ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আমাদের পরিবেশ পরিকল্পিত ও বাস্তবানুগ পদক্ষেপ নেয়া জরুরি

আফতাব চৌধুরী
আমাদের পরিবেশ পরিকল্পিত ও বাস্তবানুগ পদক্ষেপ নেয়া জরুরি

প্রতি বছর ৫ জুন ঘটা করে আড়ম্বরের সঙ্গে পরিবেশ দিবস পালিত হয়। এবারও হচ্ছে দিনব্যাপী বক্তৃতা, সভা, সমিতি, সেমিনার ও প্রদর্শনীর মাধ্যমে আমরা গুরুত্বপূর্ণ এ দিবসটি পালন করে থাকি। নেতা, নেত্রী ও উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বৃক্ষচারা রোপণ করে থাকেন বিভিন্ন জায়গায়। কিন্তু এসব কাজে কতটুকু সফলতা এসেছে, তার হিসাব নেয়ার সময় এসেছে। কারণ এত কিছুর পরও পরিবেশ দূষণ আজ এক মারাত্মক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। বনাঞ্চলের পরিমাণ সম্প্রসারিত না হয়ে দিনে দিনে সংকুচিত হচ্ছে। প্রকৃতি হারাচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্যতা।

আমরা জানি, একটি জীব তার জীবদ্দশায় যে সব উপাদানের দ্বারা প্রভাবিত হয়, সে সব উপাদনগুলোকে একত্রে পরিবেশ বলা হয়। এ সব উপাদানগুলোকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়- স্বজীব ও নির্জীব। রোগ জীবাণু উদ্ভিদ এবং মানুষসহ সব প্রকারের প্রাণী পরিবেশের সজীব উপাদানের অন্তর্গত। পরিবেশের প্রধান নির্জীব উপাদানগুলো হলো- মাটি, পানি, বায়ুমন্ডলের বিভিন্ন গ্যাস এবং বাতাস, আলো শক্তি, আগুন, তেজস্ক্রিয়তা, উষ্ণতা, আদ্রতা, অভিকর্ষ ইত্যাদি।

সব প্রকারের জীব তার জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় উপকরণ পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করে থাকে। পরিবেশ সব উদ্ভিদ ও প্রাণীর চলাফেরা এবং বংশ বিস্তারে সাহায্য করে। ভৌগোলিক কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের পরিবেশ বিভিন্ন প্রকারের আর সে পরিবেশে গড়ে ওঠেছে, বিভিন্ন প্রকারের উদ্ভিদ এবং প্রাণী জগৎ। পৃথিবীর তথ্য উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের সৃষ্টিলগ্ন থেকে বিভিন্ন প্রকারের উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের মধ্যে একটি ভারসাম্য বর্তমান। কিন্তু গত কয়েক দশকে প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা মানব জাতিকে সচেতন ও সতর্ক করে দিয়েছেন যে, বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে পরিবেশ ভীষণভাবে দূষিত হচ্ছে। এ পরিবেশ দূষণ মানব জীবনে নিদারুণ সংকট সৃষ্টি করেছে। পরিবেশ দূষণের ফলে শুধু মানব জাতি নয়, সব জীবকূলের অস্তিত্ব ধীরে ধীরে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। বর্তমানে মানবসভ্যতার আধুনিকীকরণের সঙ্গে সঙ্গে মানবসভ্যতা এক ভয়াবহ সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে। এ সংকট হচ্ছে পরিবেশ দূষণের সংকট। অতীতে এ পরিবেশ বিশুদ্ধ ছিল; কিন্তু সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে দাবাগ্নি অগ্নুৎপাত প্রভৃতি প্রাকৃতিক কারণে পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানগুলো দিনের পর দূষিত হয়ে চলেছে। তাই পরিবেশ দূষণ সব বিশ্বের সামনে আজ সবচেয়ে বড় সমস্যা। এ সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করা প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। তাই আজ সব বিশ্বজুড়ে চলছে নানা গবেষণা। এর কারণ ও প্রতিকারের সম্বন্ধে নানা তথ্যাদি সংগ্রহ চলছে। পৃথিবীর সব মানুষ দূষণের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য মিলিত হচ্ছে একই ছত্রছায়ায় এবং উদ্ভাবন করতে চাইছে এর প্রতিকার।

