জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) জন্য ২৬১টি নতুন গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৮১ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি গাড়ির জন্য খরচ পড়বে ১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ায় এখন গাড়ির দাম আরো বাড়তে পারে। গাড়ি কেনার খবরটি দৃশ্যত তেমন একটা সুখকর নয়। দেশের প্রকৃত আর্থিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকার পুরোপুরি অবহিত রয়েছে কি না, সেটা হয়তো জানা যাচ্ছে না। তবে জনগণ যে আর্থিক সংকটে আছে, সেটা সরকারকে বুঝতে হবে। জনগণের করের টাকায় ডিসি-ইউএনওদের স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করার সুযোগ দেয়াটি সত্যিকার অর্থে অবশম্ভাবী হয়ে পড়েছে কি না, সেই প্রশ্নটি আসতে পারে। গাড়ি কেনার পক্ষে যেসব যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে- তার মধ্যে রয়েছে : ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নির্বাচনি দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের নিরবচ্ছিন্ন চলাচল নিশ্চিত করার স্বার্থে এসব গাড়ি প্রয়োজন। মাঠপর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের গাড়ির প্রয়োজন রয়েছে, এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। মাঠপর্যায়ে সরকারি গাড়ির ব্যবহার কীভাবে করা হয়, সেটি একটু খেয়াল করলে অনুধাবন করা যাবে। দেশের আর্থিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে সিদ্ধান্তটি সুবিধাজনক সময়ে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে কি না, সেটাও ভাবা যেতে পারে। কেন না, নানা আর্থিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। এ অবস্থায় গাড়ি বা এর যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হলে বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারের ওপর আরো চাপ পড়বে। ১৩ বছরের বেশি বয়সি গাড়ি পাল্টানোর কথা বলা হচ্ছে। তবে সব ডিসি ও ইউএনওর গাড়ির বয়স নিশ্চয়ই ১৩ বছর হয়নি।
সে ক্ষেত্রে সরকার পর্যায়ক্রমে গাড়ি কিনতে পারত। আবার বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্পের গাড়ি- প্রকল্প শেষ হওয়ার পর অলস বসে আছে। ডিসি এবং ইউএনওদের জন্য সেগুলোও ব্যবহার করা যেতে পারে। অর্থের অভাবে যেখানে অনেক বিদেশি কোম্পানির পাওনা পরিশোধ করা যাচ্ছে না, সেখানে একযোগে ২৬১টি গাড়ি কেনার যৌক্তিকতা আছে কি না, তা একবার ভেবে দেখা দরকার। সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের জন্য দামি গাড়ি কেনার সিদ্ধান্তকে অর্থের অপচয় বলে অভিহিত করেছেন দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, বর্তমানে আশঙ্কাজনকভাবে ঋণনির্ভরতা বাড়ছে। দেশে রিজার্ভের পরিমাণ যেভাবে কমে যাচ্ছে, তা শঙ্কার কারণ হতে পারে। মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, অনিয়ন্ত্রিত দ্রব্যমূল্য, বৈদেশিক ঋণের চাপ, আর্থিক খাতে অনিয়ম, প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধিসহ নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে ঘোষিত হচ্ছে আসন্ন বাজেট। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের কষ্ট হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান আয় বৈষম্য সমাজে নীরব অসন্তোষ তৈরি করছে। রিজার্ভের ঘাটতির ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে। আমদানি ব্যয় বেড়েছে। দেশে বর্তমানে মোট অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকা। ক্রমান্বয়ে আমাদের কঠিন শর্তের ঋণ বাড়ছে। আমরা যে টাকাটা ঋণ হিসাবে নিচ্ছি তা সঠিকভাবে ব্যয় হচ্ছে কি না, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
বাংলাদেশে কর আহরণের পরিমাণ বিশ্বের সর্বনিম্ন। দেশের মানুষের মধ্যে কর না দেওয়ার মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। বছরে কোটি টাকা আয় করেন, এরকম মানুষের মধ্যে ৬৭ শতাংশ কর প্রদান করে না। নেপাল, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার চেয়েও কম আয়কর দেন আমাদের দেশের মানুষ। এমনকি কেনিয়া ও সিয়েরা লিয়নের মানুষ আমাদের চেয়েও বেশি আয়কর দেন। আমাদের মতো দেশে বাজেট বাস্তবায়নের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দুর্নীতি। বাজেট বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে কর আহরণে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। কর আহরণ প্রক্রিয়ায় সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে। শুধু রাজস্ব আদায় করেই অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না। আর্থিক খাতে বর্তমানে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তা বন্ধ করতে হবে। ঋণ জালিয়াতকারী, ঋণখেলাপি, অর্থপাচারকারীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। অর্থপাচারের মতো ক্যান্সারের চিকিৎসা উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার এখন জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংক আরোপিত সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করলে আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা যাবে না। তাহলে ধীরে ধীরে মানুষ ব্যাংকিং খাতের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলবে। ব্যাংকে নিরাপদে আমানত রাখার নিশ্চয়তা না থাকলে অর্থপাচার বাড়বে। তাই রাজস্ব আয়ের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ আয় বাড়ালেও আর্থিক খাতে সুশাসন ও জবাবদিহিতা না থাকলে অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না। এই অবস্থায় ডিসি এবং ইউএনওদের জন্য এতোগুলো দামি গাড়ি কেনার যৌক্তিকতা রয়েছে কি না, সেটা নিয়ে একটু ভাবার সময় হয়েছে।