ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বেতনভোগী কর্মচারীর শত কোটি টাকা

সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে উঠতে পারে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ
বেতনভোগী কর্মচারীর শত কোটি টাকা

বেতনভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারী কীভাবে কোটি কোটি টাকা থেকে শত কোটি টাকার মালিক হয়, তা দেশবাসীকে হতবাক করে বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি মুহাম্মদ আব্দুল হাফিজ। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি হিসেবে নিজের শেষ কর্মদিবসে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় ও সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে আয়োজিত সংবর্ধনায় দেওয়া বক্তব্যে গত বৃহস্পতিবার তিনি এমন কথা বলেন। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিদের উপস্থিতিতে দেওয়া বক্তব্যে বিচারপতি মুহাম্মদ আব্দুল হাফিজ বলেন, ‘দুর্নীতি আমাদের সব অর্জন ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের হাত থেকে অফিস-আদালতমুক্ত রাখতে হবে। একজন বেতনভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারী কীভাবে কোটি কোটি টাকা এমনকি শত কোটি টাকার মালিক হন, তা দেশবাসীকে হতবাক করে। তাই এগুলো রোধ করতে রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে। তাহলে দেশ উপকৃত হবে।’ বিচারপতি হাফিজ আরো বলেছেন, ‘নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে মুহূর্তেই বড়লোক হওয়ার মানসিকতা আমাদের বড় বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।’ দেশে অপরাধের ধরন পাল্টে যাওয়া এবং কিশোর গ্যাংয়ের ভয়াবহতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সময়ের বিবর্তনে অপরাধের ধরন প্রতিনিয়ত পাল্টে যাচ্ছে। আমাদের সন্তানদের ভয়াবহ অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অভিভাবকদের বিভিন্নমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। পারিবারিক সম্প্রীতি, সংস্কৃতি, দীর্ঘদিনের লালিত মূল্যবোধ নষ্ট হচ্ছে। কিশোর গ্যাংয়ের উত্থান ঘটেছে। মাদক, সামাজিক অনাচারসহ অস্ত্রের প্রতিযোগিতা, হুমকি ও আশঙ্কার বিস্তার ঘটেছে।’ এগুলোই আমাদের টেকসই উন্নয়ন, শান্তি, প্রসারিত ভালোবাসা, ধৈর্য ও সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এ সময় বিচারপতি মুহাম্মদ আব্দুল হাফিজ বলেন, দুর্বলকে রক্ষা, দুর্নীতি রোধ, ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রাপ্তি এবং দেশ ও জনগণের শান্তি-নিরাপত্তায় দেশের বিচার বিভাগ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। মিথ্যা মামলার ভয়াবহতা উল্লেখ করে বিচারপতি মুহাম্মদ আব্দুল হাফিজ বলেন, ‘প্রতিপক্ষকে হয়রানি করার জন্য মিথ্যা মামলা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিচার বিভাগকে এর ভার বহন করতে হচ্ছে। এতে আদালতের প্রচুর সময় নষ্ট হচ্ছে। মিথ্যা মামলা ন্যায়বিচারের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিচারপতি হাফিজ তার শেষ কর্মজীবনে যেসব কথা বললেন, তা এদেশের মানুষের মনের কথা। তিনি অত্যন্ত চমৎকারভাবে তার অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের সমাজের বাস্তব চিত্রটি তুলে ধরেছেন। এ জন্য তাকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত। সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য সবাই যদি এগিয়ে আসেন, তাহলে আমাদের সমাজ কলুষমুক্ত হবে। মানুষ শান্তিময় জীবনযাপন করতে পারবেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে অত্যন্ত সোচ্ছার। তিনি কাউকে একবিন্দু ছাড় দেন না। আমাদের দেশে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব নানা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও তারা পার পেয়ে যাচ্ছেন না। তাদের আইনের আওতায় আসতে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশাসনিক বৈঠকগুলোতে ঘুষ ও দুর্নীতি কমানোর বিশেষ নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। তিনি বলে থাকেন, ‘পে-স্কেলে বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন যে হারে বেড়েছে, তা বিশ্বে বিরল। তাই জনগণ যেন সেবা পায়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। বেতন যেহেতু বেড়েছে, তাই ঘুষ-দুর্নীতি সহ্য করা হবে না। প্রধানমন্ত্রী নিজেকে জনগণের সেবক হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সেবাকেই তিনি তার রাজনৈতিক ব্রত হিসেবে মনে করেন। তবে এ কথা বলা যায় যে, যাদের জ্ঞাত আয়-ব্যয়ে বিরাট রকমের অসঙ্গতি রয়েছে, তারাই বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে পারে। বলাবাহুল্য, এই ভোগবিলাসের মূলে রয়েছে, অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ-সম্পদ। দুর্নীতিবাজরা অতীতের মতো আর সমাজের ঘৃণিত ব্যক্তি নয় বরং তারা অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছে, এমন ধারণা এখন মানুষ কেন যেন পোষণ করতে শুরু করেছে। দেশের তরুণ সমাজের মধ্যেও এ ধরনের একটি বিকৃত মূল্যবোধ বাসা বাঁধছে। দুর্নীতি আমাদের জীবনে নিত্যদিনের অভিশাপ এবং জাতীয় জীবনে এক বড় কলঙ্ক। দুর্নীতি দূর করতে প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার। শুধু মুখের কথায় দুর্নীতি দূর হবে না। আমলাতন্ত্রের দুর্নীতি বন্ধ করতে পারে রাজনৈতিক নেতৃত্ব। কাজেই রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া দুর্নীতি বন্ধ বা কমানো সম্ভব সম্ভব নয়।

আমলাতন্ত্রের দুর্নীতি দমনে সরকারকে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে দুর্নীতি দমন কমিশনকে অবশ্যই স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। তাদের তদন্ত করার ক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়াতে হবে। মেরুদণ্ডসম্পন্ন এবং দেশের প্রচলিত আইন-কানুন বোঝেন কিংবা জানেন, এমন ব্যক্তিদের এই প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিতে হবে। প্রশাসনে বদলি, পদোন্নতি ও প্রচলিত নিয়োগ পদ্ধতি নীতিমালা অনুযায়ী না হলে দুর্নীতির জন্ম দেয়। দুর্নীতিপরায়ণ হলেই তাকে অবশ্যই সম্ভাব্য পরিণতি ভোগ করতে হবে, এমন বার্তা প্রশাসনে ছড়িয়ে দিতে হবে। দুর্নীতির শাস্তিগুলো দৃষ্টান্তমূলক হওয়া উচিত। দুর্নীতি প্রতিরোধে তথ্য-প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি মানুষেরই একটি সম্পদের বিবরণী থাকতে হবে। দেশে-বিদেশে যেখানেই তার সম্পদ থাকবে, তার বিবরণ ওই হিসাবে থাকবে। কেউ তার কোনো সম্পদ বিক্রি করলে সেটি তার হিসাব থেকে বাদ যাবে এবং সঙ্গে সঙ্গে তা যে কিনবে তার হিসাবে যুক্ত হবে। এই পদ্ধতিতে ব্যাংক হিসাব থেকে শুরু করে, আয়কর পর্যন্ত সবকিছুই একটি বোতামের নিচে নিয়ে আসা যাবে; আর এগুলো যদি ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়, তবে সাধারণ জনগণ যেমন হয়রানির স্বীকার হবে না, তেমনি যদি কেউ কোনো রকম সুযোগ গ্রহণের চেষ্টা করে তা ধরাও খুব সহজ হবে। এসব ব্যাপারে অনেক দেশ সফল হয়েছে। তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। বিচারপতি মুহাম্মদ আব্দুল হাফিজ যে প্রশ্নটি আমাদের জন্য রেখে গেলেন সেই প্রশ্ন ধরে যদি আমরা উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি, তাহলে সমাজ অনেকটাই দুর্নীতিমুক্ত রাখা সম্ভব। সম্মিলিত সবার প্রচেষ্টায় গড়ে উঠতে পারে, একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত