তামাক চাষের আগ্রাসী বিস্তার বন্ধ করতে হবে

মো. জিল্লুর রহমান

প্রকাশ : ০১ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

প্রতি বছর ৩১ মে বিশ্বজুড়ে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালন করা হয়। ২৪ ঘণ্টা তামাক সেবনের সব প্রক্রিয়া থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে দিবসটি প্রচলন করা হয়েছে। এছাড়া দিবসটির উদ্দেশ্য তামাক ব্যবহারের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব এবং জনস্বাস্থ্যের উপর এর নেতিবাচক প্রভাবের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করানো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য রাষ্ট্রগুলো ১৯৮৭ সালে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস চালু করে। বিগত সময়ে দিবসটি সরকার, জনস্বাস্থ্য সংগঠন, ধূমপায়ী, উৎপাদনকারী এবং তামাক শিল্পের কাছ থেকে উদ্যম এবং প্রতিরোধ উভয়ের মাধ্যমে বিশ্বজূড়ে পালিত হয়ে আসছে।

সবাই জানি ধূমপান করলে জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়। কিন্তু তারপরও জেনেশুনে মানুষ যেখানে সেখানে ধূমপান করে। একটি গবেষণায় জানা গেছে, শিশু-কিশোররাও এখন প্রতি ১০ জনে একজন ধূমপায়ী। শুধু ধূমপানই নয়, এরা নানা রকমের নেশাও করে এবং ধূমপানের মাধ্যমেই যেকোনো নেশা শুরু হয়। এতে যেমন তাদের দেহের ক্ষতি হচ্ছে, তেমনই পরিবেশের অন্য মানুষের দেহেরও ক্ষতি হচ্ছে। প্রতিবছর বাজেটে সিগারেটের ওপর কর বাড়ছে। তাতে অবশ্য ধূমপান আশানুরূপভাবে কমছে না, বরং সিগারেট বিক্রয় বাড়ছে। বাড়ছে তামাকের আগ্রাসী চাষও। তামাক এমন একটি ক্ষতিকর উপাদান যেটা শুধু মানুষের শরীরের ক্ষতি করে না, বরং পরিবেশেরও মারাত্মক ক্ষতি করে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশ এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে এবং বিশ্বের শীর্ষ ১০টির মধ্যে ১টি অধিক তামাক ব্যবহারকারী দেশ। জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষা এবং সার্বিক উন্নয়নে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো ‘তামাক’। এ কথা সর্ব মহলে স্বীকৃত। তামাক চাষাবাদ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সেবনসহ প্রতিটি ধাপেই পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, ১৯৭০ সাল থেকে তামাকের কারণে বিশ্বব্যাপী গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে প্রায় দেড় বিলিয়ন হেক্টর বন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, যা ২০ শতাংশ বার্ষিক গ্রীনহাউস গ্যাস বৃদ্ধির কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বিশ্বে বছরে ৩৫ লাখ হেক্টর জমি তামাক চাষে ধ্বংস হয়, যা বৈশ্বিক পাঁচ শতাংশ বনাঞ্চল ধ্বংসের জন্য দায়ী। প্রায় ৯০ শতাংশ তামাক উৎপাদন হয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে তামাকসেবী ছিল ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ। গ্লোবাল এডাল্ট টোবাকো সার্ভে ২০১৭ তে দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৫ বছরের অধিক বয়সিদের মধ্যে ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ ৩ কোটি ৭৮ লাখ মানুষ তামাকজাত দ্রব্য সেবন করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ২০২২ সালের ‘টোব্যাকো : থ্রেট টু আওয়ার এনভায়রনমেন্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের দেড় কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ সিগারেট খান। বিড়ি খান ৫৩ লাখ মানুষ। আর ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন করেন। দেখা যাচ্ছে তামাক সেবনের শতকরা হার নিম্নগামী হয়েছে, যা আশার কথা। পক্ষান্তরে, এমন কিছু অসামঞ্জস্যতা ও প্রতিবন্ধকতা রয়েছে যা তামাক নিয়ন্ত্রণে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে বিঘ্নতা সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশ বিশ্বের নবম বৃহত্তম তামাক ব্যবহারকারী দেশ। দেশের ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠী তামাক ব্যবহার করে। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ স্টাডি ২০১৯ এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের প্রধান চারটি কারণের একটি তামাক। তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। তামাকের জন্য এসব ক্ষতি হলেও দেশের তামাক চাষের এলাকা এবং এর উৎপাদন বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ সালে দেশের ৯৯ হাজার ৬০০ একরের বেশি জমিতে তামাকের চাষ হয়। এ সময় ৮৯ হাজার ২ মেট্রিক টন তামাক উৎপাদিত হয়। পরের অর্থবছরে তামাক চাষের জমির এলাকা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৮৪ একরের বেশি জমি। আর তামাক উৎপাদিত হয় ৯২ হাজার ৩২৬ মেট্রিক টন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে দেখা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে প্রিমিয়াম, উচ্চ, মাঝারি ও নিম্নস্তরের ৭ হাজার ১৫৯ কোটির বেশি সিগারেট শলাকা বিক্রি হয়েছে। পরের বছর তা বেড়ে হয়েছে ৭ হাজার ৫৬৪ কোটির বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ৫ হাজার ১৯৫ কোটি সিগারেট শলাকা বিক্রি হয়েছে। যদি মাসভিত্তিক হিসাব বিবেচনায় নেওয়া হয়, তাতে দেখা যায়, এ বছরও সিগারেটের বিক্রি আগের বছরকে ছাড়িয়ে যাবে। তামাকবিরোধী সংগঠনের মতে, তামাকের ওপর যে হারে কর বাড়ানো হয়, তা যথেষ্ট নয়, কারণ তামাক পণ্য নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় আরো সস্তা হয়ে পড়ছে।