ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দেশের আর্থিক খাতে উৎকণ্ঠা

আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি না হলে অর্থনীতি গতি হারাবে
দেশের আর্থিক খাতে উৎকণ্ঠা

সার্বিক অর্থে বাংলাদেশের আর্থিক খাতে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে, তাতে উৎকণ্ঠিত না হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। এই খাতের নিত্যনতুন খবরে মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হচ্ছে। রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় কমে আসা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, দুর্বল ব্যাংকগুলোর সবল ব্যাংকের ঘাড়ে চড়ে বসা, বিদেশে টাকা পাচার, ব্যাাংকে ডাকাতি এবং সর্বোপরি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আবার রিজার্ভ ‘চুরির’ খবর মানুষ কীভাবে গ্রহণ করবে সেই প্রশ্ন থেকে যায়। আর্থিক খাতে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি না হলে দেশের অর্থনীতি গতি হারাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে আবারও অর্থ চুরির খবর প্রকাশ করেছে ভারতের একটি নিউজ পোর্টাল। খবরে বলা হয়, ভারতের হ্যাকাররা গত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার চুরি করে নিয়ে গেছে। তবে ভারতীয় পোর্টালের সেই খবর নাকচ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারা বলছে, নতুন করে কোনো রিজার্ভ চুরি হয়নি। ওই খবরটি সম্পূর্ণরূপে ভুয়া। গত মঙ্গলবার ভারতীয় গণমাধ্যম ‘নর্থইস্ট নিউজে’ রিজার্ভ চুরির বিষয়ে খবরটি প্রকাশিত হয়। এরপর মতিঝিলের ব্যাংকপাড়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। অনেকে এ তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়া হয়। সেখানে জানানো হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক নিউইয়র্ক ফেডের সঙ্গে লেনদেনে নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে বর্তমানে তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নীতি চালু রেখেছে। ফলে যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, তা সঠিক নয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেছেন, রিজার্ভ চুরি সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি সঠিক নয়, রিজার্ভ চুরির কোনো ঘটনা ঘটেনি। আমরাও আশা করব খবরটি মিথ্যা হোক। মিথ্যা হলেই মানুষ স্বস্তি পাবে। দুশ্চিন্তামুক্ত থাকবে। গত ১৪ মে ভারতের ‘নর্থইস্ট নিউজ’ নামের ওই নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত খবরটির শিরোনাম ছিল- ‘চলতি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোটি কোটি ডলার চুরির পেছনে ভারতীয় হ্যাকাররা জড়িত?’ ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ?‘অজ্ঞাত পরিচয়ের সন্দেহভাজন ভারতীয় হ্যাকাররা ডিজিটাল উপায়ে প্রায় এক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার চুরি করেছে। দুই দেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো ‘চাঞ্চল্যকর’ এ চুরির বিষয়ে অবগত আছে এবং তারা নীরবে এ ঘটনার তদন্ত করছে।’ বাংলাদেশের ব্যাকিং ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের আস্থা দিন দিন কমে আসছে। মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখে। সেই টাকা দিয়ে ব্যাংক অন্যকে ঋণ দেয়। সেই ঋণ থেকে যে সুদ পাওয়া যায়, তা থেকে গ্রাহক সামান্য অংশ পেলেও অধিকাংশ টাকা ব্যয় করা হয় ব্যাংকিং পরিচালনা খাতে। সেই ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্মচারীদের বেতনভাতা পরিশোধ করা হয়। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করার সংস্কৃতি আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তবে কেন, কোন সম্পদ বন্ধক রাখার বিপরীতে ব্যাংক ঋণ দেয়, সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে অনেক অনিয়ম কিংবা পদ্ধতিগত ভুল রয়েছে। ‘ঋণ নিয়ে দিতে হয় না’ এমন ধারণার জন্ম কেন হলো? সেটা খুঁজে বের করা দরকার। ঋণগ্রহিতার বন্ধক রাখার মতো কোনো সম্পদ আছে কি না- সেটা যাচাই-বাছাই না করে কোটি কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ দিয়ে দেবে কেন? আর ঋণ প্রদানের পর সেই ঋণ কেন আদায় করতে পারবে না? সেই প্রশ্নও থেকে যায়। খেলাপি ঋণ সংস্কৃতির ডাল-পালা দিন দিন বিকশিত হচ্ছে। একটা ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার সময় কি কোনো প্রকার সমীক্ষা করা হয়েছিল যে, ব্যাংকটি পায়ের ওপর ভর করে চলতে পারবে কি না? সেই বিচার বিবেচনা না করে শুধু কোনো ধরনের ‘সম্পক’-এর ওপর নির্ভর করে ব্যাংক খোলার অনুমতি দেয়া হবে কেন। আর দেয়ার পর সেটি অন্যের ঘাড়ের ওপর চড়িয়ে দেয়া হবে কেন।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক একীভূত করা হচ্ছে। বাংলাদেশে বিনিয়োগের নিরাপদ সুযোগ না থাকায় মানুষ বিদেশে টাকা পাচার করে দিচ্ছে। ব্যাকিং চ্যানেলের মাধ্যমে প্রবাসী আয় পুরোটা আসছে না। সেই সঙ্গে রপ্তানি আয়ও দিন দিন কমে আসছে। ফলে সার্বিক অর্থে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হোক কিংবা না হোক, সেই খবর নিয়ে মানুষ এত বেশি মাতামাতি করত না। যদি অতীতে রিজার্ভ চুরির ঘটনা না ঘটত। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সুইফট সিস্টেম ব্যবহার করে ৩৫টি ভুয়া বার্তা পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কে (ফেড) রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে রিজার্ভের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। এর মধ্যে একটি মেসেজের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কায় একটি ‘ভুয়া’ এনজিওর নামে ২০ মিলিয়ন ডলার সরিয়ে নেওয়া হলেও বানান ভুলের কারণে সন্দেহ হওয়ায় শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়। বাকি চারটি মেসেজের মাধ্যমে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার সরিয়ে নেওয়া হয় ফিলিপিন্সের মাকাতি শহরে রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকের জুপিটার স্ট্রিট শাখায় ‘ভুয়া তথ্য’ দিয়ে খোলা চারটি অ্যাকাউন্টে। অল্প সময়ের মধ্যে ওই অর্থ ব্যাংক থেকে তুলে নেওয়া হয়। ফিলরেম মানি রেমিট্যান্স কোম্পানির মাধ্যমে স্থানীয় মুদ্রা পেসোর আকারে সেই অর্থ চলে যায় তিনটি ক্যাসিনোর কাছে। এর মধ্যে একটি ক্যাসিনোর মালিকের কাছ থেকে দেড় কোটি ডলার উদ্ধার করে বাংলাদেশ সরকারকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।

২০১৬ সালে কম্পিউটার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরিকে আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সর্বকালের সবচেয়ে দুঃসাহসী সাইবার হামলা বলে অভিহিত করেছে। এই টাকা চুরি করতে গিয়ে হ্যাকাররা ব্যবহার করেছে নকল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, দাতব্য সংস্থা ও ক্যাসিনোর বিস্তৃত এক নেটওয়ার্ক। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই জানিয়েছে, উত্তর কোরিয়ার খুবই দক্ষ ও প্রশিক্ষিত হ্যাকারদের একটি দল এই চুরির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। সাইবার-নিরাপত্তা জগতে এই দলটির নাম ল্যাজারাস গ্রুপ। দলের এই নামকরণ করা হয়েছে বাইবেলের একটি চরিত্র ল্যাজারাসের নামে; যিনি মৃত্যুর পর আবার জীবিত হয়ে উঠেছিলেন। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অর্থচুরির ঘটনায় জড়িত অন্তত একজনকে শনাক্ত করতে পেরেছে এফবিআই। সন্দেহভাজন ওই ব্যক্তির নাম পার্ক জিন হিয়ক। তিনি পার্ক জিন হিয়ক এবং পার্ক কোয়াং জিন নামেও পরিচিত। তবে দেশের ব্যাংক গ্রাহকদের আশা থাকবে, আগামীতে আর্থিক খাতে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, যাতে মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরে আসে। দেশে নিরাপদ ব্যাকিং কার্যক্রম গড়ে উঠে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত