ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাজেট হোক আতঙ্কমুক্ত

অর্থনৈতিক বাস্তবতায় হোক জনবান্ধব
বাজেট হোক আতঙ্কমুক্ত

প্রতি বছর জাতীয় সংসদে পরবর্তী অর্থ-বছরের বাজেট ঘোষণা করার পরপরই নিত্যপণ্য ও সেবা গ্রহণের খরচ বেড়ে যায়। কোন কোন পণ্যের দাম বাড়তে পারে কিংবা কোন কোন পণ্যের দাম কমতে পারে তা নিয়ে মানুষ এখন আর আলাপ-আলোচনা করতে আগ্রহী হচ্ছে না। বাজেট ঘোষণা করার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা আতঙ্ক বিরাজ করে হয়তো নতুন করে কোনো পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে। দেশের অস্বাভাবিক মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে পণ্যের মূল্য বাড়তে থাকায় এক শ্রেণির মানুষ এখন সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। বাজেট ঘোষণার পর আবার যদি পণ্যের দাম বেড়ে যায় তাহলে মানুষ কি করবে সেটা সে নিজেও জানে না। সরকার বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য ভেঙে দিতে না পারলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে না। আসন্ন বাজেটে এমন পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে যাতে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জন্য তা কল্যাণকর হয়। বাজেট যেন পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির উপলক্ষ্য না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির সোপানে নিয়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধির পথ রচনা করেছিলেন প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এরপর তিনি জাতিকে উন্নয়নের মহাসড়কেও তুলে দেন। তারই পথ ধরে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও নিজের প্রথম বাজেটে জাতিকে ‘সমৃদ্ধির সোপানে’ নিয়ে যান। তবে মহামারি কোভিড-১৯ এ পিষ্ট হওয়ায় এরপরই অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নামতে হয় মুস্তফা কামালকে। এরপর তিনি স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা শুরু করেন। এই অগ্রযাত্রায় বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী নিজের প্রথম বাজেটে সংসদে সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার করে আগামীকাল জাতির সামনে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকার বাজেট উত্থাপন করতে পারেন। ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’ শীর্ষক এ বাজেটের মূল লক্ষ্য থাকবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। স্বাভাবিকভাবেই এবার সংকোচনমূলক বাজেট দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে প্রায় তিন লাখ কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তরুণ-তরুণী ও যুবসমাজকে প্রস্তুত করতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ থাকতে পারে। মূল্যস্ফীতির অভিঘাত থেকে বেরোনোর জন্য বাড়ানো হতে পারে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম। একই সঙ্গে অর্থনীতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত কী হতে পারে, এবারের বাজেট উত্থাপনের সময় একটি বিশ্লেষণ থাকতে পারে। রাজস্ব আয় বাড়াতে অধিক সংখ্যক মানুষকে করজালের আওতায় নিয়ে আসার ছকও আঁকা হচ্ছে। এজন্য কিছু নতুন ক্ষেত্রে করারোপ হতে পারে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট উত্থাপন করে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট সোসাইটি ও স্মার্ট ইকোনমি এই চারটি মূল স্তম্ভের ওপর স্বপ্নের স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে। এই স্মার্ট বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় হবে কমপক্ষে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার। দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকবে ৩ শতাংশের কম মানুষ। আর চরম দারিদ্র্য নেমে আসবে শূন্যের কোঠায়। মূল্যস্ফীতি সীমিত থাকবে ৪-৫ শতাংশের মধ্যে। রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত হবে ২০ শতাংশের উপরে। বিনিয়োগ হবে জিডিপির ৪০ শতাংশ। পণ্যের দামে প্রভাব পড়ার একটা আশঙ্কা থেকেই যায়। স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা শুরুর অর্থবছরে (২০২৩-২৪) মুস্তফা কামাল মূল বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলেছিলেন। তবে সংশোধিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৭ শতাংশে সমন্বয় করা হয়। আর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্র মূল বাজেটে ৫ লাখ কোটি টাকা ধরা হলেও, সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৪ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা করা হয়। তবে অর্থবছর শেষে এই দুটির একটিরও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে কি না তা নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার করে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী যে বাজেট দেবেন, সেখানে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৬ শতাংশ ধরা হতে পারে। আর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে ৫ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হতে পারে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বেশি। বাজেট ঘোষণার পরপর ‘পণ্যের দামে প্রভাব পড়ার একটা আশঙ্কা থেকেই যায়। বাজেট ঘোষণায় যেসব পণ্যের দাম বাড়ানো হয় সেই পণ্যের দাম বাজেট ঘোষণার পরদিনই বেড়ে যায়। আর যেসব পণ্যের দাম কমে যায়। সেব পণ্যের দাম সহজে কমে না। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচির শর্তের প্রতিফলন দেখা যেতে পারে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে। আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির অন্যতম শর্ত হলো, আগামী অর্থবছর কর-জিডিপির অনুপাত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে হবে। রাজস্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে করের আওতা সম্প্রসারণ, কর প্রশাসনের সংস্কার ও আদায় প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয়করণের পাশাপাশি কর অব্যাহতি ও শুল্ক-কর ছাড় আগামী তিন অর্থবছরের মধ্যে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। সঞ্চয় করা এখন কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের কারণে মানুষের সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এর ওপর যদি ছোট সঞ্চয়কারীদের ওপর আবগারি শুল্ক বেশি পড়ে, তাহলে তো মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়াবে। আইএমএফের শর্তের কারণেই এবার বাজেটে কর অব্যাহতি ও শুল্ক-কর ছাড় কমিয়ে রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ রাখার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। অবশ্য মাত্র ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে কালো টাকা সাদা করার সুযোগও দেওয়া হতে পারে এবার। এছাড়া আগামী বাজেটে সিগারেটের সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হতে পারে। একই সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলা বা ইন্টারনেটের ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা দিতে পারেন অর্থমন্ত্রী। ব্যাংকে জমা টাকার ওপর আবগারি শুল্কের স্তর ও হারে পরিবর্তন আসতে পারে। ফলে বাড়তে পারে ব্যাংকে জমা টাকা রাখার খরচ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে সম্প্রতি অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেছেন, ‘বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি-মুদ্রাস্ফীতির সমস্যা আছে। সেগুলো থেকে বাংলাদেশও বাইরে নয়। এই সমস্যা নিরসনে প্রস্তাবিত বাজেটে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে।’ তবে সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে আগামীকাল বাজেট পেশ করার পর।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত