আজ বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস

আসুন তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করি

মো. সাজেদুল ইসলাম

প্রকাশ : ৩১ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মানুষ, জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য তামাকজাত দ্রব্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এবং বিশ্বব্যাপী তামাক সেবন কমাতে কার্যকর নীতিমালার পক্ষে কথা বলার জন্য বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালিত হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এই বার্ষিক উদযাপন জনসাধারণকে তামাক ব্যবহারের বিপদ, তামাক কোম্পানির ব্যবসায়িক কলাকৌশল এবং বিশ্বজুড়ে তাদের স্বাস্থ্য ও সুস্থ জীবনযাপনের অধিকার দাবি করতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষার জন্য কী করতে পারে, সে সম্পর্কে অবহিত করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ১৯৮৮ সাল থেকে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। প্রতি বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য তামাক এবং এর শিল্প সম্পর্কিত একটি নির্দিষ্ট সমস্যাকে তুলে ধর। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে এবং তামাকের ব্যবহার যাতে কমতে থাকে, তা নিশ্চিত করতে এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ‘তামাক শিল্পের হস্তক্ষেপ থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করা’।

তামাকবিরোধী প্রচারণাকারীদের মতে, এ বছরের থিমটি তরুণদের প্রতি তামাক শিল্পের লক্ষ্যযুক্ত বিপণনের উদ্বেগজনক প্রবণতার দিকটি তুলে ধরছে। ব্যাপক সোশ্যাল মিডিয়া এবং স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের প্রচারণার মাধ্যমে তরুণরা ক্রমবর্ধমানভাবে তামাকজাত দ্রব্যের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে, যা তাদের স্বাস্থ্য এবং কল্যাণের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য হুমকি সৃষ্টি করছে।

তরুণদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা রয়ে গেছে এবং বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশে এটি বাড়ছে। তামাক ব্যবহার বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর একক সবচেয়ে প্রতিরোধযোগ্য কারণ এবং বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ১০ জনের মধ্যে ১ জন প্রাপ্তবয়স্ককে হত্যার জন্য দায়ী। বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ তামাক উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উৎপাদিত হয় এবং বাংলাদেশ সেই দেশগুলোর মধ্যে একটি। বিশ্বের মোট তামাকের মধ্যে ১.৩ শতাংশ তামাক উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার জনস্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য হুমকিস্বরূপ। তামাকের কারণে প্রতি বছর আমাদের দেশে মোট জিডিপির প্রায় ৩ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে।

তামাক চাষের জন্য বিপুল পরিমাণ কীটনাশক ও সারের প্রয়োজন হয়, যা ধীরে ধীরে জমির উর্বরতা কমিয়ে দেয়। ফলে তামাক চাষে ব্যবহৃত জমিতে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়। এছাড়া চুল্লির তাপে সবুজ তামাক পাতা শুকিয়ে বিড়ি-সিগারেট তৈরি করায় বনজ সম্পদের ক্ষতি হয় এবং চুল্লির চারপাশের বায়ু মারাত্মকভাবে দূষিত হয়।

বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার (ধূমপান এবং ধোঁয়াবিহীন উভয় প্রকারই) স্বাস্থ্যের ঝুঁকি তৈরি করে এবং আমাদের দেশের অর্থনীতি এবং উৎপাদনশীলতার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তামাকজনিত রোগের কারণে বার্ষিক ১,৬১,০০০-এর বেশি লোক মারা যায় (টোব্যাকো অ্যাটলাস ২০১৮, ৬তম সংস্করণ) এবং প্রায় ৪০০,০০০ মানুষ অক্ষম হয়ে পড়ে (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০০৪)।

বাংলাদেশে প্রায় ৩.৭৮ কোটি মানুষ সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, গুলের মতো বিভিন্ন তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করে। এছাড়া, প্রায় ৮ কোটি মানুষ গণপরিবহন, জমায়েত এবং আবাসস্থলে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার (গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস ২০১৭)। বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির তথ্যমতে, বাৎসরিক আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে ৩০,৫৭০ কোটি টাকা, যা তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য ব্যয় করা হয়।

ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোবাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) মে, ২০০৩ সালে জেনেভায় ৫৬তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে বিশ্বব্যাপী তামাক নিয়ন্ত্রণ এবং তামাকের ব্যবহার কমানোর লক্ষ্যে অনুমোদন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ এই চুক্তিতে প্রথম স্বাক্ষরকারী এবং ২০০৪ সালে এটি অনুমোদন করে।

তদনুসারে, বাংলাদেশ সরকার এফসিটিসি-এর আলোকে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (সংশোধিত ২০১৩) প্রণয়ন করে এবং ২০১৫ সালে রেগুলেশনস প্রণয়ন করে। আইনটি ২০১৩ সালে কিছু পরিবর্তন ও সংশোধন করা হয় এবং ২০১৫ সালে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) বিধি অবশেষে প্রণীত ও কার্যকর করা হয়েছে।

আইনটি পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ধূমপান নিষিদ্ধ করে এবং পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ধূমপান না করার সাইনবোর্ড প্রদর্শন করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া, তামাকজাত দ্রব্যের সকল প্রকার বিজ্ঞাপন, প্রচার বা পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ করা হয়।

তামাকবিরোধী অধিকারকর্মীরা যুবকদের তামাক সেবন থেকে বিরত রাখার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছেন। তারা বলেন, সিগারেটের খোলা ও খুচরা বিক্রি তরুণদের সিগারেট কেনার সুযোগ দিচ্ছে। এ ধরনের সুযোগ তরুণদের কাছে সিগারেটের সহজলভ্যতা তৈরি করেছে। এটা বন্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

বর্তমানে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই জনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়ে সরকার তামাকের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে অনলাইন প্রচারণা চালানোর পদক্ষেপ নিতে পারে। এটি তরুণদের মধ্যে সচেতনতার পরিবেশ তৈরি করতে পারে।

এক্ষেত্রে অভিভাবকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তাদের উচিত তাদের সন্তানদের ওপর তাদের নজরদারি জোরদার করা যাতে তারা ধূমপান না করে। স্কুলের পাঠ্যসূচিতে তামাকের কুফলের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করতে পারেন। এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে পারে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করার জন্য সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তামাকবিরোধী সচেতনতামূলক প্রচারণার ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রেণিকক্ষে বক্তৃতা দেওয়ার সময় শিক্ষকদের উচিত শিক্ষার্থীদের তামাক ব্যবহার না করার পরামর্শ দেওয়া, যা শিক্ষার্থীদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।

কোনো দোকানদার যেন ইউনিফর্ম পরা শিক্ষার্থীদের কাছে সিগারেট বিক্রি করতে না পারে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ বিষয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা যেতে পারে।

দেশে যুবকদের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের প্রবণতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে বিধায় ইস্পাহানি আই ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের এপিডেমিওলজিস্ট এবং সাউথ এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব পাবলিক হেলথ অ্যান্ড লাইফ সায়েন্সের এডজাংন্স ফ্যাকাল্টি মোহাম্মদ শামসাল ইসলাম একটি জাতীয় সমীক্ষা চালানোর পরামর্শ দিয়েছেন যাতে করে দেশে তরুণ তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য যুবকদের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের বিষয়টি জানা যায়। এটি তরুণ তামাক ব্যবহারকারীদের সংখ্যা খুঁজে বের করতে এবং এটা বন্ধ করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সাহায্য করবে বলে তিন মনে করেন।

যেহেতু যুবকরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, তাই তাদের মধ্যে ধূমপানের অভ্যাস দেশের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগের বিষয়। তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা তামাকবিরোধী আন্দোলনে অনেকাংশে সহায়ক হতে পারে। তামাকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবক কমিটি গঠন করা যেতে পারে। সামসাল বলেন, সামাজিক আন্দোলন খুবই কার্যকর।

রাজনৈতিক দলগুলোও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে দেশ পরিচালনার জন্য নির্বাচিত হলে তামাকমুক্ত দেশ করার অঙ্গীকার করতে পারে।

তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারণে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তামাক দ্বারা সৃষ্ট একাধিক ক্ষতি বিবেচনায় নিয়ে যদি আমরা তামাক চাষ কমাতে পারি, তাহলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করা আমাদের জন্য সহজ হবে। ২০৪০ সালের মধ্যে তামাক নির্মূল করার জাতীয় লক্ষ্য অর্জন করতে হলে এর উৎপাদন ও ব্যবহার কমাতে হবে। একই সঙ্গে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আইনটি শক্তিশালী হলে মধ্যবয়সি ও যুবকদের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার অনেকাংশে কমে যাবে।

তামাকমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্য অর্জনে সরকারের পাশাপাশি সুশীল সমাজ, পেশাজীবী সংগঠন, বেসরকারি সংস্থা ও গণমাধ্যমের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। আসুন জাতীয় স্বার্থে আমরা সবাই এ ব্যাপারে এগিয়ে আসি।