ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ও জনমনের প্রতিক্রিয়া

আসহাবে কাহাফ
কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ও জনমনের প্রতিক্রিয়া

পৃথিবীর পরিধি কত? আপনার যদি কখনো জানার ইচ্ছা না হয়ে থাকে, তবে আজকেই সে ইচ্ছা জাগতে পারে। আপনার এমন ইচ্ছাকে স্বাগত জানিয়েই আমি লিখছি, সমসাময়িক কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নিয়ে। প্রতিদিনই পৃথিবীতে কত কত ঘটনা ঘটছে, তার একটা হিসাব আমাদের জানা উচিত না হলেও আমাদের আশপাশে কী ঘটনা ঘটছে, সেই হিসাব জানা অতি জরুরি! অন্যথায়, পৃথিবীতে বেঁচে থাকা আর মৃত মানুষ হয়ে কবরে শুয়ে থাকার কোনো পার্থক্য দেখি না। একটি জাতীয় দৈনিকের ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রতি সেকেন্ডে চারজন শিশু জন্মগ্রহণ করে। বিবিসি বাংলার ২০১৭ সালের একটি প্রতিবেদনের সূত্র অনুযায়ী, আমাদের এ পৃথিবীতে প্রতি সেকেন্ডে দুইজন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। আরো একটু স্পষ্ট করে বললে, বলতে হয়, প্রতি দেড় সেকেন্ডে একজন মানুষ হৃদরোগে, প্রতি ২৪ সেকেন্ড একজন মানুষ গাড়ি দুর্ঘটনায় এবং প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করে মৃত্যুবরণ করে। এ যে, সেকেন্ডে সেকেন্ডে মানুষের মৃত্যুর মতো, প্রতি সেকেন্ডে ঘটে যাওয়া ঘটনার অভাব নেই। এ যে ঘটনা ঘটবে বা হবে, এমন যেসব ঘটনার জন্য আমরা প্রস্তুত থাকি, সেটির নাম স্বাভাবিক ঘটনা। আর, যেসব ঘটনা হঠাৎ করে ঘটে যায়, তা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা; কিন্তু যা কখনো ঘটার নয়, কাল্পনিকতা ও কল্পনার বাইরে এবং আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ঘটলেও আমরা ওয়াকিবহাল নয়, এমন ঘটাকেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চালিয়ে দিই, দিচ্ছি! আসলে, বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলতেই কিছু নেই। এসব, বিচ্ছিন্ন ঘটনা মূলত মানবসৃষ্ট এবং হীন কাজ! আর, পৃথিবীর সকল হীন কাজকে, আমি ব্যক্তিগতভাবে অপরাধের শামিল এবং বিচারযোগ্য বলে মনে করি। সাম্প্রতিক কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ও প্রতিক্রিয়া লিখেই শেষ করব।

এক.

বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দল, ইউএস ক্রিকেট দলের সঙ্গে পরপর দুটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে হেরেছে! ক্রিকেট খেলায় এ হার-জিত অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু, হারের পর, আমাদের ক্রিকেটারদের নামে, কয়েকটি বক্তব্য ভাইরাল হয়েছে। অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তর নামে যে বক্তব্যটি ভাইরাল হল, তা হুবুহু এরকম, ‘আমেরিকার টিমে ছয়টা দেশ থেকে আসা প্লেয়াররা খেলেন। তারা যখন খেলে ছয় দেশের মানুষই তাদের জন্য দোয়া করেন। স্বাভাবিকভাবেই, তারা আমাদের থেকে বেশি দোয়া পায়।’

যদিও সত্য ঘটনা এই, নাজমুল হোসেন শান্ত এ ধরনের কোনো বক্তব্য কোথাও রাখেননি। পাশাপাশি ক্রিকেটার তানজিম সাকিবের একটি বক্তব্যও ভাইরাল হয়েছে। সে বক্তব্যটি হলো, ‘দেশ ছাড়ার আগে আমরা সবার কাছে দোয়া চেয়েছিলাম, আপনারা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন, আপনারা সবাই দোয়া করেছেন? শুধু ম্যাচ হারলেই ক্রিকেটারদের দোষারোপ করেন, এটা ত ঠিক না!’ যদিও এটিও একটা রিউমার। কথা হলো, এসব বক্তব্য রিউমার কিংবা মিথ্যাচার হলেও, আমাদের ক্রিকেটে যে, কোথাও কোথাও অনিয়ম হচ্ছে, হতাশার জায়গা আছে, অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে, সেই বিষয়টা নিয়ে, মাঝেমধ্যে দুয়েকজন খেলোয়াড় রাখ-ডাক করলেও, যাদের করা উচিত, তারা কেউ করছে না। আমাদের ক্রিকেট বোর্ড যে ভেঙে সাজানোর সময় এসেছে, বর্তমানে দায়িত্বপ্রাপ্ত আযোগ্যদের যে স্ব-সস্মানে অব্যহতি নেওয়ার বা দেওয়ার সময় এসেছে, এটি কেউ বুঝছে না। তাই, দিনশেষে আমরা বলতেই পারি, টি-টোয়েন্টি সূচকের ৯ নম্বর দল হয়ে ১৯ নম্বর দলের কাছে সিরিজ হার কিংবা ১০০টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ হার আমাদের জন্য বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভিন্ন অন্য কিছু নয়।

দুই.

অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস ম্যান নামক ২০২১ সালে প্রচারিত আল জাজিরার এ প্রতিবেদনটি আমরা কমবেশি সবাই দেখেছি। দেশে-বিদেশে প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে অনেকেই অনেক মন্তব্য ও যুক্তিতর্কও করেছি। কিন্তু, আমাদের একটা নিরপেক্ষতার জায়গা দরকার; কথা বলার জন্য, যুক্তিতর্ক দিয়ে বিবেচনা করার জন্য, সে জায়গা আমরা কেউ সৃষ্টি করতে চাই না, সে জায়গায় কেউ দাঁড়াতে চাই না। ফলে এদেশে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে একই অপরাধ ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি, দল ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ফিরে আসে। সে প্রতিবেদনের সত্যতা নিয়ে এখন এখানে কথা বলা প্রাসঙ্গিক মনে করছি না। বরং জেনারেল আজিজকে বর্তমানে কেন আমেরিকা ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, এর ভিত্তি উৎস ও সত্যতা নিয়ে কথা বলাটা জরুরি। কেন না, আমেরিকা যে আইনে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সে আইনের ধারা নং ৭০৩১(সি)! চলুন দেখি, সেখানেই কী আছে, Section 7031(c) provides that, in cases where the Secretary of State has credible information that foreign officials have been involved in significant corruption or a gross violation of human rights, those individuals and their immediate family members are ineligible for entry into the United States. যেহেতু, আল-জাজিরার সেই প্রতিবেদন জেনারেল আজিজ সেনাপ্রধান থাকায় প্রকাশিত হয়েছে, ধরে নিলাম, সেটি জেনারেল আজিজ এবং সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ছিল; কিন্তু এবং তারও ৩ বছর পরে এসে, আমেরিকার থেকে জেনারেল আজিজের ওপর দুর্নীতির একটি অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের উচিত সঠিক তথ্য অনুসন্ধান, যাচাই-বাছাই এবং কূটনৈতিক যোগাযোগেরমাধ্যমে এ অভিযোগের তথ্য ও সত্যতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি, ব্যক্তি জেনারেল আজিজ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মতো প্রতিষ্ঠানকে কলঙ্ক মুক্ত করা। শুধু জেনারেল আজিজের নয়, সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদের দুর্নীতি নিয়েও বেশকিছু প্রতিবেদন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এসেছে। সেগুলোর ফিরিস্তি লিখতে গেলে লেখা অনেক বড় হবে, তাই মূল কথাটি সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। এসব ঘটনার সুষ্ঠু বিচার না করলে, এসব প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হব। তখন, এদের কাছেই নতজানু হয়ে পথ ছেড়ে দেওয়া ছাড়া সরকার ও রাষ্ট্রের আর কোনো উপায় থাকবে না। এ ব্যাপারে সরকারি দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ একটা মন্তব্য কোটেশন করে দিচ্ছি। ‘বেনজীর আহমেদ পুলিশ প্রধানের পদ থেকে অবসর নেওয়ার অনেক পর গণমাধ্যমে তার দুর্নীতির খবর এসেছে। তিনি পুলিশ প্রধান হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় কোনো সংবাদমাধ্যমে এসব খবর আসেনি। কর্মরত অবস্থায় দুর্নীতির অভিযোগ যদি উঠত, তখন নিশ্চয়ই সরকার ব্যবস্থা নিত।’ কিন্তু হানিফ সাহেব হয়তো, এটি মনে করতে পারিছেন না, ২০২১ সালে পুলিশের এই সাবেক আইজিপিকে দুর্নীতির দায়ে আমেরিকা ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। আমাদের সরকার ও রাষ্ট্রের মনে রাখা উচিত, যতই এসব ঘটনাকে স্বীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য পাশ কাটিয়ে যাব, ততই এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা বেড়ে যাবে।

তিন.

গত ২৫ মে তারিখে কবি সোহরাব হাসানের একটি কলাম পড়েছি- বাংলাদেশের এমপি কেন কলকাতায় খুন হন? এরইমধ্যে আমরাও সবাই জেনেছি, বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্য, ঝিনাইদহ-৪ আসনের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও আইনপ্রণেতাকে গত ১৩ মে কলকাতার নিউ টাউনের একটি ফ্ল্যাটে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। সোহরাব হাসান সেই কলামে ব্যক্তি আনোয়ারুল আজিম সম্পর্কে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন, একই সঙ্গে রাষ্ট্র ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডের একটা দুর্বলতা ও নেতিবাচক দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। আমি সেদিকে যাচ্ছি না, আমি সোহরাব হাসানের সে কলামের তথ্য-উপাত্তগুলো পড়ে ইন্টারনেটে আরেকটু খবর নিয়ে দেখলাম, এই আনোয়ারুল আজিমরা সুবিধাবাদী, কালোবাজারি এবং একই সঙ্গে জনবান্ধব।

কথা হচ্ছে, একটা দল পরিবর্তনকারী সুবিধাবাদী এবং ইন্টারপোলের লাল-তালিকাভুক্ত ব্যক্তি কীভাবে আওয়ামী লীগে প্রবেশ করে? আর আওয়ামী লীগ তথা সরকারও কোনো বিবেচনায় একটি ব্যক্তির ১৫টির বেশি অভিযোগ খালাস করে, তাকে সংসদে জায়গা দিতে পারে? দেশের বাইরে কোনো সংসদ সদস্য খুন হওয়ার ঘটনা যেহেতু এ প্রথম সেহেতু এটিকেও ধরে নিলাম বিচ্ছিন্ন ঘটনা; কিন্তু এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে যেসব দুর্বলতা দেখিয়ে দিচ্ছে, যেসব হীন অপরাধ, চোরাচালান, অবৈধ যোগাযোগ, অবৈধ লেনদেন ও সম্পদের সন্ধান দিয়ে যাচ্ছে, এসব কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা হতে পারে না।

একজন ব্যক্তি সংসদ সদস্য হলেই যে আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়ে যাচ্ছে, এসব কী দেশের সরকার, রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রতিষ্ঠানের চোখে পড়ে না? যদি চোখে পড়ে তাদের কাজ কী? যেহেতু এটি হত্যাকাণ্ড এর সুষ্ঠু বিচার হওয়ার দরকার, পাশাপাশি এ হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আমাদের যেসব দুর্বলতা উঠে এসেছে, সেসব বিষয়েও সরকার ও দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের নজরদারি বাড়ানোর এখনই উপযুক্ত সময়। এখানে, একটা কথা না বলে পারছি না, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যারিস্টার সুমন সংসদ সদস্য হিসেবে নিজের প্রাপ্ত বেতন-ভাতা ও এলাকার জন্য প্রাপ্ত বরাদ্দ ঘোষণা করেছেন বিধায়, আমাদের অনেক সংসদ সদস্যের গাত্রদাহ শুরু হয়েছে।

আমি মনে করি, এটির জন্য আইন হওয়া উচিত, প্রতিটি এলাকায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অর্থ-বিত্তের একটি হিসাব ও এলাকার জন্য প্রাপ্ত বরাদ্দের হিসাব ব্যানার করে টাঙ্গিয়ে রাখার। আপনি এতক্ষণ যে ফিরিস্তি গাইলাম, যারা এসব বুঝতে পারবে না, তাদের জন্য পৃথিবীর পরিধি সাড়ে তিন হাত; আর যারা বুঝতে পারবে তাদের জন্য নিরক্ষরেখা অনুযায়ী পৃথিবীর পরিধি ৪০০৭৫ দশমিক ১৭ কিলোমিটার। সুতরাং, আর কথা বাড়াতে চাই না, শুধু এতটুকু দেখতে চাই; সরকার এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা কীভাবে মোকাবিলা করে।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত