গভীর সংকটে প্রবাসী শ্রমবাজার

দূর করতে হবে সমন্বয়হীনতা ভাঙতে হবে সিন্ডিকেট

প্রকাশ : ০৪ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

দিন দিন গভীর সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে প্রবাসী বাংলাদেশের শ্রমবাজার। বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রম বাজার এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও বাংলাদেশি শ্রমিকরা খুব একটা সুবিধা করতে পারছেন না। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতির কারণে অনেক দেশ এখন বিদেশি শ্রমিকদের নিরুৎসাহিত করছে। এছাড়া শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে নানা রকম ছলচাতুরির আশ্রয় নেয়ায় শ্রমিকরা বিদেশে গিয়ে নানা সংকটের মধ্যে পড়ছেন। আমাদের দেশের শ্রমিকরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে তেমন একটা প্রশিক্ষিত নন। এ ছাড়া তারা যে দেশে যান, সেই দেশের ভাষা ও প্রচলিত আইন সম্পর্কে তারা অবগত থাকেন না। ফলে সেখানে গিয়ে তারা নানা রকমের সংকটের মধ্যে পড়ে যান। শ্রমিকদের বেতনভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সংবলিত যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদেশে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে গিয়ে তারা সেই বেতন-ভাতা বা সুযোগ-সুবিধা অনেক সময় পায় না। এ কারণে শ্রমিকরা অনেকটা হতাশায় ভোগে এবং তারা নিজ নিজ কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। বেশিসংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থার মধ্যে সুসমন্বয় গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশে অর্থনীতিকে চাঙা রাখতে প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন, এটা অস্বীকার কোনো উপায় নেই। প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো ডলারের ওপর বাংলাদেশের ডলার বাজার অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক অধীর আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষায় থাকে কোনো মাসে প্রবাসীরা কী পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠান। বিভিন্ন উৎসব পার্বণের আগে রেমিট্যান্সের পরিমান বেড়ে গেলে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক পুলকিত হয়ে উঠে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ বেড়ে যায়। সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতারা সন্তোষ প্রকাশ করেন। তবে আশ্চার্য বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশ শ্রমিকরা কীভাবে আরো বেশিসংখ্যায় বিদেশে যেতে পারে সে ব্যাপারে আমাদের মন্ত্রণালয়, শ্রমিক প্রেরণকারী সংস্থা ও বিদেশে বাংলাদেশি মিশনের মধ্যে কোনো প্রকার তাগিদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তাদের মধ্যকার এই সমন্বয়হীনতার কারণে মাঝখানে একটা সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। সেই সিন্ডিকেটের কারণে অতি সম্প্রতি প্রায় ৩১ হাজার শ্রমিক মালয়েশিয়া যেতে পারেননি। এ সব শ্রমিক তাদের সহায়-সম্বল বিক্রি করে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছিলেন কিন্তু শেষ সময় এসে তাদের সেই আশা ভঙ্গ হয়েছে। মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান এবং গমনেচ্ছু কর্মীদের হয়রানিসহ ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। একই সঙ্গে কমিটিকে আগামী সাত কর্ম দিবসের মধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী জানিয়েছেন, প্রতিবেদনের সুপারিশের আলোকে দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সংশ্লিষ্ট কমিটির কর্মানুমতি ও ক্লিয়ারেন্স কার্ড পাওয়ার পরও মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে না পারার কারণ চিহ্নিতকরণ, নির্ধারিত সময়ে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে ব্যর্থ রিক্রুটিং এজেন্সি চিহ্নিতকরণে কাজ করবে ওই কমিটি। আমাদের দেশে কোনো একটি ঘটনা ঘটলে জনরোষ প্রশমনে একটি দায়সারা গোছের কমিটি করে দেয়া হয়। কমিটি তার মতো করে কিছু সুপারিশ পেশ করে। এসব সুপারিশ ফাইলবন্দি হওয়ার পর তা বাস্তবায়ন হয় কি না, তা মানুষ জানেন না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুই হারিয়ে যায়। মানুষও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং সরকারি প্রশাসনও ঝামেলায় জড়াতে চায়না। বিদেশে কর্মী প্রেরণ নিয়েও সিন্ডিকেটের প্রশ্ন উঠে এসেছে। এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়া মালয়েশিয়া ছিল বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার। দেশটিতে বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশি কর্মী আছেন। গত বছর সেখানে গেছেন ৩ লাখ ৫১ হাজার ৬৮৩ জন কর্মী। এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত গেছেন ৪৪ হাজার ৭২৭ জন। মালয়েশিয়া সরকার গত মার্চেই ঘোষণা করে, ৩১ মে’র পর আর কোনো নতুন বিদেশি শ্রমিক দেশটিতে ঢুকতে পারবেন না। সে হিসেবে আবার অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হলো এই শ্রমবাজার। মালয়েশিয়া বিদেশি কর্মী প্রবেশের জন্য ৩১ মে সময়সীমা বেঁধে দিলেও মন্ত্রণালয় এ নিয়ে জরুরি বিজ্ঞপ্তি দেয় ১৬ মে। ফলে শেষ মুহূর্তে উড়োজাহাজের টিকিটের তীব্র সংকট তৈরি হয়। সময়সীমার শেষ দিনে শুক্রবার মালয়েশিয়া যাওয়ার শেষ চেষ্টা করতে টিকিট ছাড়াই ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভিড় জমান হাজারো মানুষ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেতে না পেরে অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এসব প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে কেউ জমি জমা সব বিক্রি করেছেন। কেউ বন্ধক রেখেছেন সোনাদানা। গবাদি পশু বিক্রি কিংবা কেউ ঋণ করে টাকা জোগাড় করেছিলেন মালয়েশিয়ায় যেতে। তবে শেষ সময়ে যারা গিয়েছেন তাদেরও গুনতে হয়েছে তিন থেকে চারগুণ বাড়তি বিমান ভাড়া। মালয়েশিয়া সরকার সময়সীমা বেঁধে দিয়ে আগে থেকে ঘোষণা দেয়ার পরও কেন এমন সংকট তৈরি হলো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) মধ্যে সমন্বয়নহীনতা এবং সিন্ডিকেট করে লোক পাঠানোকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা। সিন্ডিকেট করে লোক পাঠানোর প্রতিযোগিতার কারণে এই সংকট তৈরি হয়েছে বলে মনে করছে অভিবাসন নিয়ে কাজ করা সংস্থা রামরু। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সাথে বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর এক ধরনের ‘অসম আদান-প্রদানের’ কারণেই এটা তৈরি হয়েছে। তবে প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী অভিযোগ করেছেন রিক্রুটিং এজেন্সির বা বায়রার গাফেলতির কারণেই শ্রমিকরা মালয়েশিয়া যেতে পারেননি। তিনি বলেন, বিষয়গুলো তদন্ত করে দেখছি। যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে বায়রা বলেছে, একেবারে শেষ পর্যায়ে বেশ কিছু ই-ভিসা ইস্যু হওয়া ও ফ্লাইটের স্বল্পতার কারণে এই সংকট তৈরি হয়েছে। সেজন্য শেষ পর্যন্ত সবাইকে মালয়েশিয়া পাঠানো সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়ার জন্য কর্মীরা বিমানের টিকিট ক্রয় করতে ট্রাভেল এজেন্টদের ওপর নির্ভর করে। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ আটাব বলেছে, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো-বিএমইটি, ও বায়রার মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণেই এই সংকট তৈরি হয়েছে। দেশের হতাশাগ্রস্ত বেকার যুব সমাজ কষ্ট করে বিদেশে যাওয়ার অর্থ সংগ্রহ করে তারা বিদেশে গিয়ে রাত-দিন পরিশ্রম করে দেশে রেমিট্যান্স পাঠান। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল করেন। আর সরকার সেই সচল চাকার ওপর ভর করে দেশ পরিচালনা খরচ জোগাড় করে। অথচ প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণে যেন কারো কোনো কিছু করার নেই। এই মনোভাব থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।