এবার আলোক দূষণে হুমকি

মানবস্বাস্থ্যের সঙ্গে প্রভাব পড়ছে জীববৈচিত্র্যে

প্রকাশ : ১৯ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণের মতো পরিবেশের আরেক ক্ষতিকর বিষয় এখন আলোকদূষণ। এটি মানবস্বাস্থ্যের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব ফেলছে। আমরা প্রাকৃতিক আলোর সঠিক ব্যবহার করছি না। কৃত্রিম আলোনির্ভর হয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। উন্নত বিশ্বে এটাকে লাইট পলিউশন বলে। এটি ধরা ও ছোঁয়া যায় না। আলোকদূষণ তখন হয়, যখন আলোটা প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয়। কিংবা যে জায়গায় যে আলোটা দেওয়ার প্রয়োজন নেই; কিন্তু সে জায়গায় সে আলোটা ব্যবহার করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় আলোর বেশি ব্যবহার করলেই সেটি দূষণে পরিণত হয়। ঘরে-বাইরে কিংবা যে কোনো জায়গায় লাইট যখন পাওয়ার অনুযায়ী সঠিক স্থানে বসানো হয় না, তখন এটা দূষণের পর্যায়ে চলে যায়। অন্য দূষণের মতো আলোকদূষণও পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। আগে গাছে গাছে পাখি দেখা যেত, এখন আর তেমন দেখা যায় না। বিশেষ করে শহরের গাছপালায় পাখি খুবই কম। পাখিরা আবাসস্থল হারাচ্ছে। রাতে কৃত্রিম আলো বা বহিরঙ্গন আলোর অত্যধিক বা দুর্বল ব্যবহারে বন্যপ্রাণীর প্রাকৃতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত করে। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধিতে অবদান রাখে, মানুষের ঘুম ব্যাহত করে এবং রাতের আকাশের তারাকে অস্পষ্ট করে। এছাড়া বৃক্ষ ও প্রাণীর জীবনাচরণে বড় প্রভাব ফেলছে এই আলোকদূষণ। আমাদের শরীর থেকে সব সময় বিভিন্ন হরমোন নিঃসরণ হয়। আলো শরীরের হরমোন পরিবর্তনে প্রভাব ফেলে। পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর অনেক বড় প্রভাব ফেলে আলোকদূষণ।

আমাদের শরীর থেকে সব সময় বিভিন্ন হরমোন নিঃসরণ হয়। আলোকদূষণের ফলে এই নিঃসরণ ব্যাহত হয়। অনেকের ঘুম হয় না, মেজাজ খিটখিটে থাকে- এগুলোতে কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত আলোর প্রভাব আছে। এটা আমরা প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করতে পারি না। এই আলোকদূষণ বাচ্চাদের মনন ও বিকাশ বাধাগ্রস্ত করছে। দৃষ্টিশক্তি সমস্যা এখন অনেক শিশুর ছোটবেলা থেকেই, তাদের চশমা পরতে হয়। আমরা বাইরে থেকে ধুলা, মশা আসবে এই ভয়ে ঘরের জানালা বন্ধ করছি। ডে লাইট বা সূর্যের আলো থেকে দূরে থাকছি। একটি শহর শুধু মানুষ নিয়ে বাঁচে না। বাঁচে তার প্রাণ-প্রকৃতি, জীবজন্তু নিয়ে। মাত্রাতিরিক্ত আলোর কারণে পাখি ও প্রাণীর বিচরণেও সমস্যা হয়। এছাড়া আমাদের চারপাশে পোকামাকড়ের বিপর্যয়মূলক পতনের অনেক কারণের মধ্যে রয়েছে আলোকদূষণ। সারারাত রাস্তার পাশে আলো জ্বলে থাকলে আলোর চারপাশে পোকাণ্ডমাকড় ওঠানামা করে, কারণ তারা ক্লান্তি নিয়ে তাদের শক্তির ভাণ্ডার হ্রাস করছে, এতে তারা শিকারিদের সংস্পর্শে আসছে। কোথায় কতটুকু আলো প্রয়োজন তা বিভিন্ন সফটওয়্যারের মাধ্যমে বের করে, সেই অনুযায়ী আলোর ব্যবহার ও লাইটিং প্লেসমেন্ট করা যেতে পারে। আবার লাইট পরিমাপের লাইট মিটার রয়েছে। পাশাপাশি সূর্যের আলোর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে দূষণ অনেকাংশেই কমে যাবে। তবে স্থাপনায় আলোর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা স্থপতিদের কাজ। ভবনবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে পেশাজীবী তৈরির জন্য কোনো পড়াশোনা নেই। ভবনবিজ্ঞানীরা আলোকদূষণ কমানো বা আলোর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারেন। এক্ষেত্রে রাজউক, হাউজ বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট, গণপূর্ত বা সিটি করপোরেশনে এ ধরনের পেশাজীবীদের কাজে লাগানো যেতে পারে। আমাদের শহরে অনেক বিদ্যুৎ অপচয় হচ্ছে শুধু প্রাকৃতিক আলো ব্যবহার না করার কারণে। এক্ষেত্রে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও মানুষের সচেতনতার অভাব রয়েছে। ভবন নির্মাণে ত্রুটি থাকার কারণে আমরা প্রাকৃতিক আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। ভবন নির্মাণে আশপাশের কতটুকু জমি ছেড়ে দিতে হবে, কতটুকু রাখতে হবে, সেটা আমরা মানছি না। এখন অনেক সফটওয়্যার ছাড়াও নানা টুলস আছে। যেমন লাইট মিটার।

মোবাইল ফোনে লাইটিং অ্যাপ্লিকেশনও আছে। ইন্টারনেট ব্যবহার করেই জানা যাবে, কোথায় কতটুকু আলো প্রয়োজন। অথচ সূর্যের আলো সঠিকভাবে ব্যবহার করলে কৃত্রিম আলোর প্রয়োজন পড়ে না। ভবনগুলো এত লাগোয়া করে বানানো হচ্ছে, যে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না। বাতাস চলাচল করতে পারে না। আবার এ ভবনগুলোতে অনেক ধরনের লাইট আছে, যেগুলোর সঠিক ব্যবহার আমরা করতে পারি না। যেমন- স্পট লাইট, নিয়ন লাইট, ফ্লোরেসেন্ট লাইট ও হ্যালোজেন লাইট। ঘরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত আলো ব্যবহারে তা জ্বালানি বা শক্তির ওপর একধরনের চাপ তৈরি করে। বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিডে সেই চাপটা পড়ে। আমরা যদি বাইরের ডে-লাইট বা সূর্যের আলোকে ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারি ঘরের ভেতরে, তাহলে আলোর অপব্যবহার অনেকাংশে কমিয়ে আনতে সক্ষম হবো। এজন্য আমাদের ভবন ও বসতবাড়ির ডিজাইন এমনভাবে করতে হবে, যাতে বাইরের পর্যাপ্ত আলো আমাদের ভবনে ঢুকতে পারে। এভাবে যদি পরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণ ও সঠিক জায়গায় লাইট স্থাপন করি, তাহলে বিদ্যুৎ অপচয় রোধ করা যাবে। এজন্য আমাদের জনসচেতনতা দরকার। প্রতিটি বস্তুকণার ওপর যখন আলো পড়ে, তখন একটা প্রতিফলন হয়। সাদা রঙে এক ধরনের প্রতিফলন, কালো রঙে আরেক রকম প্রতিফলন। এই প্রতিফলন চিন্তা করে যদি আমরা আলোর ব্যবহার করি, তখন দূষণটা এড়ানো যেতে পারে। ভিজ্যুয়াল দূষণ কমানোর একটি সহজ উপায় হলো- কাঠামোতে কাঠ, পাথর বা বাঁশের মতো প্রাকৃতিক উপকরণ ব্যবহার করা। এই উপকরণগুলো আশপাশের ল্যান্ডস্কেপের সঙ্গে ভালোভাবে মিশে যেতে পারে, উষ্ণতা ও সম্প্রীতির অনুভূতি তৈরি করতে পারে এবং কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক উপাদানগুলোর মধ্যে বৈসাদৃশ্য কমাতে পারে। আলোর উচ্চতা কমিয়ে আনতে হবে। বাইরের আলোতে শেড দিয়েও আলোর ছিটা কমানো যেতে পারে। সর্বোপরি আলোকদূষণ নিয়ে সমাজে সচেতনাতা বাড়াতে হবে।