লিফটে আটকে রোগীর মৃত্যু

দায় এড়ানোর ‘সুযোগ’ বন্ধ করতে হবে

প্রকাশ : ১৪ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

অনেক অসুস্থ মানুষও বহুতল ভবনের লিফটে না উঠার চেষ্টা করে থাকেন। লিফটে উঠার পর দরজা খুলবে কি না কিংবা লিফট একটানে উপরে কিংবা নিচে নেমে গিয়ে মানুষ হতাহত হবে কি না, সেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়েই মানুষ লিফটে উঠে। যারা শারীরিকভাবে অক্ষম থাকায় সিঁড়ি বেয়ে উপরের তলাগুলোতে উঠতে পারেন না, তারা নিরুপায় হয়ে লিফটে চড়েন। কিন্তু লিফটে উঠার পর তিনি যদি নিরাপত্তাহীনতা বোধ করেন, তা হলে মানুষ লিফটে উঠবেন কি না, তা নিয়ে সাতবার চিন্তাভাবনা করবেন। কোনো কোনো লিফটের মধ্যে একজন কর্মীর মোবাইল নম্বর দিয়ে বলা হয়- লিফটের মধ্যে কোনো রকম অসুবিধা হলে ওই নম্বরে ফোন করতে হবে। কখন লিফটে মানুষ আটকা পড়বেন, সেটা শুধু মহান সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন। আমরা যারা এ দেশে জন্মগ্রহণ করেছি, তাদের সবসময় মৃত্যুর আতঙ্ক নিয়ে থাকতে হয়। লিফটম্যান কোথায় কি করেন, সেটা যে কোনো সরকারি অফিসে গেলে টের পাওয়া সম্ভব। কয়টা পর্যন্ত অফিস, আর মাসে কত ঘণ্টা ওভারটাইম নেয়া হয়, সেই হিসাব জনগণের রাখার সুযোগ নেই। অথচ জনগণের করের পয়সায় একজন সরকারি কর্মচারীর বেতন ভাতা পরিশোধ করা হয়। গত রোববার গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লিফটে আটকা থেকে একজন রোগী মারা গেছেন। তার নাম মমতাজ (৫০)। তিনি গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার বারিগাঁও গ্রামের শরীফ উদ্দীনের স্ত্রী। হাসপাতালের লিফটে আটকে থেকে রোগী মৃত্যুর ঘটনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। চিঠিতে ‘লিফটে আটকে পড়া রোগীসহ লোকজন দরজা ধাক্কাধাক্কি করায় লিফটের দরজার নিরাপত্তাব্যবস্থা কাজ করেনি’ বলে দাবি করা হয়েছে। হাসপাতালের পক্ষ থেকে চিঠিটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. জাহাঙ্গীর আলম ও গণপূর্ত ই/এম বিভাগ-১০ ঢাকার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবদুল হালিম। ওই চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, লিফটে রোগীসহ অন্যরা ৪৫ মিনিট নয়, মাত্র ১০-১৫ মিনিট আটকে ছিলেন। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রওশন এন্টারপ্রাইজের সরবরাহকৃত মোভি ব্র্যান্ডের একটি লিফট গত রোববার বেলা সোয়া ১১টার দিকে ৯ম ও ১০ম তলার মাঝামাঝি রোগী ও রোগীর দর্শনার্থীসহ হঠাৎ আটকে যায়। প্রাথামিকভাবে লিফটটি বিদ্যুৎ–বিভ্রাটের জন্য আটকে গেলে অটোমেটিক রেসকিউ ডিভাইস কাজ করার জন্য এক মিনিট সময়ের প্রয়োজন হয়। কিন্তু লিফটে আটকে পড়া রোগীসহ লোকজন দরজা ধাক্কাধাক্কি করায় লিফটের দরজার নিরাপত্তা কাজ করেনি।’

চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, ‘পরবর্তী সময়ে লিফট অপারেটর লিফট মেশিন রুমে হাত দিয়ে ম্যানুয়ালি লিফটটি একটি ফ্লোরে আনার আগেই রোগীসহ লোকজন দরজা খুলে বের হয়ে আসেন। এসব কাজসম্পন্ন হতে ১০-১৫ মিনিট সময় অতিবাহিত হয়। মমতাজ হার্টের রোগী ছিলেন। তাৎক্ষণাৎ রোগীকে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয় এবং চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’ মাঝপথে ত্রুটি দেখা দেওয়া লিফটটি আগে থেকে ত্রুটিপূর্ণ ছিল না দাবি করে চিঠিতে বলা হয়েছে, লিফটটি নিয়মিত সার্ভিস ও মেইনটেন্যান্স করা হয়। বর্তমানে লিফটি চালু আছে। আটকে পড়া রোগীসহ অন্যরা দরজায় ধাক্কাধাক্কি করায় লিফটির সমস্যা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে জানিয়ে চিঠিতে ভুল তথ্য প্রচারের জন্য গণমাধ্যমকে দোষারোপ করা হয়েছে। সেখানে দাবি করা হয়েছে, রোগী ৪৫ মিনিট লিফটে আটকা পড়ে ছিলেন বলে যে তথ্য গণমাধ্যমে এসেছে, সেটি সঠিক নয়। চিঠিটির ভাষা অত্যন্ত গোছাল, চমৎকার এবং আত্মপক্ষ সমর্থনযোগ্য। যারা ওই সময় লিফটে ছিলেন, তারা কেন ধাক্কাধাক্কি করলেন, সে জন্য তাদের নামে হয়তো মামলা করতে পারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কেন না, তাদের ধাক্কাধাক্কির কারণে লিফটের নিরাপত্তাব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে। সে কারণে তাদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে। আর গণমাধ্যম কোনো রোগী ৪৫ মিনিট লিফটে আটকা পড়ে ছিলেন, এমন খবর প্রকাশ করল সে জন্যও হয়তো মানহানিকর মামলা হতে পারে। আমাদের দেশের গণমাধ্যমে যখন কোনো খবর প্রচার হয়, তখন কর্তৃপক্ষ সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করে। অধিকাংশ সময় দাবি করা হয়, গণমাধ্যমে নাকি তথ্যটি ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। গণমাধ্যম বিভিন্ন উৎস থেকে যেসব তথ্য জানতে পারে, সেগুলোই সন্নিবেশ করে প্রচার করে। ওই রোগী হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছে- এমন একটি সনদ পাওয়া গেলে হয়তো বলা যাবে, লিফটে আটকে রোগী মারা যাননি। মারা গেছে হার্ট অ্যাটাকে। আর সেটি হলে তো কারো কোনো বিচার কিংবা শাস্তি হওয়ার কথা নয়।

লিফট আটকে যাওয়া ও খোলার মধ্যে ১০-১৫ মিনিট সময় অতিবাহিত হয়েছে। এই সময়টি আসলে খুবই কম বলে কর্তৃপক্ষের চিঠির ভাষায় বোঝা যায়। তবে কর্তৃপক্ষের কর্তা ব্যক্তিরা একটু পরীক্ষা করার জন্য লিফটের মধ্যে অন্ধকারে ৫ মিনিট সময় কাটানোর পর তার মনের মধ্যে কি ধরনের অনুভূতি হয়, সেটা পরীক্ষা করলে বাস্তব অবস্থাটা অনুধাবন করতে পারবেন। আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যেসব কোম্পানি লিফটের মতো বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে, তারা বিল তোলা পর্যন্ত ওইসব যন্ত্রপাতির রক্ষণাবেক্ষণের প্রতি নজর রাখেন, এমন অভিযোগ মানুষের মুখে মুখে। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিল তুলে নিতে পারলে তার দায়দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়, এমনটা অনুভব করেন। যেহেতু লিফটে অনেক লোক ছিলেন, তার মধ্যে মাত্র একজন বৃদ্ধ নারী মারা গেছেন- এটা কর্তৃপক্ষের কাছে হয়তো তেমন কোনো বিষয় মনে হয়নি। তবে সাধারণ সচেতন মানুষ এই শিক্ষাটিই পেল যে, লিফটে আটকা পড়েও মানুষ মারা যেতে পারে। তবে তদন্ত কমিটি হোক আর যত চিঠি চালাচালি করা হোক। মারা গেছে একজন সাধারণ নারী। এ ক্ষেত্রে দায় এড়ানোর অনেক ‘সুযোগ’ আছে। তবে প্রত্যাশা থাকবে যেন দায়ী ব্যক্তির বিচারটা হয়। তা না হলে একদিন আমি-আপনি কিংবা আমাদের কোনো নিকটজন একইভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। তখন হয়তো অনুধাবন করতে পারবেন, লিফটে আটকে মৃত্যু কতটা আতঙ্ক ও বেদনার।