রাজধানীর পুরো রাস্তাই যেন বাসস্ট্যান্ড

নির্দেশনা বাস্তবায়নে দরকার ধারাবাহিক কঠোরতা

প্রকাশ : ১৩ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

রাজধানীর পরিবহন কোম্পানিগুলো বিভিন্ন সময় নানা ধরনের নিয়মকানুন জারি করে। তাদের এই নিয়মকানুন জারির পেছনে থাকে ভাড়া বাড়ানোর অভিনব কৌশল। গেট লক, সিটিং সার্ভিস, এরইমধ্যে কোনো স্টপেজ না থাকা কিংবা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরিবহন পরিচালনা করা হয়। যাত্রীরা দুই-চার দিন এমন সার্ভিস পেয়ে সন্তুষ্টচিত্তে বাড়তি পয়সা দেন। দুই-চার দিন আরামণ্ডআয়াসে যাতায়াত করেন। তবে কয়েকদিন যাওয়ার পর বাসের শ্রমিকরা তাদের পুরোনো চরিত্রে ফিরে যায়। তারা তাদের প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গিয়ে আগের নিয়মে পরিবহন চালাতে থাকে। গেট লক কিংবা সিটিং সার্ভিস লেখাগুলো মুছে ফেলা হয়। হাত তুললেই বাস থামে, আর যেখানে খুশি সেখানে বাস থামে। এমন শহর ঢাকায় বসবাস করে প্রায় দুই কোটি মানুষ। রাজধানীর পুরোটাই যেন একটা বাসস্ট্যান্ড। রাজধানীর পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে যখন গণমাধ্যমে নানা আলোচনা-সমালোচনা যখন শুরু হয়, তখন ওই এলাকার পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ নানা রকম কঠোর নির্দেশনা জারি করে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে- এমন নির্দেশনা বাস-শ্রমিকরা পরোয়া করে না। গণমাাধ্যমে এসেছে রাজধানীতে যানজট কমাতে ও সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষায় মহাখালী থেকে ছেড়ে যাওয়া আন্তঃজেলা বাসগুলো ঢাকার মধ্যে যত্রতত্র না থামানোর নির্দেশ দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ ট্রাফিকের গুলশান বিভাগ। ট্রাফিকের গুলশান বিভাগের ডিসি আব্দুল মোমেন এই নির্দেশনার কথা জনিয়েছেন। তিনি বলেন, মহাখালী থেকে ছেড়ে যাওয়া আন্তঃনগর বাসগুলো টার্মিনাল থেকেই লোক উঠানোর জন্য থেমে থাকে। এভাবেই থেমে থেমে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত যাওয়ায় সড়কের বিভিন্ন স্থানে একটা যানজটের সৃষ্টি করে।

সড়কে এই জট দূর করতে দীর্ঘদিন ধরে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো যারা আছে, তাদের সঙ্গে কথা বলে আসছি। তারা কথা দিয়ে আসছিল, বাসগুলো যাত্রী উঠানামায় শৃঙ্খলা মানবে। সবশেষ এক সপ্তাহ সময় চেয়েছিল। সেটাও শেষ। আর এ কারণে এই নির্দেশনা। আন্তঃজেলা বাসগুলোর যাত্রীরা যেখানে-সেখানে নামার জন্য বাস চালকদের সঙ্গে যেমন ঝগড়া করে, তেমনি যাত্রী তোলার জন্য বাস শ্রমিককরা যাত্রীদের ব্যাগ-পটলা টানাটানা করে। অনেক সময় বাস-শ্রমিকরা জোর করে ব্যাগ-পটলা বাসে তুলে নেয়। আর যাত্রীরা থেকে যায় রাস্তায়। আবার নামার সময় যাত্রীদের পারলে গলাধাক্কা দিয়ে নিচে নামিয়ে দেয়া হয়। অনেক সময় বাসের ভেতর ব্যাগ থেকে যায়। আর যাত্রী নেমে যায় রাস্তায়। রাজধানীর বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড থেকে যাত্রীবাহী বাস বের হয়ে রাস্তায় যাত্রী তোলার জন্য চিৎকার-চেঁচামেচি করতে থাকে। তারা সড়ক পথে যাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে অযথা সময় নষ্ট করে। যেখানে-সেখানে বাস থামানো আর যেখানে সেখানে থেকে যাত্রী নেয়া যাত্রীবাহী বাসগুলোর প্রতিদিনের চরিত্র। যাত্রীর হাত আর ট্রাফিক সার্জেন্টের হাতের দিকে বাস শ্রমিকদের নজর বেশি। পুলিশ সার্জেন্ট বাস থামালে বাস-শ্রমিকরা কাগজপত্র নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় চালকের কাছ থেকে কিছু টাকাও নিয়ে যায়। নিজে ‘ম্যানেজ’ করতে পারলে তো কোনো কথা নেই। আর যদি নিজে না পারেন, তা হলে সার্জেন্টের নাম ও রাস্তার পয়েন্ট জানিয়ে দেন পরিবহনের নিজস্ব লাইনম্যানদের। নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর নিজস্ব লাইনম্যানদের অবস্থান। তারাই পরবর্তীতে সার্জেন্টের সঙ্গে ‘বোঝাপড়া’ করেন। তবে কখনো কখনো তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ সার্জেন্ট মেশিনের মাধ্যমে জরিমানার টাকা আদায় করে একটি স্লিপ দিয়ে দেন। এমন চিত্রই তো আমরা সাধারণ মানুষ রাস্তায় চলাফেরা করার সময় অবলোকন করি।

কখনো কখনো কোনো কোনো ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা আইনের প্রতি অবিচল থেকে তার দায়িত্ব পালন করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যেসব নির্দেশনা জারি করেন, তা প্রতিপালিত হয় কি না- সেই খবর তিনি নিজেও রাখেন না। আর আইনানুগ শাস্তির ব্যবস্থা করার কোনো দৃষ্টান্ত তো তেমন একটা রাস্তায় দেখা মিলে না। নির্দেশনার পর দুই-চার দিন হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়। তবে কয়েকদিন পর তা আবার যা তাই। রাজধানীর রাস্তার পাশে খালি ট্রাক ও লরিব যে সারি তা একটু খেয়াল করলেই আন্দাজ করা যায়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে আবাসিক এলাকায়ও বাস কাউন্টার গড়ে উঠেছে। সেখান থেকে যাত্রীবাহী বাস লোকজন তুলতে এবং নামাতে গিয়ে যে যানজটের সৃষ্টি হয়, সেটা ট্রাফিক পুলিশ জানে কি না- জানি না, তবে সাধারণ মানুষের চোখে এসব দৃশ্য আটকে যায়। যেসব পরিবহন ট্রাফিক নির্দেশনার বাইরে গিয়ে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠাণ্ডনামা করে, তাদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেয় ট্রাফিক বিভাগ। সেইসঙ্গে নগরবাসীকে বাস টার্মিনাল ছাড়া অন্য কোনো স্থান থেকে হাত উঠিয়ে বাসে না, উঠার অনুরোধ জানানো হয়। এসব নির্দেশনা কিংবা অনুরোধের কি কোনো প্রতিফলন ঘটে, সেই প্রশ্ন তো থেকে যায়। পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরানো সহজ কাজ নয়। কোনো নির্দেশনা কোনো অনুরোধ কাজে আসবে না, যদি ব্যক্তি পর্যায়ের চরিত্রের পরিবর্তন না হয়। প্রতিটি নির্দেশনা বাস্তবায়নে দরকার ধারাবাহিক কঠোরতা। দুই-চার দিন প্রতিপালন করার পর আবার আগের স্থানে কখনো ফিরে যাওয়া যাবে না। তাহলেই হয়তো সুফল পাওয়া যেতে পারে।