বাঙালির অস্তিত্বের কবি কাজী নজরুল

এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া

প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি/এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশী।/একজনে দিলে ব্যথা-/সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা।/একের অসম্মান/নিখিল মানব-জাতির লজ্জা-সকলের অপমান!/মহা-মানবের মহা-বেদনার আজি মহা-উত্থান,/ঊর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নীচে কাঁপিতেছে শয়তান! (কুলি-মজুর)।

কাজী নজরুল ইসলামের অমর স্মৃষ্টি। আমাদের জাতীয় অস্তিত্বে কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি জাতিসত্তার অন্যতম রূপকার। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সকল সময় ছিল তার অবস্থান। শিল্পী সত্তায় দেশপ্রেম, মানবপ্রেম এবং মানবমুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও গভীর উপলব্ধি ছিল তার রচনায়। গবেষকদের বিবেচনায়, যুগস্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলাম অস্তিত্বের প্রকৃত গড়ন সময়ের কামারশালায় বিশ্ব পরিস্থিতির তৎকালীন তাপ-চাপ, অমানবিকতার নিঃসংশয় নির্লজ্জ প্রকাশের পটভূমিতে।

কাজী নজরুল ইসলাম মানতেন- ব্যক্তিকে নির্ভর করেই নির্মিত হয় সমষ্টির অস্তিত্ব ও অবস্থিতি। সকল ধর্মের মানুষের জীবনধারাকে অখণ্ড জীবনধারায় পরিণত করার প্রতি তার প্রবল ঝোঁক ছিল। তার রচনায় স্থান পেয়েছে অস্তিত্ববাদী ও মানবতাবাদী চিন্তার নিঃশঙ্ক প্রকাশ; দরিদ্র-অশিক্ষিত-ক্ষুধার্ত-অত্যাচারিত জনতার জন্য রুটি-কাজ আর সৌন্দর্য উপভোগের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় সাজিয়েছেন কবি তার কথামালায়। নজরুল ছিলেন জনতার কাতারের দাঁড়ানো এক শক্ত মানুষ; ফাঁকবিহীন সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার ভূমিকায় তিনি ছিলেন অকুতোভয় সৈনিক।

কাজী নজরুল ইসলামের শিরা-শোণিতের সংক্ষোভ, ইতিবাচকতা আজ বাংলা কবিতায় বড় বেশি প্রয়োজন। প্রখ্যাত কবি জীবনানন্দ দাস নজরুল সম্পর্কে বলেছেন- ‘নজরুল ঊনবিংশ শতকের ইতিহাস প্রান্তিক শেষ নিঃসংশয়বাদী কবি।’ কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যবাদী চেতনার আদর্শ ছিল আলাদা। তিনি দেখেছেন ভারতবাসীর ওপর শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের নির্মম অত্যাচার এবং শোষণকে। এই উদ্দেশ্যের পথে শ্বেতাঙ্গরা সঙ্গে নিয়েছে ভারতবর্ষীয় জমিদার-মহাজনদের। ধর্মধ্বজাধারীরাও তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিরীহ মানুষের ওপর উৎপীড়ন চালিয়ে নিরন্ন এবং অসহায় করেছে। এই অসাম্য দেখে নজরুলের কবি হৃদয় হাহাকার করে উঠেছে। তাই জনদরদি রোমান্টিক কবি সাম্যবাদ নিয়ে হাজির হয়েছেন তার রচনায়। মানুষকে উদ্ধারের বিপ্লবের মন্ত্রে তাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। একদিকে যেমন বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্বের পরিচয় রেখেছেন এবং অসহায় মানুষদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্ত করতে সাম্যের গান শুনিয়ে বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্বের আড়ালে একটি কোমল হদয়ের সন্ধান দিয়েছেন। তেমনি সর্বমানবের মুক্তি এবং সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা নজরুলের যেমন উদ্দেশ্য, তেমনি মার্কসেরও উদ্দেশ্য। তবে পার্থক্য শুধু আদর্শগত। নজরুল মার্কসের মতো বস্তুবাদী ছিলেন না। মানবসমাজের ইতিহাসকে অর্থনৈতিক দিক থেকে আলোচনাও করেননি। শুধু সোচ্চার ছিলেন ধর্মীয় সাম্য ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে।

এখানেই কবি কাজী নজরুল ইসলাম উচ্চারণ করেছেন- গাহি সাম্যের গান/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান।/যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিমণ্ডক্রীশ্চান।

বিশেষ এক কালপর্বে নজরুল বিস্ময়কর প্রতিভা। দেশ-কালের সঙ্গে তার অন্তরাত্মার যে যোগাযোগ, সেই শক্তি তাকে কালান্তরে মহানায়কের ভূমিকায় আসীন করেছে। ক্রান্তি-সঙ্কটের এই বর্তমানে নজরুল আমাদের আরো অধিকতর প্রাসঙ্গিক এবং নমস্য। সমূহ অন্যায়-অবিচার আর সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বিপক্ষে তার স্বভাবজ আবেগের স্পন্দন-বিলোড়নের অন্তরালে আন্তরসত্যে অঙ্গীকার ছিল সুদৃঢ়।

নজরুলের অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, গণতান্ত্রিক জীবন-ব্যবস্থার জন্য তার আকাঙ্ক্ষা, তার ধর্মনিরপেক্ষ জীবনবোধ বাঙালিকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে প্রহরে প্রহরে। ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই, নহে কিছু মহীয়ান’ আজ যেন আমাদের প্রাত্যহিক উচ্চারণের মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের ও জাতির শান্তি রক্ষায় কিংবা পারস্পরিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় তার যে অভিব্যক্তির প্রকাশ, তা জাতীয় চেতনার প্রতি তার প্রবল বিশ্বস্ততাকেই ধারণ করে। হিংসামুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রতি ছিল তার প্রবল ঝোঁক। নজরুলের সৃষ্টিশীল কর্মজীবনের মূল সাধনা ছিল জাতি-ধর্মের-গোত্রের বিভেদমোচন। নজরুল সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় অন্যায়, অপশক্তির মূল উৎপাটনের দিকেও সচেতন মানুষের বিশেষ দৃষ্টি কামনা করেছেন এবং তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, যে রাজশক্তি মানুষের প্রতি পাশবিক আচরণ করে, যে রাজশক্তি অগণন নারীকে বিধবা কিংবা সন্তানহারা করে, সেই রাজশক্তির ধ্বংস অনিবার্য। জাগ্রত জনতাই নজরুলের আরাধ্য ছিল। তাই জাগ্রত হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কোনো প্রকার ধর্মবিদ্বেষ দৃষ্টিগোচর হয়নি তার। দেখাননি জাতিবিদ্বেষও। জাতি-গোত্রকেন্দ্রিক হানাহানি থেকে মুক্ত হয়ে ভালোবাসার সাগরে ভাসবার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। মানুষের ও সমাজের মূল্যবোধ পরিবর্তনের অনুপ্রাণিত ঢেউ। নজরুল খেটে-খাওয়া মানুষের জয়ধ্বনি করেছেন। বৈজ্ঞানিক যুক্তি-তর্কের ওপর নির্ভর করে নয়, নিজস্ব চিন্তা-চেতনার বশবর্তী হয়ে সমাজের সর্বস্তরের অসাম্যের প্রতি বিরোধিতা করতে গিয়ে, নজরুল সাম্যবাদের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছেন।

সমকালের অন্যান্য কবি-সাহিত্যিক ও রাজনীতি সচেতন বাঙালির মতো কাজী নজরুল ইসলামকেও বাধ্য হয়ে শ্রেণিবিভক্ত সমাজ, সর্বহারা শ্রেণি, শ্রমিক, শ্রমণ্ডশোষণ, বাজার, মুনাফা, পুঁজি, উদ্বৃত্ত ইত্যাদি পরিভাষার মর্মার্থ আত্মস্থ করতে হয় সময়ের একান্ত প্রয়োজনে। একই সঙ্গে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ ও এর আলোকে বিশ্ব সমাজকে পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ করার পদ্ধতিটিও রপ্ত করতে হয়। লক্ষণীয়, তার স্বকালই নজরুলের চৈতন্য গড়ে দিচ্ছে বিপরীতধর্মী বিচিত্র ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে।

দারিদ্র্যের কষাঘাতে ক্ষতবিক্ষতের দাগ গায়ে আঁচ পড়তে দেননি কাজী নজরুল ইসলাম। সুঠাম দেহের বলিষ্ঠ পদচারণায় মানুষের মধ্যে আশা-আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলেছেন সারাজীবন নিজের দুঃখ-কষ্ট ভুলে। আর্থিক দুর্যোগের মধ্যে ১৯৪০ সালে তার প্রিয়তমা স্ত্রী প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত হন। ১৯৬৩ সালে মৃত্যুপূর্ব পর্যন্ত তাকে বিছানায় যন্ত্রণাকর জীবন কাটাতে হয়।

১৯৪১ সালে কবির ৪৩তম জন্মজয়ন্তীর পরের বছরই ২০ আগস্ট নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। রোগে আক্রান্ত হওয়ার ১১ বছর পর নজরুলের চিকিৎসার জন্য একটি তহবিল গঠন করা হয়। লন্ডন ও ভিয়েনার চিকিৎসাদল পরীক্ষা করে দেখেন নজরুল আর আরোগ্য লাভ করবেন না। এইভাবে তার সমসাময়িক সবচেয়ে বাকপটু স্পষ্টবাদী নজরুল স্তম্ভিত হয়ে পড়েন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ১৯৭২ সালের ২৪ মে (১৩৭৯ সনের ১০ জ্যৈষ্ঠ) কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে ভারত থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে আনা হয়, বাংলাদেশ বিমানে করে। তাকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মাত্র আটদিন পর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কাজী নজরুলকে ঢাকায় নিয়ে আসার প্রাথমিক আমন্ত্রণ জানানো হয় ভারত সরকারকে। ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে আসার সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন আহমদকে সঙ্গে নিয়ে কাজী নজরুল ইসলামকে স্বাধীন বাংলাদেশ সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানান। এর মাত্র ৫ দিন পর স্বামীর পক্ষে জোহরা তাজউদ্দীন এ আমন্ত্রণপত্র কবির কাছে পৌঁছে দেন। জবাবে কবি পরিবারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়, শিগগিরই তিনি বাংলাদেশ সফরে আসবেন।

এর মাত্র দেড় মাস পরেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে যান ভারতে। অবস্থান করেন ১৯৭২ সালের ৬ থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় পৌঁছেই বঙ্গবন্ধু কবির সুস্থতা কামনা করে তাকে দুইটি ফুলের তোড়া পাঠান। এরপরের দিন কবির দুই পুত্র কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ সস্ত্রীক রাজভবনে শেখ মুজিবুরের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সেখানেই বঙ্গবন্ধু তার সরকারের পক্ষে নজরুলের পুত্রদের কাছে কবিকে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানান। প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে দুই ভাই ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসেন। এ সফরে তারা অসুস্থ কবিকে কীভাবে বাংলাদেশে আনা যায়, তা নিয়ে তারা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন।