সংকটকালে কৌশলী বাজেট

প্রভাষ আমিন

প্রকাশ : ০৫ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আওয়ামী লীগ এখন টানা চতুর্থ মেয়াদে দেশ পরিচালনা করছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে আওয়ামী লীগের মূল লক্ষ্য ছিল উন্নয়ন। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে সরকার তাদের লক্ষ্য অনেকটাই পূরণ করতে পেরেছে। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে বদলে দিয়েছে। উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে দেশের আনাচেকানাচে। বাংলাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামো এখন সুবিন্যস্ত।

এছাড়া পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, সাবমেরিন, স্যাটেলাইট, পারমাণবিক বিদ্যুৎ- একের পর এক নতুনের দেখা পেয়েছে বাংলাদেশ। এই সময়ে মাথাপিছু আয় বেড়েছে, জিডিপি বেড়েছে, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছে।

সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি দারুণ এক মোমেন্টাম পেয়েছিল। কিন্তু প্রথম করোনা এসে সেই গতির রাশ টেনে ধরে। করোনার ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অর্থনীতির গতি আবারো শ্লথ করে দেয়। যে অর্থনীতি আওয়ামী লীগের সবচেয়ে সাফল্য ছিল, সেই অর্থনীতিই এখন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে।

এই চ্যালেঞ্জ সামনে রেখেই আগামীকাল সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনা পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী।

সরকারের চতুর্থ মেয়াদের প্রথম বাজেট এটি। অর্থমন্ত্রী হিসেবে মাহমুদ আলীরও প্রথম বাজেট। মানতেই হবে আওয়ামী লীগ সরকারের সবচেয়ে কঠিন বাজেট হতে যাচ্ছে এটি। এবারের বাজেটের শিরোনাম হচ্ছে ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’। বরাবরই বাজেটে অনেক গুরুগম্ভীর পরিসংখ্যান ঢাকা পড়ে যায় কথার ফুলঝুরিতে। এবারের শিরোনাম দেখেও বোঝা যাচ্ছে, কথার ফুলঝুরিতেই আড়ালের চেষ্টা করা হবে অনেক সংকট।

মুখে স্বীকার করুক আর নাই করুক, বাংলাদেশের অর্থনীতি যে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় সংকটকাল পার করছে, এটি সরকারের নীতিনির্ধারক জানেন। আমাদের চেয়ে ভালোই জানেন। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকেই এক নম্বর অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। নির্বাচনের পরও সরকার এ অঙ্গীকার থেকে সরে আসেনি। নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো বাজার তো আর সামগ্রিক অর্থনীতির বাইরে নয়। ডলারের দাম বাড়লে আমদানি করা সব জিনিসের দামই বেড়ে যায়।

অনেকদিন ধরে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনযাপন কঠিন করে তুলেছে। সরকার নানাভাবে নিম্নবিত্ত মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু তবু দ্রব্যমূল্যের এই চাপ সামলানো কারো জন্যই সহজ নয়। আগামী বাজেটে নিশ্চয়ই এ বিষয়টি সরকারের মাথায় থাকবে। কীভাবে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন একটু সহজ করা যায়, সেই চেষ্টা নিশ্চয়ই থাকবে। কিন্তু দফায় দফায় পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসের বাড়তি দাম, সাধারণ মানুষের চাপকে আরো অসহনীয় করে তুলেছে। সরকারের অবস্থাও সাধারণ মানুষের মতোই। পা ঢাকতে গেলে মাথা উদোম হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের যেমন আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি, সরকারেরও তাই। দেশি-বিদেশি নানা উৎস থেকে ঋণ নিয়ে সরকার পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু ঋণ নিলে সেটি শোধ দিতে হয়। পুরো ঋণ না হলেও সুদ দিতে হয়।

ঋণের সুদ এখন সরকারের মাথার উপর একটি বড় বোঝা হয়ে চেপে বসেছে। আসলে অর্থনীতি চারিদিক থেকে চেপে ধরেছে। অর্থনীতির চাপ সামাল দিতে সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছে। তবে চাইলেই আইএমএফের ঋণ পাওয়া যায় না। নানা শর্ত মেনেই আইএমএফের ঋণ নিতে হয়। আর আইএমএফের শর্ত শুধু মুখে মুখে মানলেই হবে না। ঋণের কিস্তি দেওয়ার আগে প্রতিবার আইএমএফ প্রতিনিধিদল সফর করে শর্ত মানার অগ্রগতি জানতে চায়। সন্তুষ্ট হলেই কেবল ঋণ ছাড় হয়।

আইএমএফের যেসব শর্ত তা দীর্ঘমেয়াদে যে কোনো অর্থনীতির জন্যই ভালো। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন যে সংকটকাল পার করছে, এই সময়ে আইএমএফের শর্ত মানতে গেলে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ আরো বাড়বে। আবার আইএমএফের শর্ত না মেনেও উপায় নেই। সরকার তাই উভয় সংকটে আছে। এখন সরকারকে বাজেট প্রণয়নে কৌশলী হতে হবে। কীভাবে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ না বাড়িয়ে আইএমএফকে সন্তুষ্ট রাখা যায়, সেটিই এখন মূল ভাবনা। নয়া অর্থমন্ত্রীকে তাই বাজেট প্রণয়নে কৌশলী হতে হবে, ভিন্নভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। কাজটা সহজ নয়। আবার এর কোনো বিকল্পও নেই।

আইএমএফ ভর্তুকি কমাতে বলে, ট্যাক্স-জিডিপি হার বাড়াতে বলে, কর ছাড় কমাতে বলে, রাজস্ব আয় বাড়াতে বলে, অর্থনৈতিক খাতে বিশেষ করে ব্যাংকখাতে সংস্কার ও সুশাসন নিশ্চিত করতে বলে। কোনোটাই খারাপ কথা নয়। গ্যাস-পানি-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সরকার ভর্তুকি কমানোর পথেই হাঁটছে। কিন্তু ভর্তুকি কমানোর চেষ্টায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলে ঝুঁকিতে পড়বে খাদ্যনিরাপত্তা। নিম্নবিত্ত মানুষকে সুরক্ষা দিতে সামাজিক নিরাপত্তা খাতেও হাত দেওয়ার খুব একটা সুযোগ নেই।

গত কয়েক বছর ধরেই সরকার বড় বড় বাজেট দিয়েছে। অনেকে উচ্চাভিলাসী সরকার তা কানে তোলেনি। এবার বোধহয় আর সেই সুযোগ নেই। এবার সরকারকে একটু মিতব্যয়ী হতেই হবে। উচ্চাভিলাসী ও ব্যয়বহুল প্রকল্প এবার সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় নেই। কিন্তু এই টানাটানির সংসারেও যখন ডিসি-ইউএনওদের জন্য গাড়ি কেনার পরিকল্পনা দেখি, মন খারাপ হয়ে যায়। বাংলাদেশের অর্থনীতির এখন যে অবস্থা তাতে সব ধরনের অপচয় বন্ধ করতে হবে। সব ক্ষেত্রেই সংযমী হতে হবে। বাস্তবতা হলো, এখন প্রতিটি পয়সা হিসাব করে ব্যয় করতে হবে।

আমাদের যে মানসিকতা, তাতে সরকারের ব্যয় কমানোর চেষ্টাটা অনেক কঠিন। অনেক চেষ্টা করেও খুব বেশি কমানোর সুযোগ নেই। তারচেয়ে আয় বাড়ানোর চেষ্টা করা সহজ। সরকার সেটিই করতে চাইছে। আইএমএফের শর্ত মেনে এবার কর অব্যাহতির আওতা কমিয়ে আনা হতে পারে। এটি ঠিক বাংলাদেশের অর্থনীতি যে আকারে বেড়েছে, রাজস্ব আয় সে তুলনায় বাড়েনি। রাজস্ব বোর্ডের চেষ্টা আছে, তবে তাতে সৃষ্টিশীলতা নেই। ১৮ কোটি মানুষের দেশে আয়কর ফাইল আছে মাত্র লাখ ত্রিশেক। তাও সবাই রিটার্ন দেনও না। চাকরির কারণে বাধ্যতামূলকভাবেই অনেককে আয়কার ফাইল খুলতে হয়েছে। এখন নানাভাবে নানাক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন বাধ্যতামূলক করে রাজস্ব বোর্ড আরো অনেককেই করজালের আওতায় আনার চেষ্টা করছে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, কর দিতে পারেন, এমন কোটি মানুষ এখনো কর জালের বাইরেই রয়ে গেছেন। আয়কর দিতে পারেন, এমন সবাইকে করের আওতায় আনা গেলে রাজস্ব আয় নাটকীয়ভাবে বাড়ানো সম্ভব। গ্রামে অনেককে দেখেছি, যারা আয়কর সীমার চেয়ে অনেক বেশি আয় করেন। কিন্তু আয়কর দেওয়ার ধারণাটা নেই তাদের মধ্যে। যারা বাধ্য হয়ে আয়কর জালে ফেঁসে গেছেন, রাজস্ব বোর্ড বারবার নানাভাবে তাদের চিপেচুষে আয় বাড়াতে চান। করহার না বাড়িয়ে করজাল বাড়ালে আয় অনেক দ্রুত বাড়বে। আর বিত্তবানদের কাছ থেকে আরো অনেক বেশি হারে কর আদায় করতে পারলে মধ্যবিত্তদের কম চাপ দিতে পারে রাজস্ব বোর্ড। রাজস্ব আয় না বাড়ার আরেকটি বড় কারণ- ভীতি। মানুষ রাজস্ব বোর্ডকে ভয় পায়। তারা মনে করেন, একবার এনবিআরের পাল্লায় পড়লে আর রক্ষা নেই।

আয়কর দেওয়া যে দেশপ্রেমের অংশ সেটি মানুষকে বোঝাতে হবে। মানুষকে বুঝিয়ে কর আদায় করার চাইতে, গলায় পা দিয়ে আদায় করতে বেশি উৎসাহী এনবিআর। এই মনোভাব বদলাতে না পারলে আইএমএফের শর্ত, আয় বাড়ানোর আকাঙ্ক্ষা কোনোটাই বাস্তবায়িত হবে না।

টাকা-পয়সা নিয়ে সরকারের এত টানাটানির পাশাপাশি যখন মানুষের হাজার কোটি টাকা, হাজার বিঘা সম্পত্তির গল্প শুনি, হাজার কোটি পাচার, লক্ষ্য কোটি টাকার খেলাপি ঋণের গল্প শুনি; মন খারাপ হয়ে যায়। চৌবাচ্চার গল্প মনে পড়ে যায়। নিচে ছিদ্র রেখে উপরে যতই পানি ঢালুন চৌবাচ্চা কখনো পূর্ণ হবে না। এত অনিয়ম, এত অপচয়, এত দুর্নীতি বহাল রেখে দেশের অর্থনীতি এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। অপচয় বন্ধ না হলে কোনো অর্থমন্ত্রীর পক্ষেই ভালো বাজেট দেওয়া সম্ভব নয়।

লেখক : কলাম লেখক।