ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জনস্বাস্থ্য সংকট এবং আসন্ন বাজেটে কোমল পানীয়র উপর উচ্চহারে করারোপের গুরুত্ব

আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ রাফি
জনস্বাস্থ্য সংকট এবং আসন্ন বাজেটে কোমল পানীয়র উপর উচ্চহারে করারোপের গুরুত্ব

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন কোমল ও মিষ্টি জাতীয় পানীয় বর্জনের যে ডামাডোল চলছে তার শুধু আন্তর্জাতিক ও রাজনৈতিক নয় বরং স্বাস্থ্যগত কুপ্রভাবের কথাও আমাদের সামনে নিয়ে আসা জরুরি। যদিও এই বর্জনের ফলাফলের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায় না, তবুও আমরা ধারণা করতে পারি, ব্যক্তিগত ক্রেতা পর্যায়ে এই বর্জনের কিছুটা প্রভাব রয়েছে। এই অবস্থায়, আন্তর্জাতিক ও রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ বাদ দিয়ে কোমল ও মিষ্টি জাতীয় পানীয় (Sugar- sweetened Beverages (SSBs) সমূহের মানুষের দেহে প্রভাবের দিকে নজর ফেরানো যাক। বিভিন্ন সময়ে করা গবেষণায় দেখা যায়, কোমলপানীয় পানের ফলে স্থূলতা থেকে শুরু করে, টাইপ-টু ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, দাঁতক্ষয়, এমনকি হৃদরোগও হয়ে থাকে।

অন্য সববিষয়কে অভিন্ন রেখে, যদি কেউ দৈনিকভিত্তিতে একটি মিষ্টি জাতীয় কোমলপানীয় পান করে থাকেন, তবে সে ব্যক্তির ওজন বছরে ২ কেজির বেশি বেড়ে যেতে পারে। আমাদের আজকের আলোচনার মূল লক্ষ্য হলো- মিষ্টি জাতীয় কোমলপানীয় ব্যবহারের কুফল এবং এসব কুফল থেকে জনগণকে রক্ষার জন্য আসন্ন বাজেটে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কি করা যায়, তার দিকে আলোকপাত করা। গবেষণা প্রতিষ্ঠান আর্ক ফাউন্ডেশন সম্প্রতি বাংলাদেশের বাজারে প্রচলিত কোমলপানীয় এবং এর দাম বৃদ্ধির সঙ্গে ক্রেতাদের আচরণগত পরিবর্তনের উপর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে, এ জাতীয় পানীয়’র (SSBs) ‘Price Elasticity’ অথবা মূল্য সংবেদনশীলতা বিষয়ে করা এই গবেষণাপত্র বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একদমই নতুন। এই গবেষণায় দেখা যায় করারোপের মাধ্যমে কোমল পানীয়র দাম ১০ ভাগ বৃদ্ধি করলে ক্রেতা পর্যায়ে তা পানের পরিমাণ ১১.৭ ভাগ হ্রাস করা সম্ভব।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট : দ্রুত নগরায়ণ ও ব্যাপকভাবে প্রচারিত বিজ্ঞাপনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কোমল পানীয়র ব্যবহার তীব্রভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিভিন্ন সময়ে তীব্র তাপমাত্রা থাকায় মানুষ সাময়িক স্বস্তি লাভের জন্য এই ধরনের মিষ্টি জাতীয় কোমল পানি পান করে থাকেন। বিভিন্ন স্বাদ, রং ও আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে বাংলাদেশেও শিশু ও তরুণদের এর ব্যবহারের হার উদ্বেগজনক বৃদ্ধি পেয়েছে।

২০২২ সালে করা বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী, স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৪৮ ভাগ শিশু ও প্রায় প্রতিজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী প্রতিদিন মিষ্টি জাতীয় পানীয় পান করে। এসব পানীয় পানের মূল কারণ হিসেবে সুলভ মূল্য, স্বাদের বৈচিত্র্য, চটকদার বিজ্ঞাপন, সহজ প্রাপ্যতা এবং সমবয়সিদের প্রভাব উঠে এসেছে। আর্ক ফাউন্ডেশনের করা গবেষণাপত্র বলছে, দেশে একটি পরিবারের মাসিক ব্যয়ের প্রায় ২ শতাংশ খরচ হচ্ছে কোমল পানীয় এবং মিষ্টি জাতীয় পানীয় ক্রয়ের পেছনে। বর্তমান আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় যেখানে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এবং শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিশ্চিত করা অনেক পরিবারের পক্ষেই কষ্টকর, সেখানে, এই খরচকে পরিবারের উপর বাড়তি চাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের বাজারে ৮০-এর দশকের শেষদিকে এসব পানীয়র আবির্ভাব হয়, শুরুতে মাত্র তিনটি প্রতিষ্ঠান বিক্রয় ও বিতরণের কাজে নিয়োজিত থাকলেও, দৈনিক বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ১০০টির বেশি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

২০১১ থেকে ১৮ সালে বাংলাদেশে বিক্রি হওয়া কোমল পানীয়র মোট পরিমাণ (অন-ট্রেড এবং অফ-ট্রেড উভয়ই) গড়ে বার্ষিক ৬.৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে এসব পানীয়র প্রকৃত মূল্য উল্লেখযোগ্য হারে কমায় ক্রেতাদের মধ্যে-এর ব্যবহার ও প্রসার বেড়েছে বহুগুণে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, প্রান্তিক পর্যায়ে মিষ্টিজাতীয় পানীয় ব্যবহার কমানোর লক্ষ্যে বেশকিছু আর্থিক নীতি সুপারিশ করেছে।

যার মধ্যে করারোপের ফলে দাম বৃদ্ধি করাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে একটি হিসাবে সুপারিশ করা হয়েছে। এর ফলে ব্যক্তি পর্যায়ে ওই পণ্যের ব্যবহার অনেকখানি হ্রাস করা সম্ভব। বাংলাদেশে মিষ্টি জাতীয় কোমল পানীয় ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেলেও, এর উপর আরোপিত করের হার বিগত সময়ে খুব একটা বৃদ্ধি পায়নি। বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত পানীয়গুলোর উপর সাধারণত দু’ধরনের কর আরোপ করা হয়; (ক) মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) যা ১৫ শতাংশের একক হারে ধার্য করা হয় এবং (খ) অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত পানীয়র জন্য সম্পূরক শুল্ক (এসডি) যা কার্বোনেটেড পানীয়র জন্য ২৫ শতাংশ এবং শক্তিবর্ধক পানীয়র জন্য ৩৫ শতাংশ।

এছাড়া আমদানিকৃত কোমল পানীয়র উপরে ১৫০ শতাংশ করারোপ করা হয়। আর্ক ফাউন্ডেশনের গবেষণা বলছে, মিষ্টি জাতীয় কোমল পানীয়র দাম বৃদ্ধি করলে তা বাজারের স্বাভাবিক চাহিদা নিয়ম অনুসরণ করবে, অর্থাৎ ক্রেতা পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে তার চাহিদাও হ্রাস পাবে। মূল্য সংবেদনশীলতার (Price Elasticity) সঠিক হিসাব নীতিনির্ধারকদের এসব পানীয়র উপর উপযুক্ত করারোপে সাহায্য করবে, অন্যদিকে দাম বৃদ্ধির ফলে বাজারে কম মূল্যের নতুন পণ্যের আগমনও ঠেকাবে। এছাড়া মূল্য সংবেদনশীলতা যথাযথ কর ব্যবস্থা তৈরিতে সাহায্য করবে। দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্র চিলি এবং মেক্সিকোর জনগণের মধ্যে কোমল পানীয় বেশ জনপ্রিয়।

ওই দেশগুলোর উপর পরিচালিত মূল্য সংবেদনশীলতার বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে যে, কোমল পানীয়র মূল্যবৃদ্ধিতে গ্রাহক পর্যায়ে চাহিদার আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। মিষ্টি জাতীয় কোমল পানীয়র উপর যথাযথ কর প্রয়োগ, দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য উন্নতির জন্য একটি অন্যতম মাইলফলক হিসাবে বিবেচিত হতে পারে।

গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে স্থূলতা প্রতিরোধ, অসংক্রামক রোগ এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত অকাল মৃত্যুর সম্ভাবনা হ্রাসের ক্ষেত্রে মিষ্টি জাতীয় কোমল পানীয়র উপর আরোপিত কর নীতির পুনর্বিন্যাস অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। মিষ্টি জাতীয় কোমল পানীয় পানের ফলে উদ্ভূত রোগ নিয়ন্ত্রণে সরকারকে বাড়তি তহবিল জোগান দিতে হয়, যা আমাদের মতো নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের উপর একটি বাড়তি বোঝা। এছাড়া সামগ্রিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাতেও তা অতিরিক্ত চাপ তৈরি করছে।

বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য ২০২৪ সালের বাজেটে মিষ্টি জাতীয় কোমল পানীয়র উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করা প্রয়োজন। এ বিষয়টি সরকারের জন্য একটি অগ্রাধিকার হওয়া উচিত এবং তার জন্য সরকার বাদেও জনগণ এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যসব অংশীজনের এগিয়ে আসা উচিত। সবশেষে উল্লেখ্য যে, পণ্যের কর বৃদ্ধি অন্যতম হাতিয়ার হলেও এর পাশাপাশি বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন-উপরন্ত দেশের মানুষের উপলব্ধি এবং স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণই পারে আমাদের জনগণের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে।

লেখক : রিসার্চ আপটেক অ্যান্ড কমিউনিকেশন ম্যানেজার আর্ক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত