বুদ্ধ ধর্ম ও বুদ্ধ পূর্ণিমা

প্রদীপ বড়ুয়া জয়

প্রকাশ : ২২ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

প্রায় ২ হাজার ৬০০ বছর পূর্বেই তৎকালীন ব্রাহ্মণ রাজা শুদ্ধোধনের জ্যৈষ্ঠ সন্তান ছিলেন সিদ্ধার্থ যিনি পরবর্তীতে বুদ্ধ হিসেবেই পরিচিত হন। বুদ্ধ শব্দের অর্থ জ্ঞানী। যুবরাজ সিদ্ধার্থ ‘বুদ্ধ ধর্ম’র প্রবর্তক। যুবরাজ সিদ্ধার্থকে জ্ঞানী বা বুদ্ধ বলার প্রথম কারণ হলো তিনি পৃথিবীর প্রথম মানুষ, যিনি মানুষের মানবিক জ্ঞানকে সুবিকশিত করার শিক্ষা দিতে চতুরার্য সত্য ত্বত্ত্ব প্রচার করেছিলেন এবং দ্বিতীয় কারণ হলো, মানুষের জ্ঞান অর্জন বা জ্ঞান চর্চার জন্য বিহার বা বিদ্যালয়কে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন। তৎকালীন সময়ে সিদ্ধার্থের মতো এত জ্ঞানী পৃথিবীতে ছিল না বলেই তিনি বুদ্ধ বা জ্ঞানী হিসেবেই পরিচিত হন। আর বুদ্ধের প্রচারিত ধর্মকে বুদ্ধ ধর্ম বা জ্ঞানীর ধর্ম হিসেবেই বিশ্বজুড়ে সমাদৃত।

বুদ্ধ ধর্ম প্রচারের আগে পৃথিবীর প্রায়ই সব মানুষ অদৃশ্যশক্তির উপর ভরসা করত, প্রকৃতিকে পূজা করত, জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চার কোনো নজির নেই বললেই চলে। তার পিতা রাজা শুদ্ধোধন রাজ্য ও রাজার মঙ্গলের জন্য বিভিন্ন পূজা পার্বন পালন করতেন। ঈশ্বরের কৃপা লাভের আশায় রাজ পুরোহীতদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন এবং দক্ষিণা দিতেন। জন্মের পর থেকে তিনি অনেক ধার্মিক ও মেধাবী ছিলেন। এসব দেখে তিনি নানান প্রশ্ন করতেন এবং সদুত্তর খুঁজতেন। তিনি যখন রাজ্য ভ্রমণে বের হয়ে দেখতেন দেশের মানুষের দুঃখ, রুগ্ন, ব্যাধি, মৃত্যু লেগেই আছে। এসব দেখে সিদ্ধার্থ খুবই মর্মাহত হতেন। তখন রাজ পুরোহিতদের জিজ্ঞাসা করতেন, ঈশ্বরের সন্তুষ্টি লাভের জন্য রাজ পরিবার হতে দান দক্ষিণার কি কমতি হচ্ছে, যে দেশের মানুষের দুঃখ-ব্যাধি কমছে না? তখন রাজ মনীষীরা সিদ্ধার্থকে যা বললেন, তাতে কোনোভাবেই তিনি সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। শুধু জগতের মানুষের দুঃখ দূর করতে ঈশ্বরের কৃপা লাভের আশায় তিনি নিজেই সন্যাসী ধর্ম পালন করার সিদ্ধান্ত নেন। মহামণিঋষিদের কাছে দীক্ষা নিয়ে গৃহত্যাগ করে চলে গেলেন গভীর অরণ্যে। যেহেতু তিনি ছোট বেলা থেকেই ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান ও ধার্মিক ছিলেন, সনাতনী সব প্রথা মেনেই সিদ্ধার্থ ধ্যান বা তপস্যা শুরু করেন। ধ্যানরত অবস্থায় নিজের অজান্তেই কেটে গেছে ছয়টি বছর। যেখানে ধ্যানে বসেছিলেন সেখানে তার শরীরের চারপাশেই গাছ বড় হয়ে গেছে। যখন চেতনা ফিরে পেলেন তখনো ঈশ্বরের দেখা পেলেন না বা ঈশ্বরের অস্থিত্ব নিয়ে তিনি সন্দিহান হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। সুঠাম ও সুন্দর দেহের রাজকুমার ঈশ্বরের সন্ধানে তপস্যা করতে গিয়ে কঙ্কালসার দেহ নিয়ে কোনোভাবে নৈরঞ্জনা নদীতে গিয়ে স্নান সেরে অশ্বত্থ গাছের নিচে গিয়ে বসেন। ঠিক ওই মুহূর্তে কাকতালীয়ভাবে পায়েস নিয়ে হাজির হন শ্রেষ্ঠী কন্যা সুজাতা।

প্রতিনিয়তই সুজাতা বৃক্ষদেবতাকে পূজা দিতেই গিয়েছিলেন গভীর অরণ্যে, কিন্তু হঠাৎ দেবতাকে দেখে কিছুটা বিচলিত হয়ে পায়েস দিয়েই চলে দ্রুত চলে যান। পরে শ্রেষ্ঠীকে গিয়ে দেবতার সাক্ষাতের কথা জানালেন, দলবল নিয়ে দেবতা তথা সিদ্ধার্থকে দেখতে পান। পায়েস আহার ও ফলমূল আহারের পর ইতোমধ্যে সিদ্ধার্থ নিজের ভিতরের বিবেক স্বত্বা ফিরে পেলেন। যেহেতু সকল নিয়ম মেনেই ঈশ্বরের আরাধনা বা তপস্যা করেও তিনি ঈশ্বরের সন্ধান পাননি। তখন তিনি সুজাতার প্রশ্নের উত্তরে বলেন, নিজেকে নিজে জানাই হলো ধর্মের প্রথম সোপান। মানুষ নিজের জীবনের ভালো-মন্দ নিজের কর্মের দ্বারাই পরিচালিত হয়। মনুষ্যজীবন ধর্মের নয় কর্মের অধীন। তৎকালীন মানুষ দেবতাকে সামনাসামনি দেখতে এসে দেবতার এমন উপদেশ শুনবে, তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তারপরও সেখানে শুধু সুজাতাই সিদ্ধার্থের বাণীকে স্বীকার করেছিলেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। পরে ধীরে ধীরে ওই রাজ্যের সবাই বুদ্ধের অনুসারী হয়েছিলেন বলেও বলা হয়।

তৎকালীন সময়েই জ্ঞান বা বিদ্যার্জনের দ্বারা নিজের বিবেক, বুদ্ধি ও কর্মের উপর আস্থা রাখার শিক্ষা দিতেন। সেই সময়ের প্রথাগত কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস এর বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করতেন। অদৃশ্য কোনো শক্তির উপর আস্থা না রেখে বা ভরসা না করার শিক্ষা দিতেন। তিনি বহু ঈশ্বরবাদকে বিশ্বাস না করে মানুষের নিজের কৃতকর্মের ফল লাভ করার শিক্ষা দিতেন। এক কথায় বলতে গেলে, যুবরাজ সিদ্ধার্থই পৃথিবীর প্রথম ব্যক্তি যিনি জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা করতে বিহার বা বিদ্যালয় চালু করেছিলেন। আর বুদ্ধের জ্ঞান তত্ত্ব বা দর্শনই কালের বিবর্তনে ‘বুদ্ধ ধর্ম’ হিসেবে সমাদৃত হয়।