দূষণ পরিবেশের প্রাকৃতিক উপাদানগুলোর স্বকীয়তা নষ্ট করে। পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের ক্ষতিকারক বস্তুর অনুপ্রবেশকে দূষণ বলা হয়। বিভিন্ন বস্তুবিজ্ঞানীরা দূষণের বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। বস্তুবিজ্ঞানী ‘ওডামের’ মতে দূষণের সংজ্ঞাটি নিম্নরূপ- ‘বায়ু, পানি, মাটি প্রভৃতির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক বৈশিষ্ট্যের যে পরিবর্তন মানবসভ্যতাকে অথবা কোনো প্রজাতির জীবনকে সাংস্কৃতিক বা প্রাকৃতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বা করতে পারে, তাকে দূষণ বলে।’ প্রকৃতিতে পরিবেশ দূষণ এমনিতে ঘটে। প্রকৃতি নিজে বৃক্ষলতার মাধ্যমে সে দূষণ এবং সংশোধনী পাশাপাশি চলে আসছে এবং প্রকৃতিতে ভারসাম্য বজায় রয়েছে। কিন্তু বিপ্লব এবং সবুজ বিপ্লবের উপর থেকে শুরু হয় দূষণের প্রকটতা। দূষণের ফলে ভারসাম্যহীনতা ঘটে থাকে। পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা প্রধানত অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নগরী স্থাপন এবং বনজ সম্পদের নির্মুলীকরণের মাধ্যমে ঘটে। এর ফলে প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর সংকট সৃষ্টি হয়, আবার জনসংখ্যা বিস্ফোরণের ফলে জৈবিক ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। দেশকে শিল্প সমৃদ্ধ করতে আমরা সেখানে কল-কারখানা গড়ে তুলছি। এসব কল-কারখানা থেকে নির্গত নানাবিধ বিষাক্ত গ্যাস এবং আবর্জনা পরিবেশকে দিনের পর দিন কলুষিত করে তুলেছে। বর্তমানে সবচেয়ে বেশী পরিবেশ দূষিত হচ্ছে- পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে। এ ধরনের বোমা বিস্ফোরণের ফলে তেজস্ক্রিয়তা পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে।

পরিবেশ দূষণকারী জৈব ও অজৈব পদার্থকে দূষণকারক বলা হয়। গ্রাম ও শহরের মানুষ প্রতিনিয়ত কিছু না কিছু পদার্থ পরিবেশে পরিত্যাগ করছে। পরিত্যক্ত পদার্থগুলোর পরিমাণ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেলে ক্রমশ: পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে। পরিবেশে ক্ষতিকারক এ সকল বস্তকে দূষণকারকরূপে আখ্যা দেয়া হয়। বাস্তবিদ ‘ওডাম’-এর মতে দূষণ পদার্থগুলোকে দু’টি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যেমন- যেসব পদার্থ প্রাকৃতিক পরিবেশে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ক্ষতিকারক বস্তুরূপে কাজ করে তাদের ক্রমক্ষয়যুক্ত পদার্থ বলে। পরিবেশে নানা প্রকার জৈব দূষণকারক পদার্থগুলো সাধারণভাবে ক্রমক্ষয়যুক্ত পদার্থ। প্রাকৃতিক পরিবেশে যেসব বস্তুর ক্ষয় ঘটে না, তাদের ক্রমক্ষয়হীন পদার্থ বলে। এরা সাধারণত নানা ধরনের ধাতু ও বিষাক্ত পদার্থ হয়ে থাকে। ক্রমক্ষয়হীন পদার্থের মধ্যে এলুমিনিয়াম, মারকিউরিক লবণ, গ্যামাজিন, অ্যানড্রিন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দূষণকারক পদার্থগুলো পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানকে দূষিত করে থাকে এবং সে অনুযায়ী দূষণের প্রকারভেদ করা যায়। যেমন- বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, মৃত্তিকাদূষণ ইত্যাদি। দূষণ অজীব ও সজীব উভয় পরিবেশে সংঘটিত হয়ে থাকে।

বায়ুদূষণ হচ্ছে বায়ুমন্ডলের একটি অবাঞ্চিত পরিবর্তন। বায়ু জীবনের প্রাণস্বরূপ। তাই বায়ুতে জীবের পক্ষে ক্ষতিকারক পদার্থগুলোর পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হলে তখন সে বায়ুকে আমরা দূষিত বায়ু বলে থাকি। যে পদ্ধতিতে বায়ু দূষিত হয়, সে পদ্ধতিকে বায়ুদূষণ বলে। বায়ুদূষণকারী পদার্থগুলো বায়ুতে প্রবেশ করে তারা জীবন ভূরাসায়নিক চক্রে প্রবেশ করে। দূষণকারী পদার্থগুলো বায়ুর সঙ্গে চলাচল করে এবং মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর শ্বাসক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায়। এছাড়া দূষিত বায়ু উদ্ভিদ ও জীবনের নানা প্রকার জৈবিক ক্রিয়ার ক্ষতিসাধন করে। আলোচনার সুবিধার্থে বায়ুদূষণকারী পদার্থগুলোকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। ন্যাচারাল পলিওটেন্ট, প্রাইমারি পলিওটেন্ট এবং সেকেন্ডারী পলিওটেন্ট। যেসব দূষণ প্রকৃতির বিভিন্ন স্বাভাবিক ঘটনার ফলে ঘটে থাকে, তাদের ন্যাচারাল পলিওশন এবং এ দূষণ যেসব পদার্থগুলোর দরুন সংগঠিত হয়, তাদের ন্যাচারাল পলিওটেন্ট বলা হয়। যেমন- দাবানল, ভূমিক্ষয়, আগ্নেয়গিরির আগ্নেয়পাত, গাছের পাতা এবং গাছ থেকে উদ্বায়ী জৈব যৌগ, জৈব পদার্থের পচন, পুষ্পরেণুর বিসরণ, প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তা ইত্যাদি। এ ধরনের দূষণ কোনো নতুন ঘটনা নয়, এগুলো পৃথিবীর প্রায় সৃষ্টিলগ্ন থেকে চলে আসছে। এসব দূষণের সঙ্গে প্রকৃতি নিজে মোকাবিলা করতে পারে। এসব পদার্থের দ্বারা বায়ু খুব অল্প মাত্রায় দূষিত হয় এবং এ ধরনের দূষণের ফলে বিশেষ কোনো প্রকার বিনষ্টিকরণ সাধিত হয় না।

প্রাইমারি পলিওটেন্ট বলতে কতগুলো ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থকে বোঝায় যেগুলো প্রাকৃতিক কারণে বা মানুষের বিভিন্ন কার্যকলাপের ফলে সরাসরি বাতাসে অনুপ্রবেশ করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কয়লা, তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস অথবা কাঠের জ্বালানির ফলে কার্বন-ডাই অক্সাইড তৈরি হয়, অটোমোবাইল এবং বিভিন্ন শিল্প-কারখানা থেকে প্রচুর কার্বন-ডাই অক্সাইড তৈরি হয় এবং কার্বন-মনো অক্সাইড বেরিয়ে আসে। ইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টে যে কয়লা এবং তেলের দহন হয়, তাতে অশুদ্ধি হিসাবে সালফার থাকে, ফলে এখান থেকে নির্গত হয় সালফার-ডাই অক্সাইড। নাইট্রোজেনের অক্সাইড, হাইড্রোকার্বন এবং বাতাসে ভাসমান বিভিন্ন পদার্থও প্রাইমারি পলিওটেন্টের উদাহরণ।

প্রাইমারি পলিওটেন্টগুলো বাতাসের বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে সৃষ্টি করে সেকেন্ডারি পলিওটেন্ট। যেমন- সালফার-ডাই অক্সাইড একটি প্রাইমারি পলিওটেন্ট। এ সালফার ড্রাই অক্সইড বায়ুমন্ডলের অক্সিজেনের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে সৃষ্টি করে সালফার-ডাই অক্সাইড। এ সালফার-ডাই অক্সাইড বায়ুমন্ডলের জলীয়বাষ্পের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে সৃষ্টি করে সেকেন্ডারী পলিওটেন্ট। যেমন- সালফার-ডাই অক্সাইড একটি প্রাইমারি পলিওটেন্ট। এ সালফার ড্রাই অক্সাইড বায়ুমন্ডলের অক্সিজেনের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে সৃষ্টি করে সালফার-ডাই অক্সাইড। এ সালফার-ডাই অক্সাইড বায়ুমন্ডলের জলীয়বাষ্পের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে তৈরি করে সালফিউরিক এসিড। এক্ষেত্রে সালফার-ডাই অক্সাইড ও সালফিউরিক অ্যাসিড দু’টি সেকেন্ডারী পলিওটেন্ট। হিসাব করে দেখা গেছে, যানবাহন চলাচলের ফলে বায়ুদূষণ হয় ৪২ শতাংশ, বিভিন্ন জ্বালানি থেকে বায়ুদূষণ ২১ শতাংশ, বিভিন্ন কয়লা কারখানা থেকে বায়ুদূষণ হয় ৫ শতাংশ এবং অন্যান্যভাবে বায়ুদূষণ হয় ১৮ শতাংশ। এসব বায়ুদূষণকারী পদার্থ মানুষ এবং অন্যান্য জীব-জন্তুর শারীরিক ক্ষতি ঘটায় এবং পরিবেশের পক্ষে বিপর্যয় ডেকে আনে সেগুলোকে বলা হয় মুখ্য বায়ুদূষক। নিম্নে কয়েকটি প্রধান প্রধান মুখ্য বায়ুদূষক সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল-

বিভিন্ন ইলেকট্রিক্যাল পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে প্রচুর পরিমাণে সালফার-ডাই অক্সাইড নির্গত হয়। সালফার-ডাই অক্সাইড উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয়ের পক্ষে ক্ষতিকারক। এ সালফার-ডাই অক্সাইড বায়ুমন্ডলের ওজন, হাইড্রোজেন-পার অক্সাইড অথবা জলীয় বাষ্পের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে সালফিউরিক অ্যাসিড উৎপন্ন করে এবং ফলস্বরূপ অ্যাসিড বৃষ্টি সংগঠিত হয়। হাইড্রোকার্বন বলতে কার্বন ও হাইড্রোজেনের যৌগ বোঝায়। কতগুলো হাইড্রোকার্বন সরাসরি মানুষ এবং বিভিন্ন পশুপাখির পক্ষে ক্ষতিকারক। কয়লার সঠিক দহন না হলে এ হাইড্রোকার্বনের সৃষ্টি হয়। যানবাহন চলাচলের জন্য যে দূষণ হয় তার মধ্যে ৪০ শতাংশ কার্বন-মনো অক্সাইডের দ্বারা সংগঠিত হয়। দাবানল এবং আগ্নেয়গিরি থেকে কিছু পরিমাণ কার্বন-মনো অক্সাইড নির্গত হয়। জ্বালানির অসম্পূর্ণ দহনের ফলে এ গ্যাস সৃষ্টি হয়। এটি একটি বিষাক্ত গ্যাস। এ গ্যাস রক্তের অক্সিজেন বহন ক্ষমতা হ্রাস করে।

সাধারণত কার্বন ঘটিত যৌগের সম্পূর্ণ দহনের ফলে কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্যাস উৎপন্ন হয়। কার্বন-ডাই অক্সাইড, কার্ব-মনো অক্সাইড গ্যাসের চেয়ে কম ক্ষতিকারক। এ গ্যাস সরাসরি উদ্ভিদ বা প্রাণীর কোনো ক্ষতি করে না; কিন্তু বায়ুমন্ডলের কার্বন-ডাই অক্সাইডের আধিক্যের ফলে অ্যাসিড বৃষ্টি এবং গ্রীন হাউস অ্যাফেক্ট সংঘটিত হয়। অটোমোবাইলে জ্বালানি দহনের ফলে লেড বায়ুমন্ডলে মিশে যায়। অটোমোবাইল ভালোভাবে চলার জন্য টেট্রা ইথানল ডে নামক একটি যৌগ এন্টি নকিং এজেন্ট হিসাবে পেট্রল বা গ্যাসোলিনের সঙ্গে মিশানো হয়। লেড দূষণের ফলে কিডনি, রক্ত এবং লিভারে বিভিন্ন রোগ হয়ে থাকে। বাড়ন্ত শিশুদের ক্ষেত্রে এ লেড দূষণ বৃদ্ধির হ্রাস ঘটায়। যখন উচ্চ তাপমাত্রায় ইন্ধনের দহন হয়, তখন নাইট্রোজেনের অক্সইড তৈরি হয়।

নাইট্রোজেনের অক্সইডগুলো তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিকারক। এ গ্যাসগুলো প্রধানত: যানবাহন (৫ শতাংশ), ইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট ইন্ধনের দহনের ফলে বায়ুমন্ডলে মিশে থাকে। বাংলাদেশের শহরগুলোতে প্রায় ৯০ শতাংশ নাইট্রোজেনের অক্সাইড ডিজেল চালিত গাড়িগুলো থেকে নির্গত হয়। নাইট্রোজেন অক্সাইড গ্যাসের ফলে রক্তের অন্তক্ষরণ নিমোনিয়া, যকৃতের ক্যান্সার প্রভৃতি রোগ হয়ে থাকে। বায়ুমন্ডলে বিভিন্ন প্রকারের কঠিন এবং তরল বস্তু কণা ভাসমান থাকে। এ ধরনের ভাসমান বস্তু কণাকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়- প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম। কুয়াশা, ব্যাকটেরিয়া, অপুষ্পক উদ্ভিদের বীজকণা, পুষ্পরেণু প্রভৃতির প্রাকৃতিক ভাসমান বস্তু কণার অন্তর্গত। সাধারণত এগুলোর দ্বারা বায়ুমন্ডল দূষিত হয় না। সিমেন্ট পাউডার, জ্বালানি ভস্ম, কোয়ার্জ, এসবেস্ট পাউডার, তেলের ধোঁয়া, তামাকের ধোঁয়া প্রভৃতি কৃত্রিম ভাসমান বস্তুকণার অন্তর্গত। এ কৃত্রিম ভাসমান বস্তুকণাগুলো দিনের পর দিন বায়ুমন্ডলকে দূষিত করে চলেছে। সাধারণত ধূমপান বলতে সিগারেটের ধোঁয়া সেবনকে বোঝায়। সিগারেট ছাড়া অন্যান্য জিনিষের ধোঁয়া সেবন করা যায়, যেমন- আফিম, ধুতরা ইত্যাদি। ধূমপান থেকে বিভিন্ন প্রকার রোগের সৃষ্টি হয়। যেমন- ফুসফুস এবং গলার ক্যান্সার। তেজস্ক্রীয় পদার্থ, তেজস্ক্রীয় রশ্মি বিকিরণের মাধ্যমে ক্ষয় হয়ে থাকে। তেজস্ক্রীয় পদার্থ থেকে তিন ধরনের রশ্মি নির্গত হয়। যেমন- আলফা, বিটা এবং গ্রাম। এ রশ্মিগুলো বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবন্ত কোষগুলোকে নষ্ট করে। অধিক জনবসতি, যানবাহন এবং শিল্প কারখানা আধিক্যের জন্য সাধারণত গ্রামাঞ্চল থেকে শহরাঞ্চলে শব্দদূষণ বেশি হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী দিনের বেলা ৪৫ ডেসিবেল এবং রাত্রিবেলা ৩৫ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দদূষণের আওতায় পড়ে না। তবে ৪০ ডেসিবেলের উপর শব্দ প্রচণ্ড ক্ষতিকারক।

পানির অপর নাম জীবন। জীবন ধারণের প্রধান উপাদান হলো পানি। কৃষি, মৎস্য চাষ এবং শিল্প-কারখানাতে পানির প্রয়োজন হয়। পানির উৎস হলের সমুদ্র, নদী, হ্রদ, পুকুর এবং বায়ুমন্ডলের জলীয় বাষ্প। বায়ুমন্ডলের ন্যায় পানির মধ্যে নানাবিধ অবাঞ্চিত পদার্থ মিশে পানিকে কলুষিত করে তুলছে। বর্তমানে পানি দূষণ বিশ্বের সব দেশের সামনে একটি জ্বলন্ত সমস্যা। নিম্নলিখিত উপায়ে পানি দূষণ হয়ে থাকে। বাংলাদেশ তথা বিশ্বের বিভিন্ন শহরের অধিকাংশ শিল্প গড়ে উঠেছে নদীর তীরে। এসব শিল্প-কারখানা থেকে প্রতিনিয়ত তরল পদার্থ বর্জ্য পদার্থগুলো পরিত্যক্ত হচ্ছে নদীর পানিতে। বর্তমানে বড় বড় বন্দরে নোংরা করা বা তৈলবাহী জাহাজ থেকে নিঃসৃত পেট্রল বা ডিজেল পানিকে দূষিত করে তোলে।

মানুষ গ্রামে ও শহরে নদী, হ্রদ, পুকুর প্রভৃতিতে গোসল ও বস্ত্রাদি ধৌত করে। বিভিন্ন গবাদি পশুকে এ পানিতে গোসল করানো হয়। এছাড়া পুকুর পার হতে বৃষ্টি হলে আশপাশের ময়লা-আবর্জনাও পুকুরে গিয়ে পড়ে। এর ফলে নানা জাতীয় জীবাণু ও রাসায়নিক পদার্থ পানিতে মিশে গিয়ে পানিকে দূষিত করে।

পারমাণবিক চুল্লি থেকে নিঃসৃত নানাবিধ তেজস্ক্রীয় পদার্থ সম্বন্বিত আবর্জনা সমুদ্রগর্ভে নিক্ষেপ করা হয়। পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলে নিক্ষিপ্ত তেজস্ক্রীয় পদার্থগুলো বৃষ্টির সময় সরাসরি সমুদ্রে পতিত হয়ে পানি দূষিত করে থাকে। কৃষিকাজে উন্নতির জন্য বিভিন্ন প্রকারের সার ব্যবহার করা হয়। পোকাণ্ডমাকড়ের হাত থেকে শস্যকে বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন কীটনাশক পদার্থ বৃষ্টির মাধ্যমে পানির সঙ্গে মিশে যায় এবং পানির দূষণ ঘটায়। এছাড়া শুকরের ফার্ম, মুরগির পোলট্রি, কসাই খানা প্রভৃতি জায়গা থেকে পানির দূষণ ঘটে থাকে। পানি দূষণের শিকার হয়ে মানুষ বিভিন্নভাবে রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। ডায়রিয়া, আন্ত্রিক চোখের স্বাভাবিক ক্ষমতা হ্রাস ইত্যাদি রোগগুলো-এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কার (১ম স্বর্ণপদক) প্রাপ্ত।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত