোর জন্যই এই পদ্ধতি। সৃজনশীল পদ্ধতি একজন শিক্ষার্থীর মুখস্থ বিদ্যা পরিহার, গাইড বই ও কোচিংনির্ভরতা কমানোর একটি অন্যতম ব্যবস্থা। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, এই পদ্ধতি চালু হওয়ার পরেও আমাদের দেশের শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা সনাতন পদ্ধতির দিকেই বেশি আগ্রহী। শিক্ষার্থীরা কোচিংনির্ভরতা, প্রাইভেট পড়তে তারা যেমন আগ্রহী, তেমনি অভিভাবকরাও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। রেজাল্টনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় এ ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। আমাদের দেশেও এ কারণে নতুন কারিকুলাম নিয়েও একই সংশয় অভিভাবকদের মধ্যে দানা বেঁধেছে। পাশাপাশি একটি অপপ্রচারকারী মহল সব সময় ভালো কাজ হোক অথবা যেকোনো যুগোপযোগী সিদ্ধান্তের বিপক্ষে কিছু বলার প্রয়াস নিয়েই কথা বলতে পছন্দ করেন। বিরোধিতার তাগিদেই বিরোধিতা। তারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, কিছু তো বলতে পেরেছি। সেটা ভালো হোক কিংবা মন্দই হোক। আমাদের এ ধরনের মানসিকতা পরিত্যাগ করতে হবে। এ পদ্ধতিতে পড়ানোর ধরন, মূল্যায়ন ও পাঠ্যবইয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে এবং আসবে। আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে এবং ২০২৫ সালে চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম চালু হবে। এই একমুখী শিক্ষাব্যবস্থায় থাকবে না, নবম ও দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিক বিভাগের বিভাজন। এই কারিকুলামে নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি পড়ানো হবে। শিক্ষা মানুষের সুপ্ত চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটায়। মুখস্থনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা কখনোই একটি জাতিকে তার কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জনের সহায়তা করে না। আমাদের দেশে একজন শিক্ষার্থী বিজ্ঞান, মানবিক নাকি ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পড়বে, সেটি নির্ধারিত হতো নবম শ্রেণিতে বোর্ড রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে। কিন্তু এ পদ্ধতিতে বিভাগ বিভাজন হবে উচ্চমাধ্যমিকে। নতুন এই কারিকুলামের মাধ্যমে ২০২৬ সালে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এই কারিকুলামে প্রথাগত পরীক্ষা কমে যাবে। জিপিএর পরিবর্তে ফলাফল নির্ধারিত হবে। তিনটি ভাগে এই ফলাফল নির্ধারিত হবে। শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচিতে হবে এসএসসি পরীক্ষা। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে শিক্ষা বোর্ডের অধীনে দুটি পরীক্ষা হবে। নতুন এই কারিকুলামে প্রায় সব শ্রেণিতেই বড় অংশের মূল্যায়ন হবে শিখনকালীনের ভিত্তিতে। এটা আমাদের শিক্ষার্থীদের মানসিকতা এবং সুপ্ত জ্ঞান বিকাশে সহায়ক হবে।