পরিবেশবান্ধব চামড়া প্রক্রিয়াকরণ

সারা বছর অব্যাহত রাখতে হবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি

প্রকাশ : ৩১ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

চামড়াশিল্প দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে চামড়া প্রক্রিয়াকরণ না করার কারণে চামড়ার গুণগত মান ক্ষুণ্ণ হয়। দামও কমে যায়। বিদেশে এ সব চামড়া অনেক সময় রপ্তানি করা যায় না। আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চামড়া প্রক্রিয়াকরণ নিশ্চিত করা গেলে দেশের চামড়াশিল্পকে আরো টেকসই ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক করে তোলা সম্ভব হবে। পরিবেশবান্ধব চামড়ার কঠিন বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ প্রযুক্তির উদ্ভাবন নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। আধুনিক পদ্ধতিতে চামড়া প্রক্রিয়াকরণ ব্যাপক হারে বাড়ানো গেলে ট্যানারিগুলোতে কেমিক্যালের আমদানিনির্ভরতা কমবে এবং ট্যানারিশিল্প আরো টেকসই হবে। এ পদ্ধতিতে একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণ হ্রাস পাবে, অন্যদিকে বর্জ্য পরিশোধন খরচ কমবে। একই সঙ্গে দেশের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশ দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলোর একটি। কোভিড-পরবর্তী বৈশ্বিক মন্দা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের সংকটের প্রেক্ষাপটে বিশ্বের দেশগুলোতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং সামগ্রিক বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা বিবেচনা করে বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি এখনো অনেকটা সন্তোষজনক বলা যেতে পারে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখে আমাদের রপ্তানি আয়। আর রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই তৈরি পোশাক খাত থেকে। তৈরি পোশাকের পর রপ্তানি বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম চামড়া শিল্প। চামড়াশিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি খাত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিল্পটি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এটি এখন দেশের অন্যতম বৃহত্তম রপ্তানি খাত।

সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে বার্ষিক রপ্তানি আয় ১ বিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে ১০ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার চেষ্টা করছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী চামড়াজাত পণ্যের বাজারের আকার ছিল ৪২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ২০২৩ থেকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত ৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ চক্রবৃদ্ধি হারে প্রসারিত হয়ে ২০৩২ সালের মধ্যে এটি প্রায় ৭৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০২০ সালে রপ্তানিকৃত বিশ্বব্যাপী চামড়াজাত পণ্যের বাজারের ৩০ শতাংশেরও বেশি অংশ চীনের দখলে। এরপর রয়েছে ইতালি, ফ্রান্স, ভিয়েতনাম এবং ভারত। এই খাতের মাধ্যমে বেশ ভালো রপ্তানি আয় হচ্ছে দেশগুলোর। অথচ বর্তমানে পুরো বিশ্বের মোট গবাদিপশু ১ দশমিক ৩ থেকে ১ দশমিক ৮ শতাংশের আবাসস্থল বাংলাদেশে হওয়া সত্ত্বেও বৈশ্বিক চামড়া বাণিজ্যে দেশটির হিস্যা মাত্র ০ দশমিক ৫ শতাংশ। বাংলাদেশে চামড়া শিল্পের বিশাল সম্ভাবনা পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কাঁচামালের সহজলভ্যতা। আমাদের দেশে সারা বছরই গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি পশু জবাই হয়। তাছাড়া ঈদুল আজহার সময় প্রচুর গরু, ছাগল কোরবানি দেয়া হয়। বাংলাদেশে কাঁচা চামড়ার বার্ষিক চাহিদার প্রায় শতকরা ৪০ থেকে ৪৫ ভাগ আসে এই কোরবানির পশু থেকে। ফলে বাংলাদেশে পশু চামড়ার পর্যাপ্ত উৎপাদন ও সরবরাহ রয়েছে। এসব চামড়াই আমাদের দেশে চামড়া শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় যা চামড়া শিল্পের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করে। বাংলাদেশি পশুর চামড়ার মান অন্যান্য দেশের থেকে উন্নত হওয়ায় ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্যের যথেষ্ট সুনাম এবং চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতিযোগিতামূলক পারিশ্রমিকে শ্রমিক পাওয়ার সুযোগ রয়েছে, রয়েছে সরকারি সমর্থন। চামড়া শিল্পের উন্নয়নের জন্য গবেষণা, প্রশিক্ষণ, যন্ত্রপাতি, পরিবেশ রক্ষা, অধিকতর পরিচ্ছন্ন উৎপাদন এবং অবকাঠামোবিষয়ক প্রকল্প গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১৯ সালে ‘চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উন্নয়ন নীতিমালা-২০১৯’ গ্রহণ করে। যদিও এটা সত্য যে চামড়া শিল্পের অনেক সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে; কিন্তু কিছু সমস্যার কারণে তা এখনো সেভাবে পুরোপুরি বিকশিত হতে পারেনি। দেশের চামড়া খাতের প্রধান সমস্যা কমপ্লায়েন্সের অভাব। এদেশে দুই দশকেও এ শিল্পকে পরিবেশবান্ধব করা সম্ভব হয়নি। ইউরোপ-আমেরিকার নামকরা আমদানিকারকদের কাছে সরাসরি চামড়া রপ্তানি করা যাচ্ছে না। ফলে এ খাতের রপ্তানি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন হচ্ছে। বিগত কয়েক বছর ধরে স্থানীয় বাজারে কাঁচা চামড়ার ন্যায্যমূল্য না পাওয়াও চামড়া শিল্পের বিকাশের অন্যতম বাধা।

কোরবানির সময় চামড়া বিক্রি হয় নামমাত্র মূল্যে। এছাড়া চামড়া সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করা এবং ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় অতীতে চামড়া নদীতে ফেলে বা মাটিতে পুড়িয়ে ফেলার মতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। যা চামড়া শিল্পের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। দেশে কাঁচা চামড়ার ন্যায্যমূল্য না থাকায় বাড়তি লাভের আশায় প্রতিবছর কিছু চোরাকারবারি চামড়া পাচার করছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে। বাংলাদেশ যদি চামড়া শিল্পে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়, তবে আগামী দিনে এই চামড়া শিল্পের উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে। আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং নতুন রপ্তানি খাতের বিকাশ ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। সর্বোপরি ব্যবসা এবং পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা তৈরির মাধ্যমে মানসম্পন্ন প্রক্রিয়াজাত চামড়া উৎপাদন, অবকাঠামো উন্নয়ন, দক্ষ মানবসম্পদ, বিভিন্ন ধরনের সহায়ক পরিষেবা প্রদান এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধম্যে চামড়াশিল্পকে একটি সম্ভাব্য নির্ভরযোগ্য রপ্তানিমুখী ও বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিসেবে গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। আগামী মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে। কোরবানির ঈদ আসলেই শুধু আমরা চামড়ার প্রক্রিয়াকরণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও বাজারজাতকরণ নিয়ে নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা করি। ঈদ যাওয়ার পর আমরা চামড়া শিল্পের গুরুত্ব সম্পর্কে ভুলে যাই। অথচ সেটি হওয়ার কথা নয়। সারা বছর ধরেই আমাদের চামড়া শিল্পের ওপর নজর দিতে হবে। সারা বছর অব্যাহত রাখতে হবে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চামড়া প্রক্রিয়াকরণ।