নারীর নিরাপদ পৃথিবীর খোঁজে!

রাজু আহমেদ

প্রকাশ : ১৬ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

কর্মক্ষেত্রে, পাবলিক পরিবহনে, জনাকীর্ণ আয়োজনে এমনকি ঘরে নারী নিরাপদ কি-না, এই প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে সঙ্গে সাপেক্ষ সম্পর্কে জড়িয়ে আছে, সব পুরুষ মানুষ হতে পেরেছে কি-না? ঘরে-বাইরে নারী-পুরুষের যে সম্পর্ক তা কখনো কখনো হতাশাজনক চিত্র জানায়। নারীর সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত আইন আছে; কিন্তু নারীর প্রতি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে কতখানি? সেটা এখনো বোধহয় সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছেনি। ঘরে-বাইরে নারীদের অশ্রাব্য বাক্যবানে এবং শারীরিকভাবে শ্লীলতাহানিতে বিপর্যস্ত করার ঘটনা অহরহ ঘটছে। কেউ কেউ নারীকে এখনো পণ্য হিসেবে পেতে চাইছে। কারো কারো থেকে নারীর শরীরের প্রতি বিকৃতমনস্কতার ভাষ্যরূপ বেরিয়ে আসছে। শারীরিক নির্যাতন, মানসিক লাঞ্ছনা এবং অধিকার বঞ্চনার মধ্য দিয়েই নারী এগিয়ে যাচ্ছে। এভাবেই রোজকার ডায়েরি লিখতে হচ্ছে।

নারী প্রগতির অন্তরালে শুধু পুরুষ নয় বরং কখনো কখনো নারীরাও অধিক হারে দায়ী। সেই নারীরাও আবার দূরের সম্পর্কের কেউ নয়! নিজের মা-খালা, আপন বোন কিংবা শাশুড়ি-ননদদের দ্বারা নারীরা আজকের সমাজে সবচেয়ে বেশি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একটা মেয়ের উচ্চশিক্ষিত হওয়া, নিজের পরিচয় খোঁজা এবং স্বাবলম্বিতা অর্জনের পথে বড় বাধা পরিবার থেকেই সর্বাগ্রে আসে। শত সংকট ও সংগ্রাম শেষে যে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে এবং সাফল্যের স্বপ্ন দেখছে সমাজ তাদের বার বার নিরুৎসাহিত করে, কটুকথা শোনায় এবং উপর্যুপরি বাঁধার সৃষ্টি করে। সভ্যতার বাতিঘর তথা শিক্ষালয়ে, পাবলিক পরিবহনে এবং কর্মক্ষেত্রেও নারীকে শারীরিক অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনে যেতে হয়। এমন শত বাধাবিঘ্ন উপেক্ষা করে নারীরা শিক্ষাক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করছে, আত্মপরিচয়ের দ্বারা বলীয়সী হচ্ছে এমনকি রাষ্ট্রীয় মর্যাদাকে বহিঃবিশ্বে বেগবান করছে।

একজন সফল পুরুষ এবং একজন সফল নারীর যাত্রাকালকে যদি পাশাপাশি রেখে বিচার করা হয়, তবে নারীর ক্ষেত্রে পরিবারে দৃষ্টভঙ্গি, সমাজের মন্তব্য এমনকি উচ্চশিক্ষিতদের পর্যবেক্ষণ ঘাত-প্রতিঘাতের হবে! সেখানে নারী প্রগতি-উন্নতির পক্ষের থেকে বিপক্ষের মতামত জোড়াল! মেয়েদের ক্ষেত্রে বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের ঘিরে আশা-আকাঙ্ক্ষার অন্ত থাকে না। এখানে পরিবার বলতে বাবা-মায়ের বাইরেও আরো কিছু আপনজনকে ইঙ্গিত করা চেষ্টা করেছি। সুযোগ সন্ধানীরা আঁধার গলিয়ে একটা মেয়ের সঙ্গে কি পরিমাণ পাশবিক আচরণ করতে পারে, সমাজস্থরা কত কত ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করতে পারে, তার নজির নতুনভাবে লিখতে হবে বলে মনে করছি না। বিজ্ঞ পাঠকের আশপাশেই প্রমাণ আছে। যে সমাজের কথিত শিক্ষিত এলিটদের অনেকেই নারীকে শুধু বিছানায় কল্পনা করে, কায়দা করে ফায়দা হাসিলের জন্য ওঁৎপেতে থাকে এবং নারীর জীবনকে রান্নাঘরের চার দেওয়ালে আটকে দিতে চায়, সেখানে নজরুলের সাম্যবাদের কবিতায় খুব বেশি পরিবর্তন সাধিত করবে- সেই আশাবাদ অনেকটাই অহেতুক। পুরুষ কলিগের কাছে নারী কলিগের নিপীড়ন, বাসে-রেলে সুযোগ পেলে নারীর শরীর ছুঁযে দেওয়া এবং ঘরে-বাইরে বুলিং করে নারীর মনোবল ভেঙে দেওয়া- এসব এই সমাজে এখনো বিরল নয়। অফিসের বস থেকে শুরু করে পাড়ার অকর্মা, সহযাত্রী থেকে শুরু করে সুযোগবাদী ছোকড়াটাও নারীকে নিয়ে পাছে মন্তব্য করে। শিস বাজানো, হাসাহাসি করা- এসব এখন নারীর জন্য নৈমিত্তিক সহনীয় আচরণ। যারা বিনয়কে দুর্বলতা ভাবে, যারা ভদ্রতাকে সুযোগ দেওয়া মনে করে এবং যাদের মধ্যে পারিবারিক পৈশাচিকতা আছে, তারা নারীকে বিছানায় কল্পনা করতে একটুও দ্বিধা করে না। তাদের বিবেক কখনোই সুপথে ক্রিয়াশীল থাকে না। ভাবছেন তাদের দ্বারা মা-বোন, বউ-কন্যা নিরাপদ? যারা পশু তারা বাইর-ভেতর সর্বত্রই পাশবিকতা বয়ে বেড়ায়। যাদের কাছে নারী মানে কামের আঁধার, মেয়ে মানেই চাকরানি তারা নারী-পুরুষ যেমন ছদ্মবেশেই থাকুক, আসলে তো তারা সাক্ষাৎ অমানুষ। নারীদের জন্য একটা নিরাপদ পৃথিবী প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেই দুনিয়ায় নারী-পুরুষ স্বসম্মানে পাশাপাশি-কাছাকাছি থাকবে। রাত-বিরেতেও ক্ষতির শঙ্কা থাকার না। কর্মক্ষেত্রে তথা ঘরে-বাইরের সর্বত্রই সকল নারী মা, বোন, স্ত্রী এবং কন্যার মতো সম্মান, স্নেহ, প্রেম ও ভালোবাসা পাবে- এমন প্রত্যয় কাল্পনিক কোনো প্রত্যাশা নয় বরং বাস্তবিক আশাবাদ। এজন্য নারীকেও ত্যাগ-তিতিক্ষার মন্ত্রে উদ্ধুদ্ধ হয়ে সবার দরদ বুঝতে হবে। একটা জাতিকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড়াতে স্বপ্ন দেখালে এবং এগিয়ে চলতে সাহায্য করলে তাদের সর্বপ্রথম বৈষম্যহীন জাতীয়তাবাদ এবং বিদ্বেষহীন সমাজে বসবাসের আহ্বান জানাতে হয়।