ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মাদকদ্রব্যের সরবরাহ ছিন্নকরণ

বাড়াতে হবে ডোপ টেস্ট বাড়াতে হবে প্রচারণা
মাদকদ্রব্যের সরবরাহ ছিন্নকরণ

মাদক দ্রব্যের চাহিদা ও সরবরাহ মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে এমনটিই বলে মনে করছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। সংস্থাটি বলছে, চাহিদা কমাতে পারলে মাদকের সরবরাহও কমে যাবে। আর এ কারণেই তারা চাহিদা কমাতে জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে। বিভিন্ন মাধ্যমে সারা বছরই প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে সংস্থাটি। এছাড়া অভিযানের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংস্থাগুলোও মাদক নির্মূলে দেশব্যাপী বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক প্রকল্প গ্রহণ করেছে। সারা বছর ধরে মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। মামলা এবং আসামির সংখ্যাও কম নয়। অথচ কাজের কাজ তেমন একটা হচ্ছে না। দেশে আসলে মাদকাসক্তের সংখ্যা কত তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) তথ্য মতে, গত বছর দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ছিল ৮৫ থেকে ৯০ লাখ। তবে বর্তমানে এই সংখ্যাটি ১ কোটির কাছাকাছিতে পৌঁছে যাচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সরকারি হিসাবে এই সংখ্যা ৩৪ লাখের মতো। তবে সংখ্যা যা-ই হোক, তা যে খুব একটা স্বস্তির নয়। দেশে মাদক গ্রহণকারী শনাক্তকরণ পরীক্ষা বা ডোপ টেস্টের সুযোগও খুব একটা নেই। সবচেয়ে বেশি ডোপ টেস্ট করা হয়ে থাকে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া কিংবা নবায়নের সময়। এছাড়া কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, অস্ত্রের লাইসেন্স, বিদেশে উচ্চশিক্ষা বা গবেষণা, সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে যোগদানের জন্য স্বাস্থ্য পরীক্ষার সঙ্গে মাদক পরীক্ষার সনদ জমা দিতে হয়। আবার চাকরিতে থাকাকালে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর আচরণ সন্দেহজনক মনে হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তার ডোপ টেস্ট করিয়ে থাকে। রাজধানীতে চালকদের বেশিরভাগ ডোপ টেস্ট করা হয় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারে। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডোপ টেস্টে ‘পজিটিভ’ হার সবচেয়ে বেশি এসেছে, অর্থাৎ এই বছরে বেশিসংখ্যক ব্যক্তি মাদক গ্রহণকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। ২০২২ সালে পরীক্ষা করা ব্যক্তিদের মধ্যে মাদক নেওয়া ব্যক্তিদের হার ছিল প্রায় দেড় শতাংশ। ২০২৩ সালে তা সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ পর্যন্ত পাওয়া গেছে। সরকারি সংস্থার পাশাপাশি বেসরকারি বেশ কিছু সংস্থাও মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছে। দেশে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের মধ্যেও মাদক গ্রহণের প্রবণতা বাড়ছে। ফলে নারীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি প্রজননস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে মাদক সেবন। এর ফলে একজন নারীর সন্তানধারণ ও লালন-পালন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে মাদক নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের চালানো কার্যক্রমের মূল বৈশিষ্ট্য হলো মানুষকে সচেতন করা। কিন্তু কার্যক্রমের মূল ধরণটি হতে হবে দেশে মাদক উৎপাদন ও মাদক প্রবেশের সব পথ রুদ্ধ করা। বাংলাদেশে সীমান্ত হয়ে মাদক প্রবেশ করছে, আন্তর্জাতিক ফ্লাইটেও মাদক প্রবেশের অভিযোগ রয়েছে। এগুলো বন্ধ করাও জরুরি। এছাড়া বাংলাদেশে মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য যে মডেল ফলো করা হচ্ছে, সেটিও যুগোপযোগী নয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বলছে, তারা জনসচেতনতা বাড়াতে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। তবে প্রচার-প্রচারণা দিয়ে মাদক নির্মূল করা সম্ভব হবে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কেননা আমাদের প্রতিবেশী দুটি দেশ মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্ত দিয়েই মূলত আমাদের দেশে মাদক আসে। যেখান থেকে মাদকগুলো আসে, সেই উৎসটা যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায়; তাহলে কিন্তু মাদক অনেকাংশে হ্রাস পায়। তবে দেশে যদি চাহিদা থাকে, তাহলে কোনো না কোনোভাবে মাদক প্রবেশ করবেই। মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করা হলেও শতভাগ সেটা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। নিত্য-নতুন মাদক দ্রব্য আমাদের দেশের জন্য একটি ‘বড় চ্যালেঞ্জ’ বলে মনে করা হচ্ছে। সারা বিশ্বে নতুন নতুন মাদক তৈরি হচ্ছে। সেগুলো মাঝেমধ্যে আমাদের দেশেও আসছে। এসব মাদক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরই অনেকে চেনেন না, এ সম্পর্কে জানেনও না। তারা প্রকৃত অর্থে বুঝতে পারে না, এটি আসলে মাদক কি না। যারা মাদকাসক্ত হয়ে গেছে তাদের চিকিৎসা করিয়ে চাহিদা কমানো সম্ভব। যারা মাদকাসক্ত তাদের চিকিৎসা করানো হলে চাহিদাটা আর থাকে না। যারা এখনও মাদকাসক্ত হয়নি তারা যেন মাদকাসক্ত না হয়, সেজন্যও ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। মাদকের বিরুদ্ধে সরকার জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও এর সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে পুলিশ ও র‌্যাব অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। মাদকদ্রব্য ও মাদক কারবারি যেন নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে- এজন্য সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু অপরাধীদের গ্রেফতার নয়, মাদকের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। যারা তথ্য দিয়ে সহায়তা করবেন তাদের নাম পরিচয় গোপন রাখতে হবে। ‘চলো যাই যুদ্ধে মাদকের বিরুদ্ধে’, এই স্লোগান নিয়েই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কাজ করতে হবে। আশঙ্কার কথা হচ্ছে ‘প্রচলিত মাদকের পাশাপাশি ক্রিস্টাল মেথ ও আইসের মতো কিছু নতুন ধরনের মাদক আমাদের দেশে ঢুকছে। এসব মাদক যাতে আমাদের সমাজে ঢুকতে না পারে, এ বিষয়ে সবাই যেন অনেক বেশি সচেতন হয়; সেজন্য অভিভাবক থেকে শুরু করে সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করা দরকার। দিবসকেন্দ্রিক আলোচনা অনুষ্ঠান কিংবা লিফটলেট বিতরণ করে তো আর জাতিকে রক্ষা করা যাবে না। বাংলাদেশ মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য যে মডেল ফলো করছে সেটি ‘আপডেট নয়’ মন্তব্য করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকার চিকিৎসা দিচ্ছে, সেটি পরিপূর্ণ নয়। মাত্র এক মাসের একটি সার্ভিস দিয়ে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। চিকিৎসা-পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের কোনো সুযোগ নেই।। কমপক্ষে তিন মাসের চিকিৎসা না হলে এটি কার্যকর হবে না। সরকার অকার্যকর একটি চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে, যা দিয়ে মূলত অর্থের অপচয় হচ্ছে। দেশের মাদক নিরাময়ের চিকিৎসা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। দেশে ৩৬০টির মতো সনদধারী মাদক নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। তবে মাদকাসক্তি নিরাময়যোগ্য রোগ নয়। মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলোর বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। এভাবে নিয়ন্ত্রণ বা মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা কমানো সম্ভব নয়। সময়ের প্রেক্ষাপটে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর কার্যক্রম পরিবর্তন, সংশোধন, ও যুগোপযোগী করা প্রয়োজন। অন্যথায়, সচেতনতা কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের প্রচুর অর্থ ব্যয় হবে কিন্তু মাদক নিয়ন্ত্রণ ও মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা কমানো কোনোটাই সম্ভব হবে না। সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করলেও বাস্তবিক অর্থে এর উপস্থিতি ও প্রয়োগ কখনও কখনও সক্রিয় হলেও কোনও অদৃশ্য কারণে সেই সক্রিয়তা থেমে যায়। দেশের যুবসমাজকে মাদকের ভয়াবহতা এখনও পর্যন্ত সঠিকভাবে জানানো সম্ভব হচ্ছে না। এটা শুভ লক্ষণ নয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত