ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাঁশচালের পুষ্টিগুণ নিয়ে ভাবতে হবে

প্রদীপ সাহা
বাঁশচালের পুষ্টিগুণ নিয়ে ভাবতে হবে

ঘাসের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রজাতি হলো বাঁশ। সবসময় বাঁশে ফুলের দেখা না মিললেও প্রকৃতপক্ষে জীবনচক্রের প্রায় শেষদিকে কিছু কিছু প্রজাতির গাছে ফুলের মঞ্জরি দেখা যায়। মঞ্জরি বৃদ্ধি পেতে পেতে একসময় কুঁড়ি আসে এবং পূর্ণাঙ্গ ফুলে পরিণত হয়। কিছু প্রজাতির বাঁশ জীবনচক্রে দুই-তিনবার ফুল দেয়। তবে অধিকাংশ প্রজাতির বাঁশ একবার ফুল দিয়েই মারা যায়। প্রজাতি ভেদে বাঁশ গাছে ফুল আসতে সময় লাগে প্রায় ২০ থেকে ১৩০ বছর পর্যন্ত। কিছু কিছু উদ্ভিদে ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যেই ফুল দেখতে পাওয়া যায়। বাঁশফুলে বীজ সৃষ্টির পর তা দেখতে হয় অনেকটা ধানের বীজের মতো। আমাদের উপমহাদেশীয় অঞ্চলে অনেকেই একে বাঁশের চাল বলে আখ্যায়িত করে। এই শস্যদানা অনেকে পুষ্টিসম্পন্ন মনে করে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। এই বাঁশের বীজে অনেক পুষ্টিগুণ বিদ্যমান থাকে। রান্নার পর এটি দেখতে অন্যান্য চালের মতো এবং সুস্বাদু হয়। বাঁশের চালে গম ও অন্যান্য চালের চেয়ে অধিক পরিমাণে প্রোটিন থাকে, যা শরীরের বিভিন্ন স্থানের ব্যাথা দূর করতে সাহায্য করে। এই চাল কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দেয় এবং ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অনেক উপকারী। সাধারণ চালের চেয়ে বাঁশের চালে প্রোটিনের মাত্রা বেশি এবং ফ্যাট কম থাকে। তাছাড়া অ্যামাইলোজ স্টার্চের পরিমাণ ভালো থাকায় এটি মানবদেহের জন্য উপকারী।

সম্প্রতি (২০ এপ্রিল ২০২৪) দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর পাকাপান গ্রামে বেড়ুয়া বাঁশের (কাঁটাযুক্ত বাঁশ) ফুলের দানা থেকে চাল আবিষ্কার করে এলাকায় আলোড়ন তুলেছেন কৃষি শ্রমিক সাঞ্জু রায় (২৪)। তার বাঁশঝাড়ে ফুল ফুটেছে, ফুল ঝরে পড়ার পর সেই বাঁশ গাছে বীজ হয়েছে এবং সেই বীজ সংগ্রহ করে তা থেকে চাল উৎপাদন করেছেন। সাঞ্জু রায় বাঁশগাছ থেকে ঝরেপড়া ফুল থেকে পাওয়া যব আকৃতির দানাগুলো পানিতে ধুয়ে শুকিয়ে চাল আকৃতির দানা বের করেছেন। দানাগুলো চালের মতো হওয়ায় সেটি গ্রামবাসীর কাছে বাঁশের চাল হিসেবেই পরিচিতি লাভ করেছে। এই চাল গ্রামের অনেকেই কিনে নিয়ে ভাত, খিচুরি ও আটার রুটি হিসেবে খাচ্ছেন। সাঞ্জুর জন্য গ্রামের নাম এখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রামের এক বিত্তবান মানুষের বাড়িতে কাজ করেন সাঞ্জু। প্রায় দুই বিঘা জমিজুড়ে পড়ে থাকা বাঁশঝাড় থেকে তিনি বীজ সংগ্রহ করেছেন। তিনি বলেন, ‘কৃষিশ্রমিকের কাজ করাকালীন কালী রায় (৬৫) আমাকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাঁশের ফুলের দানা থেকে চাল বের করার বিষয়টি জানান। তার সেই গল্প থেকেই আমার আগ্রহ জন্মায় বাঁশফুলের দানা থেকে চাল সংগ্রহের।’ তিনি বাঁশঝাড় থেকে দশ মণ বীজ সংগ্রহ করেছেন। বীজ ভাঙ্গিয়ে চাল তৈরি করে তা তিনি নিজের জন্য রেখেছেন এবং প্রতিবেশীদের কাছে বিক্রি করেছেন। কিছু চাল তিনি বাঁশঝাড়ের মালিককে উপহার দেওয়ার পাশাপাশি গবেষণার জন্যও দিয়েছেন। নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার আঞ্চলিক বাঁশ গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (আরবিআরটিসি) রিসার্চ অফিসার মো. আসাদুজ্জামান সরকার বলেন, ‘বাঁশের জীবনকাল নির্ভর করছে তার প্রজাতির ওপর। একটি বাঁশগাছে অন্তত ৪০ বছর থেকে শুরু করে ১২০ বছর বয়সেও ফুল ফুটতে পারে। প্রজাতিভেদে এটা ভিন্ন হয়। একটি বাঁশগাছ তখনই ফুল দেয়, যখন সেই গাছের উৎপাদন সক্ষমতা শেষ হয়ে যায়।’ বাংলাদেশ বন গবেষণা ইন্সটিটিউটের চট্টগ্রামের বিভাগীয় কর্মকর্তা ড. মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমরা গবেষণায় দেখেছি, কোনো কোনো বাঁশগাছে ২৫ বছর পরও ফুল ফোটে; তারপর সেটি মারা যায়। এটি আসলে প্রজাতিভেদের ওপর নির্ভর করে। বাঁশফুল আসা মানে হলো, ওই বাঁশের জীবনচক্র শেষ এবং সেটি মারা যাবে। অর্থাৎ বাঁশঝাড়ের যেগুলোতে এ বছর ফুল আসছে, সেগুলো এ বছরই শুকিয়ে মারা যাবে; যেগুলোতে ফুল আসেনি, সেগুলোতে পরের দুই-তিন বছর আসবে। এভাবে একটা সময় সব বাঁশ শুকিয়ে মারা যাবে এবং কয়েক বছর পর ওই বাঁশঝাড় সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে বাঁশঝাড় যাতে নিশ্চিহ্ন না হয়, সেজন্য সব বীজ চালে রূপান্তরিত না করে সেগুলো সংগ্রহ করা প্রয়োজন।’ সাধারণত বাঁশগাছে ফুল এলে তার ফিজিওলজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন গাছটি আর খাবার তৈরি করতে পারে না। বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৭ প্রজাতির বাঁশ আছে এবং সারা বিশ্বে এই সংখ্যা ১ হাজার ৫ শ’রও বেশি। শুধুমাত্র চীনেই আছে প্রায় নয় শ’ প্রজাতি। বাংলাদেশে যেসব প্রজাতির বাঁশ আছে, তার ২৫-২৬টি প্রজাতিই হলো গ্রামীণ বাঁশ। বাকিগুলো হলো বুনো প্রজাতির। কিন্তু পৃথিবীর সব বাঁশ জীবনচক্রের একটি পর্যায়ে গিয়ে এভাবে ফুল ফুটে মারা যায় না। কোনো কোনো বাঁশ আছে, যাতে কখনওই ফুল আসে না। সেগুলো রোগাক্রান্ত হয়ে বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় মারা যায়। মূলত বাঁশ কোনো গাছ নয়। এটি এক ধরনের ঘাস এবং চিরসবুজ বহু বর্ষজীবী উদ্ভিদ, যা নাতিশীতোষ্ণ ও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে জন্মায়। বন কর্মকর্তাদের মতে, ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও বাঁশ টিকে থাকে। ধান কিংবা গমও ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ, কিন্তু বাঁশের আয়ুষ্কাল অনেক। বাঁশ বড় হতে হতে একসময় এত বিশাল হয় যে, সেটি গাছের আকার ধারণ করে। কিন্তু ধান ও গম জাতীয় উদ্ভিদ আকারে কখনওই এত বড় হয় না। সব বাঁশের বীজের আকার একরকম নয়। বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে মুলি বাঁশের বীজের সাইজ একেক রকম। কিছু আছে সরিষার দানার মতো, কিছু পেঁয়াজের মতো, আবার কিছু গমের মতো। বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসীদের কাছে বাঁশের সবজি খুব প্রিয় এক খাবার। মুলি বাঁশের বীজ আদিবাসী বা পাহাড়ি মানুষ সংগ্রহ করে খায়। আর সবজি হিসেবে ‘কোড়ল’ তাদের খুব প্রিয় খাবার। ধান গাছ থেকে আমরা সাধারণত তিনমাস পর ধান পাই। কিন্তু একটি বাঁশের জীবনকাল প্রায় ৪৫ বছর। এছাড়া ধানের পুষ্টি আর বাঁশচালের পুষ্টিগুণ নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। তবে জেনেটিক পরিবর্তন করে বাঁশগাছের জীবনকাল কমিয়ে আনা যেতে পারে। এরকম চাল ভারতের কেরালা, তামিলনাড়ু এবং আসামে বাণিজ্যিকভাবে উৎপন্ন হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত