নতুন কারিকুলামে মূল্যায়ন পদ্ধতি

শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে আগে সম্যক ধারণা থাকতে হবে

প্রকাশ : ২৬ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

নতুন কারিকুলামে মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে গেল দুই বছর ধরে চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। নম্বর ও গ্রেডিং পদ্ধতি বাতিল করে প্রথমে ‘ত্রিভুজ’, ‘বৃত্ত’ ও ‘চতুর্ভুজ’ ইনডিকেটর ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন শুরু হয়। এ নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে তা থেকে পিছু হটে কর্তৃপক্ষ। মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার ঘোষণা দেন শিক্ষামন্ত্রী। গঠন করেন উচ্চপর্যায়ের কমিটিও। সেই কমিটির মতামতের ভিত্তিতে এবার সাতটি স্কেল বা পর্যায়ে মূল্যায়ন করার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি এবং এসএসসি-এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষায় মূল্যায়নে একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে। চলতি মাসের ৩১ তারিখের মধ্যেই এ পদ্ধতির চূড়ান্ত ঘোষণা আসতে পারে। এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, নতুন যে পদ্ধতি চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ, তাতে বিষয়ভিত্তিক পারফরম্যান্স ইনডিকেটর দেওয়া হবে। প্রত্যেক বিষয় মূল্যায়নে সাতটি পর্যায় বা স্কেল থাকবে। মূল্যায়নের পর্যায়গুলো হবে অনন্য, অর্জনমুখী, অগ্রগামী, সক্রিয়, অনুসন্ধানী, বিকাশমান ও প্রারম্ভিক। সবচেয়ে যে ভালো করবে সে ‘অনন্য’ পাবে। এভাবে অন্য পর্যায়গুলো দিয়েও মূল্যায়ন করা হবে। তবে সব বিষয়ের স্কেল মিলিয়ে তা সমন্বিতভাবে প্রকাশ করা হবে না। আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি এবং ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার জানিয়েছেন, নতুন কারিকুলামে এসএসসি, এইচএসসিতে জিপিএ বা অন্য কোনো গ্রেডিং থাকছে না। মূল্যায়নে বিষয়ভিত্তিক পারফরম্যান্স অর্জনে জোর দেওয়া হয়েছে। সেখানে সাতটি পর্যায় বা স্কেল থাকতে পারে। তিনি বলেন, মূলত আমরা বিষয়ভিত্তিক পারফরম্যান্স ইনডিকেটর দেব। তবে শিক্ষার্থীরা একাডেমিক রিপোর্ট কার্ড পাবে। মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত হলে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়নের জন্য নৈপুণ্য অ্যাপ প্রস্তুত করা হবে। এনসিটিবির সদস্য (কারিকুলাম) অধ্যাপক ড. মো. মশিউজ্জামান বলেন, এসএসসি-এইচএসসিতে সাতটি স্কেলে বিষয়ভিত্তিক মূল্যায়ন করা হবে। সরকারের লক্ষ্য সব প্রতিষ্ঠান সমপর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। কেউ ভালো করল, কেউ খারাপ করল তা আর থাকবে না। আমরা চাই, সব শিক্ষার্থী উল্লাস করুক। এ মূল্যায়ন পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে পরবর্তী শ্রেণিতে ভর্তি প্রক্রিয়াসহ সব কিছুতেই পরিবর্তন আনা হবে। এদিকে, নতুন কারিকুলামের রূপরেখায় সামষ্টিক মূল্যায়ন বা লিখিত অংশে ৬৫ নম্বর এবং শিখনকালীন মূল্যায়ন বা শ্রেণি কার্যক্রমে ৩৫ নম্বর রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। শ্রেণি কার্যক্রম বলতে বোঝানো হয়েছে অ্যাসাইনমেন্ট, উপস্থাপন, অনুসন্ধান, প্রদর্শন, সমস্যার সমাধান, পরিকল্পনা প্রণয়নের মতো কাজ। এ ছাড়া আগে এসএসসি-এইচএসসিতে তিন ঘণ্টার পরীক্ষা হলেও নতুন কারিকুলামে প্রতিটি বিষয়ের মূল্যায়ন হবে ৫ ঘণ্টায়। পাবলিক পরীক্ষায় মোট ১০টি বিষয়ের ওপর শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে। জানা যায়, গত বছর দেশে নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হয়। বর্তমানে প্রাথমিকে প্রথম থেকে তৃতীয় এবং ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে অধ্যয়ন করছে শিক্ষার্থীরা। আগামী বছর চতুর্থ ও পঞ্চম এবং দশম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হবে। ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতেও নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হবে। গত বছর প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন করা হয়। চলতি বছর বাস্তবায়ন করা হচ্ছে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে। ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে, ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে এ শিক্ষাক্রম চালু হবে। দেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে নতুন কারিকুলাম নিয়ে যে আলাপ-আলোচনা বর্তমানে হচ্ছে, সেটা শুনে মনে হচ্ছে কোনো শিক্ষাবিদ কিংবা বিশেষজ্ঞ নতুন কারিকুলাম নিয়ে তেমন কিছু বোঝে না বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তারা নিজেরাই এ নিয়ে পরিষ্কার কোনো ধারণ দিতে পারছেন না। সবচেয়ে আশঙ্কার কথা হচ্ছে, নতুন কারিকুলাম নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যেও একটা ধোঁয়াশা বিরাজ করছে। লেখাপড়া কম জানা অভিভাবকরা মার্কিং পদ্ধতি কী, তা বুঝেন না। তারা বুঝেন তার সন্তান পাস করেছে কি না এবং সেটা কোন ডিভিশন। আমাদের এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষায় যে গ্রেডিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, সেটাও বা কয়জনে জানে। ঠিক এমনি অবস্থ্ায় স্কুলে যে পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, সেটি কতটা ফলপ্রসূ হবে, সেটা নিয়ে চলছে নানা মুখরোচক আলোচনা। স্কুলের বাচ্চারা নুডুলস রান্না করে স্কুলে নিয়ে যায়। শিক্ষক ও সহপাঠীদের নিয়ে খায়। মজা পায়, উল্লাস প্রকাশ করে। আবার কোনো কোনো শিক্ষার্থী বিভিন্ন জীব জানোয়ারের ছবি অংকন করে নম্নর পায়। আসলে নতুন কারিকুলামে মূল্যায়ন পদ্ধতির ওপর শিক্ষার্থী অভিভাবক, শিক্ষক ও পাঠক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আগে আলাপ-আলোচনা করে নিলে বিষয়টা বোধগম্য হতো। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর কেন যেন মনে নিজেরাই সমস্যা সৃষ্টি করে পরবর্তীতে সেটি নিরসনের জন্য চেষ্টা চালায়। আগে-পিছে কোনো কিছু না ভেবে একটা পদ্ধতি চালু করে দিয়ে সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে নিয়ে আসার তো কোনো মানে হয় না। আগে থেকে ভেবে-চিন্তে পরে সেটি বাস্তবিক অর্থে ফলপ্রসূ হলে সেটা গ্রহণ করতে কোনো আপত্তি নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে আগে সম্যক্ষ ধারণা গ্রহণ করতে হবে। তারপর সেটি অংশজনদের মতামত নিতে হবে। তার পরই সেটি শিক্ষার্থীদের ওপর প্রয়োগ করতে হবে। অন্যথায় সেটি কার্যকর হবে না।