ক্ষতবিক্ষত সুন্দরবনকে বাঁচান

ঠিক অবস্থানে আসতে লাগবে ৪০ বছর

প্রকাশ : ৩০ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসলে প্রথমেই সুন্দরবনের বিষয়টি আমাদের সামনে চলে আসে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা করার জন্য সুন্দরবনের কি ভূমিকা তা বোধগম্য হতে হয়তো আরো অনেক সময়ের প্রয়োজন হবে। তবে যেভাবেই হোক, সুন্দরবনকে বাঁচাতে হবে। সুন্দরবন রক্ষায় আমাদের দেশের একটি সামাজিক সংগঠন বহুদিন থেকে অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে। প্রকৃতির প্রতিরোধক হিসেবে সুন্দরবেনের গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে অনেকে নানা রকম সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। মানুষের যানমালের ওপর রিমালের আঘাত কতটা ভয়াবহ হতো তা সহজেই বোঝা যেত, যদি সুন্দর বন না থাকত। রিমেলের পর এখন সুন্দরবনের গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের বোধোদয় হয়তো হচ্ছে। তবে রিমালের আঘাত প্রতিহত করতে গিয়ে সুন্দরবন যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেটা এর আগে ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে অনেক বেশি। রিমালের তাণ্ডব সুন্দরবননে যে বিপর্যয় ডেকে এনেছে, তা পূর্ববর্তী ঘূর্ণিঝড়গুলোর চেয়ে ভয়াবহ। এই ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সুন্দরবনকে অন্তত ৪০ বছর সময়ের প্রয়োজন হবে বলে মনে করা হচ্ছে। সে কারণে আগামী ৪০ বছর এই সবুজ রক্ষাকবজকে রক্ষা করার জন্য প্রাণিকুলের আশ্রয়স্থল সুন্দর বনের ওপর কোনো অত্যাচার না করার জন্য পরিবেশবাদীরা দাবি জানিয়ে আসছেন। সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বন। একইসঙ্গে বন, জলাভূমি, সামুদ্রিক ও উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের সমন্বয়ে গঠিত এমন প্রাকৃতিক বন পৃথিবীতে দেখা যায় না। বিশ্বের অন্যতম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল এটি। নিজের অবস্থা সংকটে ফেলে বারবার খুলনার উপকূলের মানুষকে রক্ষা করে যাচ্ছে। এবারও তার ব্যত্যয় হয়নি। মায়ের মমতায় আগলে রেখেছে। ফলে মানুষের প্রাণহানির ঘটনা তেমন ঘটেনি। ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ও আম্পানের আঘাতের চেয়ে এবার রিমালে বনের ক্ষতির পরিমাণ দুই-তিনগুণ বেশি। ১১ কিলোমিটার এলাকার গোলপাতা বন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জোয়ার-ভাটার চক্রে পুরো সুন্দরবন ৪৮ ঘণ্টা ৩ থেকে ৯ ফুট পানির নিচে ছিল। ফলে পশুপাখির বাসা, ডিম ও বাচ্চা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বনের ভেতরে জীববৈচিত্র্য যেমন- হরিণ, শুকর, গুইসাপ, সাপ ও বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। বনের পুকুরগুলো লবণাক্ত পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে।

বন বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, ২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে বনের ১২ হাজার ৩৫৮টি গাছ ভেঙে পড়েছিল। বন বিভাগের অবকাঠামোর ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা। ২০১৯ সালে বুলবুলের আঘাতে বনের ৪ হাজার ৫৮৯টি গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। অবকাঠামোর ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়ে ছিল ৬২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। রিমালের আঘাতে ক্ষতির পরিমাণ ছয় কোটি ছাড়িয়ে গেছে। বুলবুল ও আম্পানের চেয়ে রিমালের আঘাতে তিন গুণ বেশি গাছপালা, পশুপাখি, প্রাণী ও অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। এবারের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে অন্তত ৪০ বছর লাগবে বলে জানিয়েছেন বন কর্মকর্তা ও পরিবেশবিদরা। পশ্চিম সুন্দরবনের ১১ কিলোমিটার গোলপাতা ক্ষতিগ্রস্ত, অবকাঠামোগত ক্ষতি ২ কোটি ৬১ লাখ। ‘পশ্চিম সুন্দরবনের আওতায় খুলনা ও সাতক্ষীরায় অবকাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ ২ কোটি ৬১ লাখ টাকা। ‘সুন্দর বনজুড়ে পাখির হাজার হাজার বাসা ছিল। সেসব বাসায় ডিম ও বাচ্চা ছিল। সেই ক্ষতি পরিসংখ্যান দিয়ে নিরূপণ করা কঠিন। হরিণগুলোর মৃতদেহ গণনা করা গেলেও ভেসে যাওয়ার হিসাব মিলবে না। ঝড়ের সময় সুন্দরবনে ৪৮ ঘণ্টা ভাটা দেখা যায়নি। ৯ ফুট পানির নিচে ছিল বন। অথচ তিন ফুটের নিচের প্রাণীগুলো এত পানিতে টিকতে পারে না। তাদের অবস্থা নিরূপণ করা যাবে না। সাপ ভাসলেও পানিতে থাকারও নির্দিষ্ট সময় আছে। সেক্ষেত্রে মৃত্যু অনেকটা নিশ্চিত। ফলে এসব প্রাণীর ক্ষতি নিরূপণ করা একেবারেই অসম্ভব। জোয়ার-ভাটার সময়ের ব্যবধান ৪৮ ঘণ্টা ব্যাপী স্থায়ী হওয়ার ক্ষতির সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া সম্ভব নয়। কেন না, বাস্তবে ক্ষতির ব্যাপকতা অনেক বেশি। প্রাণী মৃত্যুও অন্যান্য ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে বেশি।’ কিন্তু বনের জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি অর্থ দিয়ে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। এই ক্ষতি সুন্দরবন নিজেই কাটিয়ে উঠতে পারবে। সেজন্য তাকে সময় দিতে হবে। বিরক্ত করা চলবে না।

‘সাধারণত জলোচ্ছ্বাস হলে বন্যপ্রাণীরা উঁচু স্থান ও গাছে আশ্রয় নেয়। রিমালের তাণ্ডবে বনের ভেতর অধিক উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। ফলে বনের উঁচু স্থান তলিয়ে যাওয়ায় প্রাণীরা আশ্রয় নিতে পারেনি। অধিক জলোচ্ছ্বাসের ফলে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে না পেরে হরিণগুলোর মৃত্যু হয়েছে। রিমালের আঘাতে অন্তত ৩ কোটি টাকার অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে। বন বিভাগের বিভিন্ন অফিস, টহল ফাঁড়ি এবং মিঠাপানির পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মৃত প্রাণীগুলো মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে। জীবিত উদ্ধার প্রাণীগুলোকে সেবা দিয়ে বনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, এটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। ‘বুলবুল, আম্পান, আইলা ও সিডর ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও রিমালের মতো এতটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা বড় একটা চ্যালেঞ্জ। ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বনকে নিজে থেকেই জাগার সুযোগ দিতে হবে। মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয় ও বনের ক্ষতি করা থেকে দূরে থাকতে হবে। প্রাণীর জন্য উঁচু কেল্লা তৈরি করতে হবে। যেন পানি বাড়লে আশ্রয় নিতে পারে। আপাতত ছোট পুকুরগুলোতে স্যালোমেশিন দিয়ে নোনা পানি বাইরে ফেলে দিতে হবে। মোট কথা সুন্দরবনকে রক্ষা করতে যা যা প্রয়োজন সবকিছুই করতে হবে। অন্যথায় আমাদের ভাগ্যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসবে।