অর্থের লোভে হৃদরোগের অপারেশন

খাদ্যাভ্যাস-জীবনাচরণ পরিবর্তনে সুস্থ হতে পারে হার্টের রোগী

প্রকাশ : ০৩ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্বে প্রতিবছর যত মানুষ মারা যান, তার ৩০ শতাংশই হার্টের অসুখে। ভারতে প্রতিবছর ১ কোটি মানুষ মারা যান, এর মধ্যে হৃদরোগে মারা যান প্রায় ৩০ লাখ মানুষ; যা প্রতি তিনজনে একজন। আর বাংলাদেশেও ১৫ থেকে ২০ শতাংশ মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত। আর সব মিলিয়ে নানা রোগে ভুগে মারা যাওয়াদের মধ্যে অর্ধেকই হার্ট-অ্যাটাকে।’ ঢাকায় সম্প্রতি এক সেমিনারে এসব তথ্য তুলে ধরেন ভারতের খ্যাতিমান হৃদরোগ ও লাইফস্টাইল বিশেষজ্ঞ ডা. বিমল ছাজেড়। তিনি বলছেন, ভয়াবহ এই রোগ সার্জারি ছাড়াই নিরাময় সম্ভব। এ জন্য তিনি বিশেষ এক চিকিৎসা পদ্ধতির প্রচারণা চালাচ্ছেন। সাওল নামে এই চিকিৎসা পদ্ধতির উদ্ভাবক আমেরিকার প্রখ্যাত হৃদরোগ ও লাইফস্টাইল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ডিন অর্নিশ। এটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে ডা. বিমল ছাজেড়ের প্রতিষ্ঠিত সাওল হার্ট সেন্টার। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ও ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১৩২টি শাখার মাধ্যমে ‘বিনা রিং ও বিনা অপারেশনে’ হৃদরোগের স্থায়ী চিকিৎসা দিচ্ছে। তার দাবি, প্রাণঘাতী হৃদরোগ চিকিৎসায় এনজিওপ্লাস্টি, বাইপাস বা কাটাছেঁড়া ছাড়া শুধু খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচরণ পরিবর্তনের মাধ্যমে লাখ লাখ হার্টের রোগী সুস্থ হয়েছেন। এই পদ্ধতিতে কীভাবে চিকিৎসা করা হয়, এর স্থায়িত্বকাল কত এবং কেন ও কীভাবে ব্লক ও হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করা সম্ভব; এসব বিষয় নিয়েই তিনি কথা বলেছেন, ঢাকার একটি গণমাধ্যমের সঙ্গে। সেই সাক্ষাৎকারের মূল বক্তব্য হচ্ছে : হার্ট হচ্ছে- মাল্টিফাংশনাল একটি সিস্টেম। এই হার্টে অনেক সময় ব্লক তৈরি হয়। সেটা বাড়তে বাড়তে শতভাগ হয়ে গেলে ব্লকে পর্দা ছিড়ে যায় এবং হার্ট অ্যাটাক হয়। হৃদরোগ হওয়ার অনেকগুলো কারণ আছে।

বিভিন্ন খাবারের মাধ্যমে রক্তে অনেক সময় কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়। আবার কারও শরীরে জ্বিনগত কারণেও কোলেস্টেরল বেশি তৈরি হয়। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকলে, সেটা ধীরে ধীরে হার্টের রক্তনালীতে জমে ব্লকেজ তৈরি করে। এছাড়া উচ্চ রক্তচাপ সুগার, ডায়বেটিস, ধূমপান, স্ট্রেস এবং তেল-মাংসজাতীয় খাবার ব্লকেজ বাড়াতে সাহায্য করে। খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ ও শারীরিক অনুশীলনের অভাবে হার্টের ব্লক বাড়তে থাকে। এটি ৭০ শতাংশের ওপরে গেলে বুকসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা অনুভব হবে। এছাড়া সিটি এনজিওগ্রামের মাধ্যমেও ব্লকের সঠিক মাত্রা জানা যায়। লাইফস্টাইলের অবনতি, খাবারে ফ্যাট বেড়ে যাওয়া এবং শারীরিক ব্যায়াম ও পরিচর্যা কমে যাওয়া মূলত হৃদরোগ বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ। এছাড়া অ্যালকোহল, ধূমপান, মানসিক চিন্তা ও অতিরিক্ত স্বাস্থ্য বেড়ে যাওয়ার কারণে দিন দিন হার্টের রোগী বাড়ছে। প্রচলিত হাসপাতালগুলোর চিকিৎসকরা ব্যবসায়িক চিন্তা থেকে হার্টের রোগীদের অপারেশনের বিকল্প চিকিৎসা দিচ্ছেন না।

শরীর-বুক কাটা-ছেঁড়া করে রিং বাইপাস করানো স্থায়ী ও সুস্থ চিকিৎসা নয়। প্রকৃতি থেকে সরে গেলে এবং আর্টিফিশিয়ালের ব্যবহার বাড়লে হৃদরোগের সংখ্যাও বাড়তে থাকবে। হৃদরোগের চিকিৎসার আগে হৃদরোগ সম্পর্কে পূর্ণজ্ঞান নিতে হবে। হৃদরোগ কী, কেন ও কীভাবে হয় এবং কী কী উপায়ে প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা যায়, সে সম্পর্কে জানতে হবে। যার শরীরে ক্লোরেস্টরল বেশি, জ্বিনগতভাবে হাইপেশার ও সুগার বেশি; তাদের মেডিসিনের মাধ্যমে ব্লক পাতলা করা হয় এবং এনজাইনার বেশি থাকলে সেটাও মেডিসিনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এর মাধ্যমে রোগীর স্বাভাবিক জীবনে আসতে থাকে। এটা আরো টেকসই করতে আরো দুটি চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে। একটি ন্যাচারাল বাইপাস, অপরটি ডিটক্স থেরাপি। যারা খাবারে পরিবর্তন ও তেল বর্জন করেছেন এবং নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করে থাকেন, তাদের জন্য রোগ নিরাময় সহজ হয়। তবে অস্বাস্থ্যকর তেল-মশলার খাবারের কারণে বেড়ে যায়, হার্টের পাশাপাশি ওজন বৃদ্ধি, কিডনি ও লিভার আক্রান্ত হয়।

সাওল পদ্ধতির মাধ্যমে হার্টের চিকিৎসাসহ লিভার, কিডনি, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অতি ওজন, গ্যাস্ট্রিক, ক্যান্সার, থাইরয়েড, হেপাটাইটিস, বাত, ডেঙ্গু ও টিবি আক্রান্ত রোগীরা সুস্থ হয়ে উঠছে- এমনটি দাবি করা হচ্ছে। যেহেতু সার্জারি ছাড়াই হার্টের স্থায়ী চিকিৎসা করা সম্ভব। অথচ হাসপাতালগুলো অর্থের লোভে রিং প্রতিস্থাপন, বাইপাস সার্জারি ও এনজিওপ্লাস্টির দিকে ঝুঁকছে। কোনো মানুষের দেহে একবার হৃদরোগ বাসা বাঁধলে তাকে সারা জীবন অত্যন্ত নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গে জীবনযাপন করতে হয়। আর হৃদরোগের চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি। এ ছাড়া অপারেশন করলে মানুষ যে পুরোপুরি ভালো হয়ে যাবে, সেটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। অপারেশন করার পর মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে তার কাজকর্মে এর প্রতিফলন দেখা যায়। খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচরণ পরিবর্তনে হৃদরোগীরা যদি সুস্থ হতে পারে, তাহলে তাদের অর্থের সাশ্রয় হবে। দুর্ভোগ কমবে। সেই সঙ্গে অর্থের লোভে হৃদরোগের অপারেশন করার মতো চিন্তাভাবনা ডাক্তারদের থাকবে না। খাদ্যাভ্যাস-জীবনাচরণ পরিবর্তনে যদি হার্টের রোগী সুস্থ হতে পারে, তাহলে সেটা হবে সবার জন্যই সৌভাগ্যের। মানুষ সেই সুদিনের অপেক্ষায় থাকবে।