ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

‘খুন’ কিন্তু ‘লাশ নেই’ : কী বার্তা দিল!

শফিকুল ইসলাম খোকন
‘খুন’ কিন্তু ‘লাশ নেই’ : কী বার্তা দিল!

ছোটবেলা থেকে একটি কথা শুনে আসছি তা হলো ‘রহস্যের পেছনে রহস্য’। যে কোনো ঘটনার পেছনে কোনো না কোনো রহস্য থাকে। তা হোক অনিয়ম-দুর্নীতি, খুন-রাহাজানি, ডাকাতি ইত্যাদি। ঘটনার পর তদন্তে বেড়িয়ে আসে আসল ঘটনা বা এর পেছনের রহস্য। সে অনুযায়ী দোষীরা বিচারের মুখোমুখিও হয়। আর এসব ঘটনার পর রহস্যসহ নানা কৌতূহলও থাকে জনমনে। এমন কৌতূহল আর রহস্যে ঘেরা এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারের খুন নিয়ে। খুন হলো; কিন্তু লাশ পাওয়া গেল না। আবার খুন হলো- বিদেশে, সেখানে হত্যাকারীরা কী দেশি না বিদেশি? কী কারণে খুন হলো? ব্যবসায়িক বিরোধ, রাজনৈতিক বিরোধ, না অন্য কোনো কারণে? এখন দেশব্যাপী এমন নানা প্রশ্ন জনমনে। এমন ঘটনায় প্রশ্ন আসাটা স্বাভাবিক নয় কী?

এরই মধ্যইে কিছুটা রহস্য উন্মোচন হয়েছে। ভারতে চিকিৎসা করাতে গিয়ে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। আর এই পরিকল্পনার মূল নায়ক তারই ছোটবেলার বন্ধু ও ব্যবসায়ী পার্টনার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আক্তারুজ্জামান শাহীন। তিনি মূল পরিকল্পনায় হলেও হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয় চরমপন্থি নেতা আমানুল্লাহ আমানকে। আমান তার সহযোগীদের নিয়ে কলকাতায় শাহীনের ভাড়া বাসায় হত্যা মিশন সফল করেন। এমপি আনারকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে। তার মরদেহ অসংখ্য টুকরো করে ট্রলিব্যাগের মাধ্যমে অন্যত্র সরিয়ে ফেলেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওয়ারী বিভাগ আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করেছে। এরইমধ্যে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া চরমপন্থি নেতা (পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি) আমানসহ তিনজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তারা জানিয়েছে, হত্যাকাণ্ড সফল করতে শাহীন তাদের সঙ্গে পাঁচ কোটি টাকা চুক্তি করেন। কিলিং মিশন সফল করতে সেই টাকার একটি অংশও পরিশোধ করেছেন তিনি। তবে শাহীন কত টাকা পরিশোধ করেছেন, সে বিষয়ে এখনও জানা যায়নি। এমপি আমান খুন নিয়ে এরমধ্যেই দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে সংবাদ পরিবেশন হয়েছে। তাতে এখন পর্যন্ত ধারণা- তিনি খুন হয়েছেন এবং এ খুনের পেছনে অনেক রহস্য রয়েছে। আপাতত কীভাবে খুন হয়েছে, কোথায় বসে খুন করা হয়েছে, তাও প্রাথমিকভাবে প্রকাশ পেয়েছে।

ইতিহাসে এই প্রথম স্বাধীন দেশের নাগরিক একজন এমপি খুন হয়েছেন বিদেশে। তাও আবার রহস্যজনক। খুন হওয়ার পর তাকে খণ্ড খণ্ড করে ট্রলি ব্যাগভর্তি করে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। খুব ঠান্ডা মাথায় কিলিং মিশনসম্পন্ন করা হয়েছে। যা হোক, হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিষয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বক্তব্য অনুযায়ী, এমপি আনার খুনের ঘটনায় বাংলাদেশিরাই জড়িত, এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এরই মধ্যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরো কয়েকজনকে গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হচ্ছে। ঘটনাটি নিয়ে যৌথভাবে দুই দেশের পুলিশ কাজ করছে। এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্যেও একই কথা প্রকাশ পেয়েছে। তারপরেও প্রশ্ন থেকেই যায়, কেন খুন হলেন এমপি, কেনই বা দেশের মাটিতে না করে বিদেশের মাটিতে খুন করা হলো? এ খুনের সঙ্গে কি শুধু বাংলাদেশি জড়িত? নাকি ভারতের নাগরিক রয়েছে? কেনই বা খুনের পর আলামত রাখা হলো না? হ্যাঁ, যদিও অপরাধীরা অপরাধ করে আলামত নষ্ট করবে এটাই স্বাভাবিক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- একজন এমপি বিদেশের মাটিতে কেন নিরাপদ নয়, কেন তাকে নিরাপত্তা দেয়া হয়নি। শুধু এমপির বেলায়ও নয়, একজন নাগরিক ভারতে যথাযথ নিয়ম মেনেই প্রবেশ করে থাকেন, এমপি আনানের বেলাও তাই হয়েছে। তিনি তো ভারতে প্রবেশ করা মাত্রই ভারতের সব রকমের নিয়ম মেনেই থেকেছেন এবং ওই দেশের সরকারকে ভ্যাট-ট্যাক্সও দিয়েছেন। আমরা স্বাভাবিকভাবে যা দেখি, বাংলাদেশে যদি কোনো বিদেশি নাগরিক আসে, তাহলে তার সব ধরনের নিরাপত্তা দিয়ে থাকেন বাংলাদেশ সরকার। তাছাড়া গোয়েন্দা সংস্থারও নজর দারি থাকেন, তাহলে কেন একজন এমপিকে ভারত সরকার নিরাপত্তা দেবে না বা তাদের নজর দারি থাকবে না?

