ইরানের প্রতি চীন-রাশিয়ার সমর্থন ও পশ্চিমাদের উদ্বেগ

রায়হান আহমেদ তপাদার

প্রকাশ : ১৭ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ইরানের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার মাধ্যমে চীন মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্যে পা রাখতে শুরু করেছে। যা নিয়ে উদ্বিগ্ন ওয়াশিংটন। জিওপলিটিকার তথ্যমতে, রাশিয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুই প্রতিপক্ষ চীন এবং ইরান। এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ দুটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ৪০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ২৫ বছরের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চীন ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ইরানের প্রচেষ্টাকেও সমর্থন করেছে। ২০১৮ সালে চুক্তিটি থেকে বের হয়ে যায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রশাসন। যাই হোক, চীন এবং ইরান, দুই দেশই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়বস্তু। তারা ২০২১ সালের মার্চে ২৫ বছরের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। তেহরানকে নিজেদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে নিয়ে এসেছে বেইজিং। ইরান যখন গত এপ্রিলের মাঝামাঝিতে ইসরায়েল লক্ষ্য করে ৩০০-এর বেশি মিসাইল ও ড্রোন হামলা করে, তখন নতুন করে ইরানের তেল রপ্তানির উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি আলোচনায় আসে আবার, যে তেলের উপর নির্ভর করে আছে দেশটির অর্থনীতি। ইরানের বিপক্ষে নানা পদক্ষেপ নেবার পরও, ২০২৪ সালের প্রথম ৪ মাসে তাদের তেল রপ্তানি ৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছায়, ইরানের কাস্টম প্রধানের হিসেবে যার পরিমাণ ৩৫.৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার। কিন্তু ইরান কীভাবে তাদের তেল রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যেতে পারছে? এর উত্তর লুকিয়ে আছে তাদের সবচেয়ে বড় ক্রেতা চীনের বাণিজ্য কৌশলের উপর, ইরানের মোট তেল রপ্তানির ৮০ ভাগই যায় চীনে, ইউএস হাউস ফিনান্সিয়াল সার্ভিস কমিটির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতিদিন ইরান প্রায় ১.৫ মিলিয়ন ব্যারেল তেল চীনে রপ্তানি করে থাকে।

যদিও ইরানের সঙ্গে বাণিজ্যের যথেষ্ট ঝুঁকি আছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নানা নিষেধাজ্ঞা যেখানে, কিন্তু তারপরও বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রেতা চীন কেন ইরান থেকে তেল কিনে? কারণটা খুবই সহজ, ইরানের তেল মানে ভালো আর দামে সস্তা। নানান আন্তর্জাতিক সংঘর্ষের কারণে বিশ্বে তেলের দাম বেড়েই চলেছে; কিন্তু নিষেধাজ্ঞায় থাকা ইরান যেহেতু তাদের তেল বিক্রিতে মরিয়া, তারা অন্যদের চেয়ে কম দাম অফার করে থাকে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে রয়টার্স। যাতে বলা হয় ২০২৩ সালের প্রথম ৯ মাসে চীন অন্তত ১০ বিলিয়ন ইউএস ডলার বাঁচিয়েছে ইরান, রাশিয়া আর ভেনেজুয়েলা থেকে তেল কিনে, এসব তেলই কমদামে বিক্রি করা হয়। অপরিশোধিত তেলের যে বৈশ্বিক মানদ- তা পরিবর্তিত হয়, তবে সাধারণ প্রতি ব্যারেল ৯০ ডলারের নিচে থাকে। ডেটা ও অ্যানালেটিক্স ফার্ম কেপিএলআরের সিনিয়র অ্যানালিস্ট হুমায়ুন ফালাকশাহী ধারণা দেন, ইরান তাদের ক্রুড তেল ব্যারেলপ্রতি ৫ ডলার কমে বিক্রি করছে। গত বছর ব্যারেলপ্রতি যেটার দাম সর্বোচ্চ ১৩ ইউএস ডলার পর্যন্ত কমিয়ে দেয়া হয়েছিল। পুরো বিষয়টির ভূরাজনৈতিক দিক আছে বলে মনে করেন ফালাকশাহী। ইরানের অর্থনীতিকে সহায়তার মাধ্যমে, চীন মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে একটা ভূরাজনৈতিক ও সামরিক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে, বিশেষ করে যখন ইসরায়েলের সঙ্গে উত্তেজনা চলমান। বিশ্লেষকদের বিশ্বাস, ইরান ও চীন কয়েক বছর ধরে একটা সূক্ষ্ম পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে, তেহরানের নিষিদ্ধ তেল আমদানি-রপ্তানির জন্য। এই বাণিজ্য কৌশলের প্রধান উপকরণ হলো চাইনিজ চায়ের পাত্র, ‘ডার্ক ফ্লিট’ ট্যাংকার্স ও চীনের আঞ্চলিক ব্যাংক যাদের আন্তর্জাতিক পরিচিতি খুব কম। এসব টিপট যাতে ইরানের তেল পরিশোধন করা হয়, আকারে খুবই ছোট ও আংশিকভাবে স্বনিয়ন্ত্রিত, এগুলো রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বিশাল সব পরিশোধনাগারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটা আসলে এই ইন্ডাস্ট্রির দেয়া টার্ম। যেহেতু রিফাইনারিগুলো দেখতে চায়ের কাপের মতো, খুবই সাধারণ কিছু সুবিধা থাকে এতে, আর বেশিরভাগই মেলে দক্ষিণ-পূর্ব বেইজিংয়ের শানডং অঞ্চলে। এই ছোট রিফাইনারিগুলোতে চীনের জন্য কম ঝুঁকি থাকে, কারণ রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কোম্পানিগুলো আন্তর্জাতিকভাবে পরিচালিত হয়ে থাকে এবং এতে ইউএস ফিনান্সিয়াল সিস্টেমের প্রবেশাধিকার থাকে। তাছাড়া তেলের ট্যাংকারগুলো বিশ্বজুড়ে সমুদ্রে ট্র্যাক করা হয়, বিভিন্ন সফটওয়্যার তাদের অবস্থান, গতি ও রুট পর্যবেক্ষণ করে। এই ট্র্যাকিং এড়ানোর জন্য ইরান ও চীন একটা অস্পষ্ট মালিকানা ধরনের ট্যাংকার্স নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে, যেটা সঠিক অবস্থান দেখায় না। তারা খুব সহজেই পশ্চিমা ট্যাংকার্স, নানান শিপিং সার্ভিস সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যেতে পারে।