পৃথিবীর একমাত্র ধর্ম বুদ্ধ ধর্ম। এই ধর্মের প্রচারক সিদ্ধার্থ বা গৌতম বুদ্ধ মানুষকে অদৃশ্যশক্তির ভয় না দেখিয়েই বা সৃষ্টিকর্তার অস্থিত্বকে স্বীকার না করেও মানুষকে সৎ ও আদর্শবান মানবিক মানুষ হওয়ার জন্য শিক্ষা দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এই শিক্ষাই পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ অনুপ্রাণিত হয়ে পালন করেছে এবং এখনো করছে। বুদ্ধের অনুসারীকে বৌদ্ধ বলা হয়। বৌদ্ধদের বিভিন্ন শাখা রয়েছে। বুদ্ধের মূল স্রোতের অনুসারীদের স্থবীরবাদ বা হীনযান বলা হয়। আর বৌদ্ধ রাষ্ট্রসমূহ বিলুপ্ত হওয়ার পর বুদ্ধ ধর্মের সহিত মিশ্রিত হিন্দু ও আঞ্চলিক প্রথাগত নিয়মের অনুসারীদের মহাযানী বলা হয়। এই মহাযানীরা বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বিশেষ করে জাপান, চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, সিংগাপুর, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, ভূটান, মঙ্গোলিয়া, রাশিয়াসহ ইউরোপের অনেক দেশের মানুষ বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, বৌদ্ধ ধর্মের ভিত্তি ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান এই তিন দেশে হলেও পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে বৌদ্ধ এখন শূন্যের কৌটায়।

বৈশাখি পূর্ণিমার দিন সিদ্ধার্থ বা গৌতম বুদ্ধ জন্মদিন, বুদ্ধত্ব অর্জন ও পরিনির্বাণ বা মহাপ্রয়াণের দিন তাই বৈশাখি পূর্ণিমা তিথিকেই বুদ্ধ পূর্ণিমা বলা হয়। প্রায় ২ হাজার ৬০০ বছর ধরে এই দিনটিকে বৌদ্ধরা বিহারে বা প্যাগোডায় সমবেত হয়ে ধর্মীয় ও প্রথাগত নিয়মে বা বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে বুদ্ধ পূর্ণিমাকে পালন করে থাকে। বুদ্ধের জন্ম ও বুদ্ধত্ব অর্জন সুখের এবং উনার মৃত্যুর দিনটিও শোকের না হয়ে সুখের বলে ধরা হয়। কারণ তিনি নির্বাণ লাভী ছিলেন। তৎকালীন ধর্মীয় প্রথাগত নিয়ম বা ধর্মে পরকাল বিশ্বাস চূড়ান্তসীমায় কিন্তু বুদ্ধের ভাষায় নির্বাণ হলো, পরকাল নেই বা জন্মান্তর নেই। প্রাণীর দেহ পৃথিবীর ন্যায় নশ্বর বা অস্থায়ী। আর পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে জ্ঞানী হয়ে জন্মায়। বুদ্ধের ভাষায় মানুষ চার প্রকার।

১। পরমার্থ মানুষ : হিতাহিত জ্ঞান সম্পন্ন, আত্মসম্মান বোধ আছে, পুণ্যকর্মে সদা নিয়োজিত কিংবা জ্ঞান অর্জনের সদা সচেষ্ট থাকে।

২। মৈরয়িক মানুষ : যারা প্রাণীহত্যা করে, হত্যাকাণ্ড ঘটায় এবং বিভিন্ন পাপকর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করে। তারা উক্ত কৃত কর্মফল হিসেবে দুঃখজনক শাস্তি ভোগ করে।

৩। প্রেত মানুষ : যারা অভাব অনটনে জর্জরিত থাকে কিংবা মানসিক ভারসাম্যহীন কিংবা মানসিক যন্ত্রণায় উদ্বাস্তুর মতো ঘুরে বেড়ায়, যারা অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়ে অখাদ্য কুখাদ্য খায় কিংবা অশুচিভাবে দুর্বিসহ জীবনযাপন করে।

৪। তীর্যক মানুষ : পশুর ন্যায় জীবনধারণ করে, কুকুর, বেড়াল, হাঁসমুরগী কিংবা পিচাশের ন্যায় চলাফেরা বা জীবনধারণ করে। যাদের চরিত্রহীন লম্পট যাদের হিতাহিত জ্ঞান নাই, আত্মসম্মান নেই। পশুর ন্যায় জ্ঞানহীন ও জীবনাচরণ করে।

পাশাপাশি বুদ্ধ মানুষকে চারটি সত্যকে স্বীকার করার শিক্ষা দিয়ে গেছেন, যা চতুরার্য সত্য হিসেবে অভিহিত। ১। দুঃখ ২। দুঃখ সমুদয় ৩। দুঃখ নিরোধ ৪। দুঃখ নিরোধের উপায় বা পথ।

দুঃখ : চতুরার্য সত্যের প্রথম সত্য হল দুঃখ। মানুষের তৃষ্ণা প্রকট হলে, তখন তাকে উপাদান স্কন্ধ বলে। এই পঞ্চ উপাদান স্কন্ধকে বুদ্ধ দুঃখ বলেছেন। এই পঞ্চ উপাদান হলো- ১. রূপ, ২. বেদনা, ৩. সংজ্ঞা, ৪. সংস্কার ও ৫. বিজ্ঞান।

রূপ উপাদান আবার ৪ প্রকার- ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ। বেদনা উপাদান হলো, বস্তু ও তার বিচার সম্বন্ধে অনুভব। বেদনার পর যে পূর্ব সংস্কার দ্বারা ব্যক্তি বা বস্তুকে চেনা যায় তা হলো সংজ্ঞা উপাদান। রূপ, বেদনা ও সংজ্ঞা দ্বারা চিন্তায় প্রকৃত ব্যক্তি ও বস্তুকে চিনতে সাহায্য করে সংস্কার উপাদান এবং চেতনা বা মনকে বলে বিজ্ঞান। বুদ্ধ মানুষের ষষ্ট ইন্দ্রিয়ের প্রবক্তা ছিলেন। সিদ্ধার্থ বা বুদ্ধ জ্ঞান অর্জনে বিজ্ঞান আবিস্কার তথা মেধা বিকাশের প্রচেষ্টা চালিয়েছেন আজীবন।

বুদ্ধ আবার দুঃখকে মূলতঃ তিনভাগে বিভক্ত করেছিলেন-

১. দুঃখ দুঃখ : এর অধীনে রয়েছে জন্ম, জরা, ব্যাধি এবং মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত দৈহিক ও মানসক কষ্ট।

২। বিপরিণাম দুঃখ : পরিবর্তনশীল-বিষয়কে স্থির রাখার দুশ্চিন্তাই হলো বিপরিণাম দুঃখ।

৩। সংস্কার দুঃখ : মানসিক চাহিদা পরিপূরণের অভাববোধকে সংস্কার দুঃখ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

গৌতম বুদ্ধের মতে মানুষের জীবনে সুখ ও দুঃখ থাকে যা সদা পরিবর্তনশীল। সুখ ও দুঃখ কোনটিই বেশিদিন স্থায়ী নয়। সেই কারণে পরিবর্তনশীল সমাজে চাহিদার পূরণ সম্ভব হয় না।

দুঃখ সমুদয় : দুঃখ সমুদয় বা দুঃখের কারণ হিসেবে তৃষ্ণা বা আসক্তিকে উল্লেখ করেছেন। বুদ্ধের মতে, অবিদ্যার কারণে বিশ্বের সকল প্রকারের ইন্দ্রিয়প্রিয় বস্তু বা বিষয়ের ওপর চিন্তা ও সম্বন্ধ স্থাপনে তৃষ্ণার জন্ম দেয়। এই তৃষ্ণা আবার ৩ ধরনের। যেমন-

১. সম্ভোগ তৃষ্ণা : যে বস্তু পার্থিব আনন্দ প্রদান করে, তার ওপর তৃষ্ণা

২. ভব তৃষ্ণা : পার্থিব সম্মান ও প্রভাব বিস্তারের ওপর তৃষ্ণা

৩. বৈভব তৃষ্ণা : দুঃখ কষ্টের প্রতি বিতৃষ্ণা

অবিদ্যা কী? যারা চতুরার্য সত্যের অর্থ ও তাৎপর্যকে না জানা ও নিজেকে বা বাস্তবকে না বোঝাকেই অবিদ্যা বলা হয়ে থাকে। আর বুদ্ধ বলেন, অবিদ্যার কারণে ক্লেশের উদ্ভব হয়ে থাকে। দুঃখের মূল কারণ রূপে ত্রি-বিষের উল্লেখ করা যায়। এই তিনটি বিষ হলো- মোহ, রাগ এবং দ্বেষ।

দুঃখ নিরোধ : দুঃখ নিরোধ হলাে গুণ বা ধর্ম। সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধের দর্শন কীভাবে ধর্ম হলো তার সকল দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু হলো দুঃখ নিরোধ বা মানুষের গুণগত চেতনা বা বিজ্ঞান।

বুদ্ধ বলেন, তৃষ্ণাকে দৃঢ় ভাবে সংযত করে ও ক্রমশ পরিত্যাগ করে বিনাশ করাকে দুঃখ নিরোধ বলে। প্রিয় বিষয়ে তত্ত্ব নির্ণয়ে সংশয় থেকে যখন তৃষ্ণা বিমুখ হয়, তখন তৃষ্ণা নাশ সম্ভব এবং তার ফলে বিষয় সংগ্রহের প্রবণতা নষ্ট হয়। উপাদানের নিরোধে ভবলোকের নিরোধ হয়। ফলে বার্ধক্য, মৃত্যু, শোক, ক্রন্দন, ক্লেশ ও জটিলতা দূরীভূত হয়ে দুঃখের নিরোধ হয়। আর একজন মানুষ প্রকৃত জন হিসেবেই পৃথিবীতে বিবেচিত হন। আর সেই প্রকৃতজনই হলো পার্থিব মানুষ যাদেরকে এই পৃথিবীর মানুষ গুণবান বা ধার্মিক মানুষ বলে। আর বুদ্ধের ধর্ম এইভাবেই পৃথিবীতে শুধু জ্ঞানীদের মাঝেই সমাদৃত হয়। আর বুদ্ধের জ্ঞান দর্শন বুঝার মত মানুষ জগতে বিরল।

দুঃখ নিরোধ মার্গ : এখানে মার্গ হলো উপায় বা পথ। যেখানে চতুরার্য সত্যের প্রথম তিনটি সত্য দুঃখের বৈশিষ্ট্য ও কারণকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। সেখানে এর চতুর্থ সত্য দুঃখ নিবারণের ব্যবহারিক উপায় হিসেবে উল্লেখ করেছেন বুদ্ধ। দুঃখ নিরোধ মার্গ বা পথ হলো আটটি। সংক্ষেপে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলা হয়ে থাকে।

বুদ্ধের এই আটটি উপদেশকে সম্যক প্রজ্ঞা, সম্যক শীল ও সম্যক সমাধি এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

এইখানে সম্যক প্রজ্ঞা দুই প্রকার- সম্যক দৃষ্টি ও সম্যক সঙ্কল্প। কায়িক, বাচনিক ও মানসিক কর্মের সঠিক জ্ঞানকে সম্যক দৃষ্টি বলে। অহিংসা, চুরি না করা, অব্যভিচার ও সত্যভাষণ হলো কায়িক সুকর্ম, নিন্দা না করা, মধুর ভাষণ ও লোভহীনতা হল বাচনিক সুকর্ম এবং মিথ্যা ধারণা না করা ও প্রতিহিংসাপরায়ণ না হওয়া হলো মানসিক সুকর্ম।

সম্যক শীল তিন প্রকার- সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম ও সম্যক জীবিকা। মিথ্যা কথা, পরনিন্দা, কটুবাক্য ও অতিকথন ত্যাগ করে সত্যভাষণ ও মধুর বচনকে সম্যক বাক্য বলে। অহিংসা, চুরি না করা, অব্যভিচারকে সম্যক কর্ম এবং অসৎ পন্থা ত্যাগকে সম্যক জীবিকা বলে। গৌতম বুদ্ধ অস্ত্র ব্যবসা, প্রাণী ব্যবসা, মাংস বিক্রয় এবং মদ ও বিষের বাণিজ্যকে মিথ্যা জীবিকা বলে উল্লেখ করেছেন। সম্যক সমাধি তিন প্রকার- সম্যক প্রযত্ন, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি। ব্যায়াম, ইন্দ্রিয় সংযম, কুচিন্তা ত্যাগ এবং সৎ চিন্তার চেষ্টা ও তাকে স্থায়ী করার চেষ্টাকে সম্যক প্রযত্ন বলে। কায়া, বেদনা, চিত্ত ও মনের ধর্মের সঠিক স্থিতিসমূহ ও তাদের ক্ষণবিধ্বংসী চরিত্রকে সদা স্মরণে রাখাকে সম্যক স্মৃতি এবং চিত্তের একাগ্রতাকে সম্যক সমাধি বলে।

বুদ্ধের শিক্ষা হলো, উপরিউক্ত এই আটটি মার্গ বা পথ অনুসরণ করলে একত্রে দুঃখের অবসান ঘটায়। এই মার্গগুলি আটটি বিভিন্ন দশা নয়, বরং একে অপরের ওপর নির্ভরশীল পরস্পর সংযুক্ত হয়ে একটি সম্পূর্ণ পথের সৃষ্টি করে।

মানব জীবনের দুঃখের অবসান ঘটাতে হলে দুঃখ নিরোধের উপায় বা আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ বা পথ অনুসরণ করার বিকল্প নেই। আর তাই সিদ্ধার্থ বুদ্ধত্ব অর্জন করে বা জ্ঞান অর্জন করে তার শৈশবকালের অতি ঘনিষ্ঠ পাঁচজন বন্ধুকে ধর্মাচরনের জন্য পাঁচটি শিক্ষা দেন। ওই পাঁচজন বন্ধুকে পঞ্চবর্গীয় শিস্য এবং পাঁচটি শিক্ষা বৌদ্ধদের কাছে পঞ্চশীল হিসেবে অভিহিত। বুদ্ধ পরমার্থ মানুষ হিসেবে মানুষকে ইহজগতে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে মানুষের জন্য যে পাঁচটি শিক্ষা দিয়ে গেছেন, তা হলো- ১. প্রাণিত্ব হত্যা না করা ২. মিথ্যা না বলা ৩. চুরি না করা ৪. ব্যাবিচার বা অযাচিত কামাচার না করা ৫. মাদক সেবন না করা। এইভাবে গৃহীদের জন্য পঞ্চশীল বাধ্যতামূলক করা হয়। সাধুদের জন্য অষ্টশীল, শ্রামণদের জন্য দশ শীল এবং ভিক্ষুদের জন্য ২২৭শীল নির্ধারন করা হয়। বুদ্ধের মতে, এই শীল পালনের মাধ্যমে মানুষের ইহজগতে অবস্থান তৈরি করে। বুদ্ধ বলেছেন, এই জগতসংসারে বা পৃথিবীতে মানুষের ৩১টি স্থান বা অবস্থান নির্ণিত হয়। আর ৩১টি অবস্থানকে বুদ্ধ ৩১ লোকভুমি হিসেবে অভিহিত করেছেন। আর ৩১ প্রকার অবস্থান মানুষ তাদের কর্মের দ্বারাই প্রাপ্ত হয়। তাই গৌতম বুদ্ধ কর্মবাদ তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। বর্তমানে যেমন কর্ম তেমন ফল উক্তিটিও বুদ্ধের আবিষ্কার। বুদ্ধ বলেছেন, মানুষ তার গন্তব্যে বা লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে, তার কর্মই মূখ্য। একটি মানুষ শৈশব থেকে কৈশোরে কর্মের ফল হিসেবে পৃথিবীতে বা সমাজে তার জীবনের অবস্থান তৈরি করে। যেমন, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে সে ইঞ্জিনিয়ার কিংবা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিলে ডাক্তার হওয়া সম্ভব। একজন মানবিকের ছাত্র ডাক্তার হওয়া অসম্ভব বলা চলে। অর্থাৎ মানুষ যে বিষয়ের লক্ষ্যে কর্ম সম্পাদন করে, সেই ফলই সে প্রাপ্ত হবে। এটাই বুদ্ধের শিক্ষা। মানুষ তার কর্মের ফলে ৪ প্রকার মানুষের মধ্যে নিকৃষ্ট তীর্যক মানুষ এবং সর্বোচ্চ পরমার্থ মানুষ হিসেবে এই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে। আর পরমার্থ মানুষ হিসেবে সর্বোচ্চ স্থান তখনই প্রাপ্ত হবে যিনি অবিদ্যাকে দূর করে বা চতুরার্য সত্যকে মেনে জ্ঞান, বিজ্ঞান, ধন, যশ, খ্যাতির অধিকারী হবেন তিনিই নির্বাণলাভ করিবে। পৃথিবীতে এই অবস্থান থেকে মানুষ কখনও তীর্যক মানুষ হিসেবে বা নি¤েœ অবস্থান নিতে হয়না। কারণ বুদ্ধের ভাষায়, নির্বাণ হলো, যে মানুষ উপরিস্থান থেকে কখনো নিচে আসতে হয়না।

এছাড়া বুদ্ধের অহিংসার বাণী নিয়ে সাধারন মানুষের কাছে অতি সমাদৃত হতে থাকে আর কল্পিত শক্তি, অদৃশ্য শক্তি, বহু ঈশ্বরবাদসহ প্রকৃতির পূজারীগণ সাদরে গ্রহণ করেছিল। তৎকালীন সময়ে দলে দলে বুদ্ধের জ্ঞানের কাছে নিজেদের সমার্পন করলেও বুদ্ধ অনুসারীদের বলেন, আমার মতো তুমিও জ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে, যদি তুমি জ্ঞান অর্জন কর আর আমার বাণীকে নিজের মধ্যে ধারণ করে অধ্যয়ন কর। আমি স্বয়ং বুদ্ধ কিংবা আমার শিস্যগণও তোমাদের রক্ষা করতে পারবে না। আমার অহিংসামূলক জ্ঞানের বাণী পালনের মাধ্যমে বা তোমাদের স্বীয় সৎ কর্মই তোমাদের রক্ষা করিবে। কোনো অদৃশ্য শক্তির প্রতি আস্থা না রেখে বা ভরসা না করে, একজন মানুষকে নিজেদের ভেতরের মানবিক গুণাবলীগুলোকে অর্জনের মাধ্যমে বুদ্ধ বা জ্ঞানী হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন।

(অনেক লেখক ‘বুদ্ধ পূর্ণিমা’ না লিখে ‘বৌদ্ধ পূর্ণিমা’ লিখেন। বুদ্ধ ধর্ম এবং বুদ্ধ পূর্ণিমা হবে। বুদ্ধের অনুসারীদের বৌদ্ধ বলা হয়। তাহলে বৌদ্ধ ধর্ম কীভাবে হয়? কারণ অঞ্চলভেদে বৌদ্ধরা বিভিন্ন প্রথাগত নিয়মেই ধর্ম পালন করে থাকে। তাই অনেকে বুদ্ধ ধর্মের পরিবর্তে বৌদ্ধ ধর্ম বলতে পারে কি না, সেটার যথেষ্ট মতভেদ আছে কিন্তু বৌদ্ধ পূর্ণিমা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়, যা ভাষাগত কিংবা তত্ত্বগতভাবে ভুল লিখা হয়। )

লেখক : সাংবাদিক, এশিয়ান টিভি।