আমাদের দেশের মন্ত্রী-এমপিদের নিরাপত্তায় বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। স্থানীয় পর্যায় এমপিদের পুলিশ প্রটোকল রয়েছে। যদিও গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মনজুরুল ইসলাম লিটনকে গুলি করে হত্যার পর সংসদ সদস্যদের নিরাপত্তার বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় উঠে আসে। ২০১৭ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিদের নিরাপত্তায় বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। সে সময় বেশ কিছু এমপি প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা চেয়ে স্পিকারের কাছে লিখিত ও মৌখিক আবেদন করেছিলেন। জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকেও নিরাপত্তার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করা হয়েছে। ওই সময় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ৬৪ জেলার পুলিশ সুপারকে (এসপি) মৌখিকভাবে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। জাতীয় সংসদের সদস্যদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রী-এমপিদের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী বলেছিলেন, বাড়তি নিরাপত্তার জন্য জাতীয় সংসদ থেকে লিখিত অনুমতি বা নির্দেশনার কোনো প্রয়োজন নেই। আইনের কোনো বিধিনিষেধও নেই। এটি সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ। আর নির্দেশ দেবে সরকার। এরমধ্যেই সরকারের উচ্চ মহল থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী বিভিন্ন জেলায় মন্ত্রী-এমপিদের বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে। এর আগে যারা ঝুঁকি মনে করেছেন, সরকার তাদের জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু আমি বলেছি সবাইকে দিতে হবে। সে অনুপাতে এখন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এজন্য লিখিত নির্দেশের দরকার নেই।’ (সূত্র : প্রতিদিনের সংবাদ, তারিখ : ৮ জানুয়ারি ২০১৭)।

কিন্তু দেশের নাগরিক বা দেশের এমপি-মন্ত্রীসহ উচ্চ পদস্ত কর্মকর্তাদের কতটুকু নিরাপত্তা দেবে বিদেশের সরকার? আর বন্ধু রাষ্ট্র ভারতে বাংলাদেশ নাগরিক কিংবা এমপিরাও নিরাপদ নয়। যেখানে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় এবং দেশীয় সীমানায় প্রবেশ করে প্রকাশ্যে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা হয়ে থাকে, সেখানে ভারতের মধ্যে এমন দুর্ঘটনা হওয়াটাই স্বাভাবিক। তর্কের খাতিরে অনেক কিছুই বলা যায়, এখন বিদেশি নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি এখন আলোচনাই মুখ্য। এতো বড় একটি রসহ্যজনক খুন, সেখানে ভারতীয় নাগরিকদের কি সম্পৃক্ত ছিল না, অথবা এতো বড় ঘটনার দায় কি ভারত সরকার এড়াতে পারে? ভাবুন তো আজকে যদি ভারতীয় কোনো এমপি অথবা নাগরিক আমাদের বাংলাদেশের কোনো জায়গায় এ রকমের খুনের শিকার হতো, তাহলে বাংলাদেশ কি-এর দায় এড়াতে পারত অথবা ভারত সরকার কি বাংলাদেশ সরকারকে দায় দিত না?

পরিশেষে- বলতে চাই, ভারত আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র, সে হিসেবে বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে তারা সহানুভূতি এবং সহনশীল হয়ে কাজ করবেন এবং ভালো কাজের সহযোগিতা করবেন। ঠিক এমপি আনান হত্যার বিষয়ও ভারত-বাংলাদেশকে সহযোগিতা করবেন। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যদি ভারতের কোনো নাগরিক সম্পৃক্ত থাকে, সেটাও উদ্ঘাটন করে বিচারের আওতায় আনবে- এমনটাই প্রত্যাশা করছি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত