ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের আইনের আওতায় আনা হোক

মোশতাক আহমেদ
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের আইনের আওতায় আনা হোক

সম্প্রতি ভুয়া প্রমাণিত হওয়ায় আট হাজার ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। গত ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরে মুজিবনগর দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে খোদ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এ কথা জানিয়েছেন। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে তালিকাভুক্ত অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম বাতিল করা হয়েছে। বাতিলদের মধ্যে ছিলেন অনেক হোমরাচোমরা। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৯ থেকে ২০২৩- এই ৫ বছরে ২ হাজার ১৯০ ব্যক্তির নাম গেজেট থেকে বাতিল করা হয়। ২০১৪ সালে অন্তত পাঁচজন শীর্ষস্থানীয় আমলার সনদ বাতিল করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন খোদ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তবে এবারের মতো একসঙ্গে এত বেশি সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার ঘটনা আগে ঘটেনি। কয়েক দশক ধরেই মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় সংযোজন-বিয়োজন চলছে। বর্তমান সরকারের আমলেই (২০১৯ থেকে ২০২৩) নতুন করে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্তির জন্য ১০ হাজার ৮৯১ জনের নাম সুপারিশ করেছিল জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। গেজেটভুক্তির জন্য অনেকের নামে সুপারিশ করেছেন সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা। সুপারিশকারীদের মধ্যে জামুকার সদস্যরাও রয়েছেন। এরও আগে ২০০৯ থেকে ২০১৪- এই ৫ বছরে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পেশার মোট ১১ হাজার ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছিলেন। এ যেন এক অন্তহীন প্রক্রিয়া। যতটুকু জানা যায়, স্বাধীনতার পর অন্তত সাতবার মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে। আর বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার বয়স, সংজ্ঞা ও মানদ- পাল্টেছে ১১ বার। কিন্তু চূড়ান্ত কোনো তালিকা এখন পর্যন্ত করা সম্ভব হয়নি। ফলে নিরুপণ করা যায়নি মুক্তিযোদ্ধার সঠিক সংখ্যাও। মুক্তিযুদ্ধের পর সেক্টর কমান্ডার ও সাবসেক্টর কমান্ডারদের প্রকাশনা থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ৮০০ এবং অনিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭ হাজার। অর্থাৎ মোট ১ লাখ ৩১ হাজার ৮০০ জন। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৮ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে জেলা ও উপজেলা কমান্ডারদের নেতৃত্বে গঠিত যাচাই-বাছাই কমিটির মাধ্যমে প্রণীত একটি তালিকা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে সংরক্ষণ করা হয়। তাতে ১ লাখ ৫৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া যায়। এরপর ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারও ২০০৩ ও ২০০৪ সালে দুটি পৃথক তালিকা প্রকাশ করে। তাতে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৯৮ হাজার। ২০২৩ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে হয় ২ লাখ ৩৫ হাজার ৪৬৭ জন। স্বীকার করি, জাতীয় পর্যায়ের একটি তালিকা করতে গেলে কিছু মানবিক ভুল হতেই পারে। তাই বলে আট হাজারের বেশি ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’ তালিকায় প্রবেশ করেছিল! বর্তমানে একজন মুক্তিযোদ্ধা মাসে ২০ হাজার টাকা সম্মানি ভাতা পান। এ ছাড়া সরকারি, চাকরিজীবী হলে ২ বছর বাড়তি চাকরির নিশ্চয়তা। তাদের সন্তান-সন্ততিরা পান চাকরিক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনা। ক্ষেত্রবিশেষে চিকিৎসা, আবাসন, রেশনসহ নানা রকম সুযোগ-সুবিধা তো আছেই। এ ছাড়া বর্তমান প্রশাসনিক ব্যবস্থায় তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয় ক্ষমতা কাঠামোতে বেশ সুবিধা পেয়ে থাকেন। দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য জীবনবাজি রাখা মুক্তিযোদ্ধারা বিশেষ সম্মান ও সুবিধা পেতেই পারেন। এসব দেখে কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধ না করেও তালিকায় স্থান লাভের অপচেষ্টা করতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, যারা তালিকা প্রণয়ন, যাচাই-বাছাই, প্রকাশ করেছেন, তারা দক্ষতা ও সতর্কতার পরিচয় দিলেন না কেন?

জানা যায়, ২০০৩-২০০৪ অর্থবছরে প্রথম যখন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতা চালু করা হয়, তখন ৪০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন। অথচ ২০২৩ সালে জানুয়ারিতে এসে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ২ লাখ ১৯ হাজার ৭৫৮-তে! জানি, মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্তির বিষয়টি সহজ নয়। এ জন্য অনেক প্রশাসনিক ও আমলাতান্ত্রিক ধাপ পেরিয়ে আসতে হয়। প্রশ্নটা সেখানেই। একজন ব্যক্তি যখন মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্তির জন্য আবেদন করেন, তখন তাতে স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ অনেককেই সুপারিশ করতে হয়। অনেক ঘাট পেরিয়ে সবশেষে জামুকার সভায় তাকে অনুমোদিত হতে হয়। প্রশ্ন হলো, একজন অমুক্তিযোদ্ধা কেমন করে এতগুলো ঘাট ম্যানেজ করে? তাহলে কি ধরেই নেওয়া যায়, সরিষার মধ্যেই ভূত রয়েছে? আর সেই ভূতগ্রস্ত সরিষার সুযোগ নিচ্ছে অসৎ ও স্বার্থান্বেষী চক্র? আট হাজার ভুয়া ব্যক্তির মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিলের খবরটি প্রকাশের পর সামাজিকমাধ্যমে সমালোচনা শুরু হয়েছে- শুধু সনদ বাতিল করেই সাত খুন মাফ? পরে অবশ্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেছেন, যাদের সনদ বাতিল করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। অবশ্য অতীতে দেখা গেছে, সচিবের মতো শীর্ষ আমলাদের কেউ কেউ জালিয়াতি করে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে ২ বছর বাড়তি সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার পরও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং তাদের স্বেচ্ছায় অবসরের সুযোগ করে দিয়ে ‘সসম্মানে’ বাড়ি ফেরার পথ দেখানো হয়েছে। অথচ যে কোনো জালিয়াতিই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ধরনের অপরাধের জন্য সরকারি কর্মচারীদের চাকরি থেকে বরখাস্তসহ অন্যান্য গুরুদণ্ড দেওয়া যেত। আর মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতি মানে তো রাষ্ট্রের মূল সত্তার সঙ্গে জালিয়াতি! তখন রাঘববোয়াল-আমলাদের ছেড়ে দিয়ে এখন যদি ছোট ছোট পুঁটি জালিয়াতের বিরুদ্ধে ‘আইনি ব্যবস্থা’ নেওয়া হয়, সেটিই বা কতখানি গ্রহণযোগ্য? এক যাত্রায় পৃথক ফল হবে কেন?

আমার মতে, এখন ধরা পড়া জালিয়াতদের বিরুদ্ধে যেমন ব্যবস্থা নিতে হবে, তেমনই নিতে হবে অতীতের জালিয়াতদের বিরুদ্ধেও। মনে রাখতে হবে- একাত্তরে এ দেশের যেসব বীর সন্তান পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, তারা কোনো সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আশায় যুদ্ধ করেননি। তারা দেশকে ভালোবেসেই শুধু যুদ্ধ করেছেন। অথচ আজ কিছুসংখ্যক লোক তাদের নাম করে জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছে। এরা মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ উভয়কেই অপমান করছে। এ শুধু আইনের চোখেই অন্যায় নয়; জাতির জন্যও লজ্জাকর। আজ তাই দল-মত কিংবা পদণ্ডপদবি বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে সরকারকে এদের ব্যাপারে কঠোর হতে হবে; আনতে হবে আইনের আওতায়। সেই সঙ্গে তাদেরকেও, যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই জালিয়াতি প্রক্রিয়ায় জড়িত। এর মাধ্যমে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান আরো সমুন্নত হবে।

লেখক : সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা ও কলাম লেখক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত