গণিত ভীতি দূর করতে করণীয়

অলোক আচার্য

প্রকাশ : ১৭ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষার্থীরা এখন ছুটছে কলেজে ভর্তির পেছনে। করোনা পরিস্থিতির পর এবারই প্রথম পূর্ণ সিলেবাসে এবং পূর্ণ নম্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছে এসএসসি, দাখিল ও সমমানের পরীক্ষা। এবার পরীক্ষায় পাসের হার বাড়লেও কমেছে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা। আবার একজনও পাস করেনি এমন এবং শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছেন দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাই বৃদ্ধি পেয়েছে। এবারও ফলাফলে ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীরাই ভালো ফল করেছে। এবছর সব শিক্ষাবোর্ডে উত্তীর্ণ ছাত্রদের চেয়ে ৫৯ হাজার ৪৭ জন বেশি ছাত্রী উত্তীর্ণ হয়েছে এবং ছাত্রের চেয়ে ১৫ হাজার ৪২৩ জন বেশি ছাত্রী জিপিএ-৫ পেয়েছে। সাধারণ ৯টি বোর্ডে ছাত্রের চেয়ে ৯৭ হাজার ৯৭২ জন বেশি ছাত্রী উত্তীর্ণ এবং ১৪ হাজার ৪৯১ জন বেশি ছাত্রী জিপিএ-৫ পেয়েছে। একইভাবে মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের চেয়ে ভালো ফল করেছে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা। তবে এতকিছুর তথ্যের ভিড়ে একটি বিষয় এবারও বের হয়ে এসেছে যে শিক্ষার্থীদের গণিত ভীতি কাটেনি। অর্থাৎ এতকিছুর পরেও শিক্ষার্থীদের কাছে গণিত আগের মতোই কঠিন বিষয়। যদিও গণিত শিক্ষার্থীদের কাছে সহজ করে তোলার জন্য বহু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। উপকরণের যথেষ্ট ব্যবহার, গণিত অলিম্পিয়াড ইত্যাদি এসবের মধ্যে অন্যতম। এতে যে একেবারেই কিছু হয়নি তা নয়। তবে যারা গণিতে ভয় পায় তারা; কিন্তু সেখান থেকে খুব একটা বের হতে পারেনি। ফল বিশ্লেষণে গণমাধ্যমের তথ্যে জানা যায়, ৯টি সাধারণ ও মাদ্রাসা বোর্ডে বাংলা, ইংরেজি, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, তথ্য ও প্রযুক্তি (আইসিটি), হিসাববিজ্ঞান, অর্থনীতিতে গড় পাসের হার ৯৬ শতাংশের ওপরে। বিপরীতে গণিতে পাসের হার ৯১ দশমিক ১৯ শতাংশ। অর্থাৎ, ৮ দশমিক ৮১ শতাংশ শিক্ষার্থী শুধু গণিতে ফেল করেছে।

শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণিতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব রয়েছে। পাশাপাশি প্রাথমিক পর্যায় থেকে গণিতের দুর্বলতা শিক্ষার্থীদের খারাপ ফলাফলের পেছনে মুখ্য কারণ। বোর্ডভিত্তিক ফলাফলে গণিতে এ বছর সবচেয়ে খারাপ ফল করেছে মাদ্রাসা বোর্ড। বোর্ডটিতে ১২ দশমিক ৬৪ শতাংশ শিক্ষার্থীই গণিতে ফেল করেছে। এরপর রয়েছে ঢাকা বোর্ড। এ বোর্ডে গণিতে ফেলের হার ১২ দশমিক ২৮ শতাংশ। কুমিল্লা বোর্ডে ১২ দশমিক শূন্য ০৪ শতাংশ, দিনাজপুরে ১১ দশমিক ৯০ শতাংশ, ময়মনসিংহ বোর্ডে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ, রাজশাহীতে ৬ দশমিক ২৬ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৭ দশমিক ৬৩, বরিশালে ৭ দশমিক শূন্য ৪০ শতাংশ, সিলেট বোর্ডে ৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতে ফেল করেছে। তবে যশোর বোর্ড ব্যতিক্রম। বোর্ডটিতে গণিতে পাসের হার ৯৮ শতাংশ। শিক্ষাক্ষেত্রে ইংরেজি এবং গণিতবিষয় দুটিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা। বছরব্যাপী প্রাইভেট পড়ান, কোচিং করান। এমন শিক্ষার্থী খুব কম পাওয়া যাবে যে গণিত বিষয় অন্তত কয়েকমাস প্রাইভেট পড়েনি বা কোচিং করেনি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এত গুরুত্ব দেওয়ার পরেও; কিন্তু একটা বড় অংশের কাছেই গণিত ভীতি কাটছে না। যেসব বছর পাবলিক পরীক্ষার ফল তুলনামূলকভাবে খারাপ হয় সেক্ষেত্রে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইংরেজি এবং গণিত বা কোনো একটা বিষয়ের ব্যর্থতা রয়েছে। সম্ভবত প্রচলিত ধারণাতেই ছাত্রছাত্রীরা এটিকে ভীতির চোখে দেখে। এই ভীতির শুরু হয় শিশুকাল থেকেই। গণিত কঠিন এই ধারণাটি শিশুর পরিবার থেকেই দেওয়া হয়। উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য ইংরেজি ও গণিত বিষয়ের উপর দক্ষতা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। বছর বছর পাবলিক পরীক্ষাতেও গণিত বিষয়ের ফল আশানুরুপ নয়।

গ্রাম ও শহরের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে গণিত বিষয়ের দক্ষতায় ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। পার্থকের বিষয়ে চোখে পরে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায়। বছর বছর ইংরেজি বিষয়ের প্রাইভেট পড়ার পরেও কেন গণিত বিষয়ের ফল খারাপ হয়, তা নিয়ে আরো অধিক গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। গবেষণা হচ্ছেও। এখন যেমন অনেক বড় আয়োজন করে গণিত অলিম্পিয়াডের আয়োজন করা হয় এটা অনেক পাওয়া। তবে গণিত ভীতি কাটাতে হবে একেবারে শিশুকাল থেকে। এর একটি কারণ হলো- প্রাইভেট পড়ার বিষয়টা শুধু সিলেবাস শেষ করার মধ্যেই সিমাবদ্ধ থাকে। প্রকৃতপক্ষে গণিত শেখার ধারে কাছেও যায় না। আমাদের চারপাশ থেকে শিশুকাল থেকেই আরো সহজভাবে গণিত শেখার কাজটি করা সম্ভব হয়। পাস করার জন্য যতটুকু শেখার দরকার ততটুকু শিখেই শেখার কাজ শেষ করে ছাত্রছাত্রীরা। মূলত টার্গেটটা থাকে পরীক্ষায় ভালো ফল করা, গণিত শেখা নয়। এর বাইরে বেশিরভাগই আগ্রহী থাকে না। মাধ্যমিক পর্যায়ে শহরাঞ্চল বাদ দিয়ে খুব কম শিক্ষকই রয়েছে, যারা গণিত বিষয়ে যথেষ্ট দক্ষ বা শিক্ষার্থীদের কাছে সহজ করে তুলতে পারেন। সেই প্রচেষ্টাও তেমন একটা দেখা যায় না। একথা ঠিক যে এই শিক্ষকরাই শ্রেণিকক্ষে গণিত বিষয়ের পাঠদান করান এবং তাদের যথেষ্ট সুনামও রয়েছে। তিনি যেটা করেন, তা হলো বিদ্যালয়ের সিলেবাস শেষ করেন। দুর্বল ছাত্রছাত্রীরা গণিত বিষয়টিকে ভয় পায়। ফলে তারা অনেকেই ওই ক্লাসে মনোযোগ কম রাখে।

গণিত বিষয়ের দক্ষতার অভাব আমাদের মজ্জাগত। ২০০ বছরের শাসন শেষেও ভাষাটা সবাই রপ্ত করতে পারিনি। বর্তমানে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা এনটিআরসিএর আওতাধীন। এখন একজন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে হলে তাকে তিনটি ধাপ শেষ করে নিয়োগ পেতে হয়। কিন্তু এর আগে নিয়োগ ব্যবস্থানির্ভর করত ম্যানেজিং কমিটির ওপর। তখন নিয়োগের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে মেধার মূল্যায়ন কমই হতো। প্রকৃত মেধাবীরা অনেক সময়ই বাদ পরে গেছে।

চর্চার অভাবেই গণিত ভীতি আমাদের শিক্ষার্থীদের মন থেকে যেন কাটছেই না। কোনো পাঠদানের মূল উদ্দেশ্য থাকে, পাঠের বিষয়বস্তু অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর বোধগম্য করে তোলা। কিন্তু শ্রেণিকক্ষে প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর মেধাই সমান নয়। তবে গণিত শিখানোর বিভিন্ন পদ্ধতি বা কলাকৌশল অবলম্বন করলে গণিত ভীতি দূর হওয়ার কথা। সেক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের তদারকিও থাকতে হবে, যে শিক্ষকরা গণিত শিখন-শিখানোতে যথাযথ পদ্ধতির অনুসরণ করছেন কি না। কোনো ছাত্রছাত্রীদের সেভাবে অভ্যস্ত করতে পারেন, তবে পাঠের উদ্দেশ্য সফল হতে পারে। একজন দক্ষ এবং বুদ্ধিমান শিক্ষক এই বিষয়টির উপরই বেশি জোর দেবেন। এতে লাভ হবে বহুমুখী। একদিকে যেমন শিক্ষক নিজ বিষয়ের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারবেন ঠিক, সেভাবেই শ্রেণিকক্ষেও ছাত্রছাত্রীদেরও দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে থেকে গণিত ভীতি দূর হবে এবং অন্য বিষয়ের মতই বুঝতে পারবে। প্রকৃতপক্ষে গণিত শিক্ষার ধরন কি হবে, তা প্রথম নির্ধারণ করতে হবে। প্রথমে গ্রামার না ভাষার ব্যাবহারের সর্বাধিক জোর দেওয়া হবে তা শিক্ষককেই নির্দেশ করতে হবে। ছাত্রছাত্রীর কাছে গণিত সহজবোধ্য করতে হলে অবশ্যই শিক্ষককেই অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। ভয়টা কাটাতে হবে। শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে প্রথম তাকে গণিত বিষয়ের সবল মোটামুটি এবং একেবারে দুর্বল ছাত্রছাত্রী আলাদা করতে হবে। তারপর ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রয়োজনে দলীয় ভিত্তিতে কাজ করতে দিতে হবে। অনগ্রসরদের নিয়মিতভাবে উৎসাহ দিতে হবে। শিক্ষক নিয়মিতভাবে তার ছাত্রছাত্রীর অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করবেন এবং উন্নয়নে পরামর্শ দেবেন। একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, যেন গণিতের প্রতি ছাত্রছাত্রীর ভীতি কাটতে থাকে। তাকে পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও গণিত শেখার অন্যান্য মাধ্যম যেমন হাতে কলমে শেখার ব্যবস্থা করা। এছাড়া বাড়িতে অভিভাবক সন্তানকে গণিত বিষয়ে চাপ না দিয়ে তাকে উৎসাহ দেয়ার মাধ্যমে গণিতে দক্ষ করে তুলতে ভূমিকা পালন করতে পারেন।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট