ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

‘বিদ্রোহী কালের দর্পণ’

নুরুন্নাহার মুন্নি
‘বিদ্রোহী কালের দর্পণ’

কাজী নজরুল। মানবতার কবি, দ্রোহের কবি, ঐক্য ও সাম্যের কবি সর্বোপরি ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই নজরুল আমাদের জাতীয় কবি। কারণ অসাধারণ প্রতিভার এই কবি অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নিপীড়ন, নির্যাতন এবং আর্থসামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি থেকে উপাদান হৃদয়ে ধারন করে তিনি তার লেখনির মাধ্যমে সমগ্র বাঙালির জাতিকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন কিংবদন্তি এই কবি।

‘বিদ্রোহী’ কবিতা কবির এক অমর সৃষ্টি। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর শেষ সপ্তাহে মাত্র ২২ বছর বয়সে লেখা কবির ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলন অর্থাৎ রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে রচিত কবির এ কালজয়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী’। ১৫০ পঙ্ক্তির এই কবিতায় কবি একটি জায়গায় এইভাবে তুলে ধরেছেন- ‘ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া/খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া/উঠিয়াছি চির বিস্ময় আমি বিশ্ব বিধাতৃর।/মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ/রাজ টিকা দীপ্ত জয়শ্রীর’। এই পঙ্ক্তিগুলোতে অসাম্প্রদায়িক ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কবির স্পষ্ট কথাগুলো শরীরে কাটা দেয়া তীক্ষè অনুভূতিকে জাগিয়ে তোলে আজও। এই কবিতায় কবি অন্যায় অসত্য ও ঔপনিবেশিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে দ্রোহ প্রকাশ করেন। তখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এদেশ, এ দেশের মানুষের উপর যেভাবে শোষণ পীড়ন চালিয়েছিল, সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে বিল্পবী ও শক্তিমান কবি তার কবিতায় বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ‘বিদ্রোহী’ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সর্বোকৃষ্ট একটি কবিতা। দেশ এবং সমাজের অনিয়ন্ত্রিত র্স্পশকাতর জায়গাগুলোতে এর প্রতিটি শব্দ শিরায় শিরায় উদ্বেলিত হয়ে একেকজন মানুষকে তৈরি করে একেকজন লৌহ মানব। নতুন প্রাণোদ্যমে জেগে ওঠে শোষণের বিরুদ্ধে গড়ে তোলে আমুল পরিবর্তনের ইতিহাস। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি বিজলী পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। কবিতাটি প্রকাশের পর মৌলবাদী-হিন্দু-মুসলিম সবার মধ্যে দারুণভাবে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। পত্রিকাটি সেদিন এতো বিক্রি হয়েছিল যে, পরবর্তীতে পত্রিকা সংকট দেখা দেয়।

সবচেয়ে বেদনাদায়ক ব্যাপার ছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশের পরবর্তী পাঠক প্রতিক্রিয়ায় কবিতাটিতে কবি নজরুল ইসলাম অসংখ্য পুরাণ মিথ্যের প্রয়োগ করেছিলেন। ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসী কিছু মানুষ নজরুলকে শয়তান ও নমরুদ বলে ব্যঙ্গ করেছিলেন। এই নিন্দা তীব্রভাবে প্রকাশ করতে কেউ কেউ প্যারোডি কবিতা ও গল্প বের করেছিলেন। নিন্দুকের দল থেকে বাদ পড়েননি কবি গোলাম মোস্তফাও। মুসলামান হয়ে শাস্ত্র ও সংস্কৃতের পক্ষ নিয়ে সাফাই গাওয়া নজরুল সব হট্টগোলের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন একদল মূর্খণ্ডজ্ঞানী-পণ্ডিতরাও। এই শ্রেণির কিছু হৃষ্ট-পুষ্ট জ্ঞানগর্ব মানুষ ছিল, যারা নজরুলকে কবিতার আদ্যোপান্ত অভিযোগ আর নালিশের ভঙিতে রবীন্দ্রনাথের কাছে উপস্থাপন করতেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার বেলায় সেটা পরিণত হলো তাদের ভয়ানক আস্ফালনে। ডিসেম্বরের শীতের প্রত্যুষে জোড়া সাঁকোর ঠাকুর বাড়ির দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কবিগুরুর সামনে যখন কবি নজরুল তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতার খসড়া পড়ে শুনিয়েছিলেন, কবি তার রূপ-রঙ্গে-রসে, বৈচিত্র্য, ছন্দ আর সুর তার লয় আর মাত্রার প্রকাশে কবিগুরু মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে কবিতাটি শুনে কবি নজরুলকে বুকে টেনে নিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। সেদিন বাংলার কাব্যাকাশে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন এক নবারুনকে। কবিগুরু তার হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পেরেছিলেন এই কবিতা কবির স্বসমুত্থ সংরাগ প্রধান এবং অলংকার চঞ্চল। এই ত্রিবেনী শক্তি ধারন করে আছে- যে কবিতা সে কবিতা তো শুধু বাংলা সাহিত্যের সম্পদ নয়, এটা বিশ্ব সাহিত্যের শ্রেষ্ঠসম্পদ।

বাংলা কাব্যসাহিত্যে মাত্রাবৃত্ত মুক্তক ছন্দের এমন সার্থক প্রয়োগ ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ছাড়া আজ পর্যন্ত কোনো কবিতায় কোনো কবি প্রয়োগ করতে পেরেছেন কি না, আমার অন্তত জানা নেই। একাত্তরের বেতার যুদ্ধে বিদ্রোহী কবিতার ভূমিকা নিয়ে দ্বিমত পোষণের কোনো জায়গাই নেই। ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠানমালায় নাটক, কথিকা, গান, কবিতা, স্লোগান, মুক্তিসেনা এবং অবরুদ্ধ মুক্তিকামী বাঙালির প্রেরণার উৎস ছিল। কবি কাজী নজরুলের অমর সেই ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি আজও যখন আমরা শুনি অনুধাবণ করতে পারি, তখনকার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয়ের তার অবদান নবদিগন্তের উদীয়মান সূর্যের মতো চির সমুজ্জল। চিরঞ্জীব কবি নজরুল ভেবেছেন মানুষের কথা, উপলব্ধি করেছেন মানুষের কষ্ট বেদনা, বহন করেছেন চিরকালীন মানবের বিপ্লবী চেতনার অগ্নিবাণী। অধিকার আদায়ে আন্দোলন আর সংগ্রামী এই ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ১৯২২ সালে ১২ আগস্ট ধুমকেতু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। রাজনৈতিক কবিতা হওয়ায় ৮ নভেম্বর সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং ২৩ নভেম্বর কুমিল্লা থেকে কবিকে গ্রেপ্তার করে কলকাতায় নেয়া হয়, কলকাতায় গিয়েও কবি লিখেছেন অজস্র গান, কবিতা আর গজল। এর মধ্যে সময়ের স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে লিখেছেন অসংখ্য বিদ্রোহী গান ও কিন্তু সর্বোৎকৃষ্ট রচনা ছিল তার এই ‘বিদ্রোহী’ কবিতা, যার জন্য তিনি কারাবরণও করেছিলেন। বাংলার কাব্য-সাহিত্য, সংগীত-সংস্কৃতির ইতিহাসের চিরবিস্ময় চির অম্লান, চির জ্যোর্তিময় কবি নজরুলের জীবনবোধ আর জীবন দর্শনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে সাহিত্যের আর এক নক্ষত্রসম কবি অন্নদাশংকর রায় লিখেছিলেন- ‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে/ভাগ হয়নিকো’ নজরুল।/এই ভুলটুকু বেঁচে থাক,/বাঙালি বলতে একজন আছে/দুর্গতি তার ঘুচে যাক’। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ একটি অত্যাধনিক কবিতা যা গত ১০০ বছর বীরত্বের সহিত দাপিয়ে বেরিয়েছে পাঠক মনে, এনেছে রাষ্ট্র ও সমাজে প্রতিবাদের জোয়ার, বদলে দিয়েছে শ্রেণিবৈষম্য, বিংশ- একবিংশ শতাব্দীতে ও যার জৌলুস এতটুকুও কমেনি, আলোকিত হচ্ছে আমাদের ডিজিটাল সমাজ। আধুনিকায়নের এই সময়ে দ্বাবিংশ শতাব্দীতে ও একটি শুদ্ধাস্ত্রে পরিণত হয়ে সমাজের লাঞ্চনা, শোষণ আর যুগে যুগে সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে খড়গ তুলে, প্রতিবাদের ঝড় তুলে সমাজ ও রাষ্ট্রে ছিনিয়ে আনবে আমূল পরিবর্তনের ইতিহাস- এটা আজকের যুগে দাঁড়িয়ে আমার দৃঢ়বিশ্বাস।

বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে অনেক কবি ও লেখক দ্রোহের কবিতা, ক্ষমতার লড়াইয়ে প্রতিবাদী গান ও কবিতা লিখেছেন। কিন্তু বিদ্রোহী কবিতা বলতে বাঙালির মননে ও মস্তিষ্কে একটি নামই ভেসে উঠে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। এখানেই কবি ও কবিতার স্বার্থকতা। আমি বলব ‘বিদ্রোহী’ কবিতা কবির জন্মসূত্রে প্রাপ্ত ঐশ্বরীক এক মানবীয় সত্ত্বাশক্তির অমূল্য সৃষ্টি, যা আজ অবধি কোনো কবির পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হয়নি। তাই ‘বিদ্রোহী’ কবিতাকে ছাপিয়ে যাওয়ার মতো কোনো কবিতাও রচিত হয়নি। তাই আমি মনে করি, বিশ্বায়নের এই যুগে কালের দর্পণ হয়ে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা তার অমরত্বের চিহ্ন রেখে যাবে, যাবেই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত