ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নগর আদালত আইন ও কিছু কথা

মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার
নগর আদালত আইন ও কিছু কথা

সরকার গ্রাম আদালতের অনুকরণে সিটি কর্পোরেশন ও পৌর এলাকার বিরোধ মীমাংসার জন্য ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে ‘বিরোধ মীমাংসা (পৌর এলাকা) বোর্ড আইন ২০০৪’ শিরোনামে নগর আদালত গঠনের আইন পাস করে। কিন্তু দুই দশক অতিক্রম করার পরও সে আইন কেতাবেই শোভা পাচ্ছে। মাদারীপুর লিগ্যাল এইড অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ হতে সর্বশেষ ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও গোপালগঞ্জ জেলার ছয়টি পৌরসভায় এই আইন সক্রিয়করণের লক্ষ্যে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। তারা আইনটি সংস্কারের জন্য মিউনিসিপ্যাল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ম্যাব) এর সাথে একটি সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে অ্যাডভোকেসি কার্যক্রমও গ্রহণ করে।

মামলা জট ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে জনসাধারণের আদালত বিমুখতাসহ আরো কিছু বাস্তবতার উল্লেখ করে ‘এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ’ এর আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে ‘নগর আদালত আইন : প্রস্তাবিত রূপরেখা ও বাস্তবায়নের সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক সংলাপে কিছু প্রস্তাবনা পেশ করেন। তাতে নগর বলতে দেশের ১২টি সিটি কর্পোরেশনকে উদ্দিষ্ট করে নগর আদালতের গঠন, কার্যপ্রণালী, সমস্যা ও সমাধান প্রভৃতি বিষয় আলোচনান্তে একটি খসড়া প্রস্তাব পেশ করেন। সংশ্লিষ্ট সংলাপের আয়োজক ছিল, এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ, মাদারীপুর লিগ্যাল এইড অ্যাসোসিয়েশন (এমএলএএ), ব্লাস্ট এবং নাগরিক উদ্যোগ। সে উদ্যোগ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বর্তমানে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।

উক্ত সংলাপে নগর আদালতের কাঠামো সংক্রান্ত যে সংস্কার প্রস্তাব রয়েছে, তাতে গ্রাম আদালতের ন্যায় ইউনিয়নের পরিবর্তে মিউনিসিপ্যাল ওয়ার্ডভিত্তিক পাঁচ সদস্যের আদালত গঠনের কথা বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট আদালতের প্রধান হবেন স্ব-স্ব ওয়ার্ড কাউন্সিলর। বাকি চারজন সদস্যের মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে প্রত্যেক পক্ষের সমর্থনে একজন করে কাউন্সিলর ও একজন করে গণ্যমান্য ব্যক্তি থাকবেন। এও বলা হয়েছে, একজন নারী যেন আদালতে থাকে। অবশ্য সেই একজন নারীর মর্যাদা কি, কার প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করবেন এবং তাকেসহ কত সদস্যের আদালত গঠিত হবে সে বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। এই আইনে আপিল আদালত হিসেবে মেয়র কর্তৃক অনুরূপভাবে গঠিত আদালতের কথা বলা হয়েছে।

নগর আদালতের উদ্দেশ্য সেখানকার পিছিয়েপড়া মানুষকে স্বল্প খরচে হয়রানি ও দীর্ঘসূত্রতামুক্ত ন্যায়বিচার পৌঁছে দেয়া। খুবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এর বাস্তবায়ন কতটা সহজ হবে তা পূনর্বিবেচনার দাবি রাখে। বর্তমান সংশোধন প্রস্তাবেও উভয় পক্ষের প্রতিনিধির বিষয়টি গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান এবং সংরক্ষিত তিন মহিলা সদস্যসহ মোট ১২ জনের পরিষদ। অপরদিকে মিউনিসিপ্যাল ওয়ার্ডে একজনই কাউন্সিলর। প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে প্রতি ওয়ার্ডে একজনই কাউন্সিলর থাকেন সেখানে সেই ওয়ার্ডের প্রত্যেক বিচারপ্রার্থীকে আরও একজন করে দুইজন কাউন্সিলর রাখতে হলে অন্যান্য ওয়ার্ডে ধরনা দেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। তদবস্থায় কমিশনাররা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে অপর কোনো ওয়ার্ডে গিয়ে সেখানকার (অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাসমান) মানুষের বিচারে প্রতিনিধিত্ব করার প্রবণতা রাখেন কি না; কিংবা নিরীহ বিচারপ্রার্থীদের পক্ষে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা সহজ হবে কি না, সে বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে। সর্বাবস্থায় মনে রাখতে হবে, আনুষ্ঠানিক বিচারব্যবস্থার সমান্তরালে গ্রামীণ সামাজিক বাস্তবতা ও অপরাধ প্রবণতার ধারণা থেকে গ্রাম আদালত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু এর সমাজ বাস্তবতার সাথে আইনের তত্ত্বগত অসামঞ্জস্যের কারণে যুগ যুগ ধরে তা কার্যকর হতে পারেনি। দেশি-বিদেশি উদ্যোগে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে আনীত সংশোধনীর মাধ্যমে সেই অসামঞ্জস্য কিছুটা দূরীভূত হলেও এখনও দেশের অধিকাংশ ইউনিয়নে তা কার্যকর নয়। বিশেষত সালিশবিচারের তুলনায় এর সাফল্য খুবই অপ্রতুল। বর্তমানে এর কিঞ্চিৎ সাফল্যকে পুঁজি করে অনুরূপ নিয়মের আওতায় নগর আদালত গঠন প্রক্রিয়া চলছে। এর সাফল্য সম্পর্কে বলতেই হচ্ছে, যদি এমন কিছু করতেই হয় তাহলে অবশ্যই নগর জীবনের সামাজিক বাস্তবতা ও সেখানকার অপরাধের ধরন সম্পর্কিত তত্ত্ব বিবেচনায় নিয়েই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিস্মৃত হলে চলবে না যে, গ্রাম এবং শহরের সামাজিক মেজাজ সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। সামাজিক বাস্তবতার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক আইন বা সংশোধন প্রস্তাব প্রণয়নের সময় বিবেচনায় নেয়া হয়েছে কি না স্পষ্ট নয়। তাই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে হচ্ছে, গ্রামের জীবনযাত্রা যেমন সহজ তেমনি সে সমাজের প্রত্যেকে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বন্ধনে নিবিড়ভাবে আবদ্ধ। যুগ যুগ ধরে বংশপরম্পরায় একে অপরের প্রতিবেশী হিসেবে জীবনযাপন করায় রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও সবাই আত্মীক বন্ধনে এমনভাবে সম্পৃক্ত যে, কেউ কারো থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। সকলে যেন একই বৃন্তের অজস্র পুষ্পদল। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে কারো কোনো সমস্যা হলে নিজের সব কাজকর্ম ফেলে পরহিতে ভূমিকা পালনে সবাই আন্তরিক। যারা নেতৃত্বে থাকেন তারা তো এসব কাজকে দায়িত্ব মনে করেন। এখানে সকলের তরে সকলেই নিবেদিতপ্রাণ। সালিশবিচারে যারা যুক্ত তাদের কেউ কেউ কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক হলেও বিচারের ব্যাপারে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেন। ব্যবসায়ী লোকজনের পরিমাণ এখানে খুবই সীমিত।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত