ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পুতিনের চীন সফরে দুই দেশের শক্তিশালী সম্পর্কের ইঙ্গিত

অলোক আচার্য
পুতিনের চীন সফরে দুই দেশের শক্তিশালী সম্পর্কের ইঙ্গিত

ভূরাজনৈতিক ঘেরাটোপে চীনের সঙ্গে সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক সম্ভবত রাশিয়ার। এই দুই মিত্র দেশের জোট এতটাই শক্তিশালী যে, এর সঙ্গে আরো কয়েকটি দেশের সুসম্পর্ক রীতিমতো পশ্চিমা দেশগুলোর মাথাব্যথার কারণ। তাছাড়া দুই বলয়ের অবস্থানও প্রায়ই বিপরীত। ওদিকে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-সৌদি আরব সমঝোতায় পৌঁছানোতে এবং সেখানে চীনের হাত থাকায় তা নতুন একটি সমীকরণের যোগ করেছে। যে হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। যদিও মিত্রদেশ চীন-রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে সরাসরি কোনো ভূমিকা নেয়নি বা এর পক্ষে সাফাই গায়নি তবে যুদ্ধ বন্ধে উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে। তবে যুদ্ধের বিপক্ষে জোরালো কোনো মতামত দেয়নি এটাও সত্য। এই ধরনের ভূমিকা রাজনৈতিক কৌশলেরই অংশ। ভূরাজনীতির খেলায় চীন-রাশিয়া এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুটি দেশই পরাশক্তি এবং অস্ত্রশস্ত্রে পূর্ণ। এর কিছুদিন আগেই পুতিন পঞ্চমবারের জন্য দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ১৬ ও ১৭ মে চীন সফর করেছেন। নতুন মেয়াদে কার্যভার গ্রহণের পর এটাই প্রেসিডেন্ট পুতিনের প্রথম বিদেশ সফর। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের আমন্ত্রণে গত বৃহস্পতিবার সকালে বেইজিং পৌঁছান রুশ প্রেসিডেন্ট। গত বৃহস্পতিবারে তারা একাধিক বৈঠক করেন, সংবাদ সম্মেলন করেন। চীনের প্রেসিডেন্ট সংবাদ সম্মেলনে বলেন, চীন ও রাশিয়া একসঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে নিজ নিজ দেশের উন্নয়ন অর্জন করতে আগ্রহী। তিনি জোর দিয়ে বলেন, চীন-রাশিয়ার সহযোগিতার লক্ষ্য কোনো তৃতীয় পক্ষকে উদ্দেশ্য করে নয়। এ সম্পর্ক পারস্পারিক শ্রদ্ধা, সুবিধা, অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গঠিত। তিনি আশা করেন, ইউক্রেনের যুদ্ধ শান্তিপূর্ণভাবেই সমাধান হবে। বৈঠকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য। প্রেসিডেন্ট শি উল্লেখ করেন, ১০ বছরে দুদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ১৭০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বাণিজ্য আরো বাড়তে পারে বলে তিনি ইঙ্গিত দেন।

দুজনের প্রারম্ভিক আলোচনাকে অত্যন্ত ‘আন্তরিক এবং নেতৃত্ব’ সুলভ উল্লেখ করে পুতিন দুদেশের সম্পর্ক জোরদারে বেশ কিছু সেক্টরের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন। এর মধ্যে পরমাণু এবং জ্বালানি সহযোগিতা থেকে শুরু করে খাদ্য সরবরাহ এবং রাশিয়াতে চীনের গাড়ি উৎপাদনের বিষয়গুলো বিশেষভাবে তিনি উল্লেখ করেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পৃথিবীকে বহুমুখী সমস্যায় ফেলেছে এবং নতুন নতুন মেরুকরণ তৈরি করেছে। পৃথিবীজুড়েই আর্থিক সংকট অর্থাৎ তীব্র মুদ্রাস্ফীতি। তবে চীনের নেওয়া যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে রাশিয়া। কিন্তু সেটা কীভাবে চীনের পক্ষে সম্ভব সেটাও একটা প্রশ্ন। কারণ রাশিয়ার উদ্দেশ্য সফল না হওয়া পর্যন্ত যে যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার কোনো চান্স নেই, সেটা এরমধ্যেই বোঝ গিয়েছে। আলোচানার মাধমে সেই উদ্দেশ্য সফল হবে, সেটাও অনিশ্চিত। কারণ এর বিপরীতে রয়েছে, পশ্চিমা দেশগুলোর জোট। সেই জটিল সমস্যার সমাধান চীন একই সম্ভব করতে কতটা দক্ষতার পরিচয় দিবে সেটাই প্রশ্নের। এটাই বিশ্ব রাজনীতি। বিশ্ব রাজনীতি হলো গিভ অ্যান্ড টেক নীতি। এখানে উদারনীতি বলে কিছু নেই। রয়েছে সম্পর্ক উন্নয়নের তোড়জোড়। যে দেশের কাছে যে স্বার্থসংশ্লিষ্ট জড়িত, সেখানেই সম্পর্কের তোড়জোড়। স্বার্থ বহুবিধ হতে পারে। তা আঞ্চলিক সুবিধা আদায় হোক, বাণিজ্য স্বার্থ হোক আর তুলনামূলক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার জন্যই হোক। তাছাড়া রয়েছে, ক্ষমতায়নের বিশ্বে ক্ষমতা দখলের তোড়জোড়। কে পৃথিবীর মুরুব্বী হয়ে খবরদারি করবে, তার সঙ্গে কোনো কোনো দেশ থাকবে, তাদের স্বার্থ রক্ষার উপায় কি হবে, এসব বিষয়েই আন্তর্জাতিক রাজনীতি গরম হয়ে আছে। বিগত কয়েক বছর ধরেই এই প্রতিযোগিতা চলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভেতর। সামরিকয়ান, বাণিজ্য, আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান।

রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরুর পর থেকে জ্বালানি নিয়ে নতুন সমীকরণের যুগে প্রবেশ করেছে পৃথিবী। চীন-রাশিয়া যদি একসঙ্গে এগিয়ে যায়, তাহলে একটি শক্তিশালী বলয় গড়ে উঠবে বা এরমধ্যেই যা গড়ে উঠেছে। এর সঙ্গে রয়েছে, দুই দেশের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ মধ্যপ্রাচ্য ইস্যু। মধ্যপ্রাচ্য ঘিরে তৈরি হচ্ছে, সম্পর্কের নতুন রসায়ন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুতিন ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর কয়েক দিন আগে দুই নেতা তাদের অংশীদারিত্ব একটি ‘সীমাহীন’ পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে ঘোষণা করেছিলেন। ২০২৩ সালের মার্চে প্রেসিডেন্ট শির মস্কো সফরের সময় তিনি দুদেশের সম্পর্ককে একটি ‘নতুন যুগ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। আর অক্টোবরে পুতিন সর্বশেষ বেইজিং সফরের সময় শি তাদের মধ্যে ‘গভীর বন্ধুত্বের’ কথা উল্লেখ করেছিলেন। দু’দিনের চীন সফরের আগে, ৭১ বছর বয়সি পুতিন বলেছিলেন, পঞ্চম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার পর তার প্রথম বিদেশ সফর হিসাবে চীনকে বেছে নেওয়া দু’দেশের মধ্যেকার ‘অভূতপূর্ব উচ্চ স্তরের কৌশলগত অংশীদারিত্ব’ এবং চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার ঘনিষ্ট সম্পর্ককেই নির্দেশ করে।

এ সপ্তাহে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) এক ফোরামে ১৩০টি দেশের প্রতিনিধিকে স্বাগত জানিয়েছে চীন। তারা মনে করছে এর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে তাদের মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পাবে। যদিও এই সফর আপাত দৃষ্টিতে যাই মনে হোক না কেন, এই সফরের ফলে উভয় দেশের সম্পর্ক আগের চেয়ে আরো বেশি শক্তিশালী হবে বলেই বিশ্লেষকদের ধারণা। উভয় দেশের নেতারই ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে কথা হয়েছে। গণমাধ্যম থেকে জানা গেছে, দুই দেশই ইউক্রেন যুদ্ধের একটি রাজনৈতিক সমাধান আশা করেন। কিন্তু সেই রাজনৈতিক সমাধান কি হবে, সেটি স্পষ্ট নয়। কারণ বিশ্ব রাজনীতি তো এখন গোলমেলে অবস্থানে রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কয়েক শত নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমামিত্ররা।

এমন অবস্থায় রাশিয়ার জন্য চীনকে দেখা হয় লাইফলাইন হিসেবে। অর্থাৎ মস্কোর প্রয়োজনে চীন তার পাশে রয়েছে। প্রযুক্তি এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করে মস্কোকে এই যুদ্ধে বেইজিং সহযোগিতা করছে বলে অভিযোগ আছে। কিন্তু চীনের দাবি, এসব প্রযুক্তির কোনোটিই প্রাণঘাতী নয়। এগুলো সবই বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য।

দুই মিত্রের যেখানে সাক্ষাৎ হয়েছে, সেই জায়গাটির নাম ঝোংনানহাই। এর গুরুত্ব হলো- এটি হলো চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির হেডকোয়ার্টার্স এবং শীর্ষ নেতাদের বাসস্থান।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সেখানে শুধু ঘনিষ্ঠ মিত্রদের আতিথেয়তা জানানো হয়। এখানে ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন শি জিনপিং। এর ১ বছর পরে বেলজিয়ামের রাজা ফিলিপের সঙ্গে সেখানে সাক্ষাৎ করেছিলেন শি জিনপিং। এর মানে তো অনেক কিছু হতে পারে। তবে পুতিন যে চীনের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তা নতুন করে বলার কিছু নেই। কারণ পশ্চিমাদের সঙ্গে চীনের দ্বন্দ্বে পুতিন চীনকে সমর্থন জোগায় রাশিয়া। সুতরাং এই সফরে দুই নেতার সম্পর্ক আরো একটু গাঢ় হলো- যা ভবিষ্যতে দুই দেশের সম্পর্ককে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবে বলেই বিশ্বাস।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত